বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বিদেশ থেকে আসা এত সোনা কোথায় যাচ্ছে?

| প্রকাশিতঃ ২৭ জানুয়ারী ২০২২ | ১১:১৪ পূর্বাহ্ন


মোহাম্মদ রফিক : দেশে বিমানবন্দর দিয়ে বৈধ উপায় সোনা আমদানি বেড়েছে। গত ১৫ মাসে ৩২৪ কোটি, ডলারের ৫৬ টন সোনার বার এসেছে। বিদেশ থেকে ফেরার সময় সঙ্গে করে যাত্রী এসব সোনা এনেছেন। পাশাপাশি আমদানিকারকেরা বৈধভাবে কিছু সোনা এনেছেন। এর বাইরেও চোরাচালানের মাধ্যমেও দেশের তিনটি বিমানবন্দর দিয়ে সোনা আসে। মাঝেমধ্যে তা শুল্ক গোয়েন্দাদের হাতে ধরা পড়ে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিদেশ থেকে আসা সোনা কোথায় যাচ্ছে?

কাস্টমস সূত্র জানায়, দেশে বৈধ উপায়ে যেসব সোনা দেশে আসছে এর চাহিদা বাংলাদেশে নেই। এটির বড় একটি অংশ ভারতে পাচার হচ্ছে। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল গত ৯ ডিসেম্বর ‘বুলিয়ন ট্রেড: ইন্ডিয়ান গোল্ড মার্কেট সিরিজ’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতে বছরে ১০০ টনের মতো সোনা অবৈধ পথে ঢোকে। যার উৎস বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীন।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অবৈধ সোনা বাণিজ্যের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়। বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে আনা সোনার বিপরীতে এলে সরকার রাজস্ব কম পায়৷ সোনা–বাণিজ্যের সঙ্গে অস্ত্র, মাদক ও হুন্ডির যোগসূত্র থাকে। সোনার বদলে মুদ্রা এলে তা বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে ভূমিকা রাখে।

জানা গেছে, বিদেশ থেকে ফেরার সময় একজন যাত্রী বিনা শুল্কে ১০০ গ্রাম বা সাড়ে আট ভরি পর্যন্ত সোনার গয়না আনতে পারেন। এই সোনার গয়না সাধারণত দেশের বাজারে কেনাবেচা হয়। তবে এই সোনার হিসাব নথিভুক্ত করা হয় না বিমানবন্দরে। অন্যদিকে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালা অনুযায়ী, একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম বা ২০ ভরি সোনার বার শুল্ককর পরিশোধ করে আনতে পারেন। এভাবে আনার ক্ষেত্রে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শুল্ক ভরিপ্রতি এক হাজার টাকা কমিয়ে দুই হাজার টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তিনটি বিমানবন্দরের কাস্টমসের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি সোনার বার আসছে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে।

কাস্টমস কর্তৃপক্ষ জানায়, গত ১৫ মাসে যাত্রীরা বিমানবন্দর দিয়ে প্রায় ৩২ লাখ ভরির সোনার বার এনেছেন। একই সময়ে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে আনা হয়েছে ১১ লাখ ভরি সোনা। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে ৮ হাজার ৩৪৭ ভরি সোনা। তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৭৫ শতাংশই সোনার বার আসছে আরব আমিরাত থেকে। সোনা খাতে গত ১৫ মাসে সরকার শুল্ক পেয়েছে ৭৫০ কোটি টাকা।

জানা গেছে, দুটি কারণে যাত্রীরা সোনা আনছেন। ল জানা যায়। এর কারণ দেশে দাম বেশি। বিক্রি করলে বিক্রেতার লাভ হয়। আর যারা বাহক হিসেবে কাজ করেন তারা টাকা পান। দুবাইয়ে এখন ২২ ক্যারেট মানের এক ভরি সোনার দাম ৫৪ হাজার টাকা।

কাস্টমস জানায়, গত ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ব্যাগেজ রুলের আওতায় সোনার বার আমদানিতে সুবিধা বাড়ানো হয়। তবে দেশে সোনার দাম বেড়েই চলেছে। দাম বাড়ার সময়ে আকাশপথে প্রতিদিন দেশে ঢুকছে বিপুল পরিমাণ সোনা। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে দুবাই ফেরত যাত্রীরা দেশে ফেরার সময় বৈধ উপায়ে ঘোষণা দিয়ে সোনার বার নিয়ে আসছেন। এভাবে দিন দিন সোনার আমদানি বাড়ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে দেশে বিপুল পরিমাণ সোনার বার আসছে।

সূত্র জানায়, প্রতিটি সোনার বার শুল্ককর দিয়ে আনা হলেও বাজারমূল্যের চেয়ে গড়ে ১০-১২ হাজার টাকা দাম কম পড়ে। আবার সোনার বারে খাদ মেশানোর পর মূল্য সংযোজন আরও বেশি হয়। এ কারণে যাত্রীদের মাধ্যমে দুটি করে সোনার বার নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ সরকারকে রাজস্ব দিয়ে বিদেশফেরত যাত্রীদের মাধ্যমে সোনার বার আনার ক্ষেত্রে শুল্ক কর বাবদ বাড়তি খরচ হলেও ঝুঁকি অনেক কম। এ জন্য এখন যাত্রীদের মাধ্যমে বৈধভাবে সোনার বার আনার ঘটনা বাড়ছে বলে মনে করেন চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার ফখরুল ইসলাম।

বাজুসের সাধারণ সম্পাদক ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড এর মালিক দীলিপ আগাওয়াল একুশে পত্রিকাকে জানান, দুবাই থেকে এখন প্রায় প্রতি ভরি সোনার বার আমদানিতে শুল্ক-করসহ খরচ পড়ে প্রায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা। প্রতিটি বারে (১০ ভরি) প্রায় ১০-১২ হাজার টাকা মুনাফার সুযোগ রয়েছে। এ কারণে প্রবাসীরা দেশে ফেরার সময় সোনা নিয়ে আসছেন। বাড়তি আয়ের আশায় অনেকে দেশে ফেরার সময় জমানো টাকায় সোনার বার নিয়ে ফিরছেন।’

শুল্ক কর্মকর্তারা বলছেন, বৈধভাবে সোনার আমদানি বাড়ায় সরকার রাজস্ব পাচ্ছে। এতে ব্যবসার সুষ্ঠু পরিবেশও বজায় থাকবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে বৈধ পথে দুইভাবে সোনা আমদানি করা যায়। ২০১৮ সালের স্বর্ণ নীতিমালার আওতায় লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের অনাপত্তি নিয়ে সোনা আমদানি করতে পারে। আবার ব্যাগেজ রুলের আওতায় একজন যাত্রী বিদেশ থেকে ফেরার সময় ঘোষণা দিয়ে সর্বোচ্চ ২৩৪ গ্রাম ওজনের সোনার বার নিয়ে আসতে পারেন। বৈধভাবে সোনার বার আমদানির জন্য শুল্ক-কর পরিশোধ করতে হয়। ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রতি ভরিতে (১১ দশমিক ৬৬৪ গ্রাম) শুল্ক-কর ২ হাজার টাকা।

বৈধ পথে সোনার বার আমদানি বাড়ার কারণ সম্পর্কে বাজুসের সাধারণ সম্পাদক ও ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দিলীপ কুমার আগরওয়ালা গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যাত্রীরা যেসব সোনার বার আনছেন, তা নিজেদের অলংকার তৈরির জন্য। আবার অনেকে বিদেশ থেকে ফেরার সময় লাভের আশায় সোনার বার নিয়ে আসছেন। আনার পর তাঁরা স্বর্ণের দোকানে বিক্রি করছেন।’

এদিকে বৈধ পথের পাশাপাশি অবৈধ পথেও সোনার বার আসছে। যেসব চালান ধরা পড়ছে, সেগুলো শনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে। তবে মূল হোতারা ধরা পড়ছে না। বাজুসের চট্টগ্রাম শাখার এক নেতা বলেন, অবৈধ পথে যেসব সোনার বার আসছে, সেগুলো দেশের স্বর্ণশিল্পে যুক্ত হচ্ছে না। অবৈধ পথে আনা সোনার বার মূলত দেশের বাইরে আবার পাচার হয়ে যায়।

সোনার ব্যবসায়ীরা জানান, বিদেশফেরত যাত্রীরা যেসব সোনার বার নিয়ে আসছেন, তা সাধারণত ২৪ ক্যারেটের। এই সোনার বারের ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ বিশুদ্ধ। বিশুদ্ধ সোনা অপেক্ষাকৃত নরম। অলংকার তৈরির সময় নানা পদার্থের খাদ মেশানো হয়। এর ওপর নির্ভর করে ২২ ক্যারেট (৯১.৬০ শতাংশ বিশুদ্ধ), ২১ ক্যারেট (৮৭.৫০ শতাংশ বিশুদ্ধ) স্বর্ণালংকার হয়ে থাকে।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনার মো. ফখরুল আলম একুশে পত্রিকাকে বলেন, আগে এত বেশি সোনা দেশে আসেনি। দেশে হঠাৎ করে সোনার চাহিদা তৈরির বিষয়টি আমাদের ভাবাচ্ছে।