বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ওষুধের দামে আগুন ডাক্তারের উপহারে—দেখেই জ্বলে উঠলেন নোমান খালেদ

প্রকাশিতঃ ২৯ মার্চ ২০২২ | ৪:৪৭ অপরাহ্ন


জোবায়েদ ইবনে শাহাদাত : সাপ্তাহিক একুশে পত্রিকায় ওষুধের দামে আগুন ডাক্তারের ‘উপহারে’ শীর্ষক প্রধান প্রতিবেদনটি দেখেই তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী।

ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি বললেন, ‘ডাক্তাররা উপহার নেয়, এ কারণেই ওষুধের দাম বেড়েছে? চরম বাজে নিউজ, বাজে পত্রিকা। এই নিউজ কে করেছে? এত বড় স্পর্ধা কার? তার নামে মামলা করা উচিত।’

আজ মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে এ ঘটনা ঘটে।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে রাঙ্গুনিয়ার বাসিন্দা দিদারুল আলম পাইলট একুশে পত্রিকাকে বলেন, “আমার একজন অসুস্থ আত্মীয়কে চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাই। চিকিৎসকরা জানান, তাকে সুস্থ করতে হলে জটিল অস্ত্রোপচার করতে হবে। এজন্য ডা. নোমান খালেদ চৌধুরীর অনুমতি লাগবে। বিষয়টি যাতে আন্তরিকভাবে দেখা হয়, সেজন্য ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমানের (স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক) সহযোগিতা চান আমার মামা একুশে পত্রিকা সম্পাদক আজাদ তালুকদার।”

“এরপর আজ সকালে ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান চমেক হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কাছে পাঠান। ওই চিকিৎসক আমাদেরকে বলেন ডা. নোমান খালেদের কাছে যেতে। ওনার কাছে যাওয়ার পর ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান পাঠিয়েছেন বলি। এছাড়া আমার মামা একুশে পত্রিকার একটি সৌজন্য কপি পাঠিয়েছেন বলে সেটাও তুলে দিই। পত্রিকার কপিটি হাতে নিয়েই তিনি ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষায় কথা বলা শুরু করেন। সাপ্তহিক একুশে পত্রিকার লিড নিউজটি দেখেই তিনি রেগে গেলেন; বললেন, ডাক্তাররা উপহার নেয়, এ কারণেই ওষুধের দাম বেড়েছে? চরম বাজে নিউজ, বাজে পত্রিকা। এগুলো করেছে কে? এত বড় স্পর্ধা কার? তার নামে মামলা করা উচিত।”

পাইলট বলেন, “একুশে পত্রিকার প্রথম পাতায় আরেকটি নিউজের শিরোনাম ছিল- বেসিসের পুরস্কার পেলেন চট্টগ্রামের পুত্রবধূ ডিআইজি আমেনা বেগম। শিরোনামটি পড়ে ডা. নোমান খালেদ বললেন, ‘আমেনা আমার ছোট বোন। আমেনাকে এখন ফোন করলে সাথে সাথে মামলা হবে।’ নিউজের আরেকটি শিরোনাম ছিল- ‘৫ বছর বাঁচতে চেয়েছিলেন শিল্পপতি নাসির উদ্দিন, এক কেমোতেই শেষ!’ একটা কেমোতেই মারা গেছেন, ধকল সইতে পারেননি, তিনি ৫ বছর বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন, এসব লেখা ছিল নিউজে। পুরো নিউজ না পড়ে শুধু শিরোনাম দেখেই ডা. নোমান খালেদ বললেন, ‘এক কেমোতেই কী শেষ? এরকম বাজে নিউজ, এটা কি শিরোনাম?”

পাইলট আরও বলেন, “একপর্যায়ে আমার বাড়ি কোথায় সেটি জানতে চাইলেন ডা. নোমান খালেদ। আমি বলেছি রাঙ্গুনিয়ার পদুয়ায়, তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের এলাকায়। তখন ডাক্তার আরও রেগে বলে উঠলেন, ‘তথ্যমন্ত্রীর কথা বললেন কেন? তথ্যমন্ত্রী আমার বন্ধু, আমি কি এখন তাকে ফোন দেব? ডাক্তার সাহেবের রাগ কমানোর জন্য আমি যখন বলেছি, তথ্যমন্ত্রীর একই এলাকায় আমাদের বাড়ি। তিনি উল্টো আরও চার্জ করে বসলেন। এসময় বিএনপি নেতা আবু সুফিয়ান ও হেফাজতের বাবুনগরীর সাথে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বলে দাবি করেন ডা. নোমান খালেদ।

এভাবে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ভাষা ব্যবহার করার পাশাপাশি তিনি বলেন, ‘তোমাদের রোগীর ট্রিটমেন্ট এখানে হবে না, রোগী নিয়ে চলে যাও।’ এসব বলার সময় আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন।”

একটি গণমাধ্যমকে নিয়ে একজন চিকিৎসকের এমন অশোভন, অপ্রত্যাশিত, বিরূপ আচরণ করা কতটুকু যৌক্তিক জানতে চাইলে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ-স্বাচিপ এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এটা তো খুবই দুঃখজনক। এ রকম করার তো কোনও কারণ নেই। এটা তো সমর্থনযোগ্য নয়।’

পুলিশের ডিআইজি আমেনা বেগমকে ‘ছোট বোন’ দাবি করেছিলেন ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী; এ বিষয়ে ডিআইজি আমেনা বেগমের স্বামী সানিয়াত লুৎফীর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘নোমান খালেদ নামের কোনও চিকিৎসক আমাদের বা আমেনা বেগমের আত্মীয় নয়। আমাদের নাম যদি কেউ বিক্রি করে এটা খুব দুঃখজনক। আমরা চাইলে এ বিষয়ে জিডি, মামলা করতে পারি।’

ওষুধের দামে আগুন ডাক্তারের ‘উপহারে’– শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটিতে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ তুলে ধরা হয়েছে; এটি ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি এর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপের আওতায় তৈরি করা হয়। এরকম একটা প্রতিবেদন নিয়ে সমালোচনা করতে হলে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে করা উচিত। কিন্তু পুরো অনুসন্ধানী প্রতিবেদনটি না পড়ে শুধু শিরোনাম দেখেই ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এ চিকিৎসকের এমন কাণ্ডে এখন প্রশ্ন উঠছে, ওই নিউজে ওনার জ্বলে উঠার কারণ কী? তাহলে কী ওষুধ-ডাকাতির জন্য তিনিও দায়ী? উপহার নিয়ে তিনিও ওষুধের দাম বাড়ান?

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরীর মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি এসব অভিযোগের বিষয়ে সদুত্তর দেননি। তিনি বলেন, ‘কারও সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য আমি কখনো করি না। আমি শোনা কথা নিয়ে মন্তব্য করি না। এটা নিয়ে আর কিছু বলতে চাচ্ছি না।’

চিকিৎসা দেবেন না বলেছিলেন– এমন প্রশ্নে অধ্যাপক ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ পর্যন্ত কোনওদিন আমি বলিনি, আমার এখানে চিকিৎসা হবে না। বরং যদি কোথাও কোনও চিকিৎসা না হয়, আমার যদি ক্ষমতা থাকে, করে দিই। আমার বাড়ি চট্টগ্রাম। চট্টগ্রামের মানুষের ওপর আমার হক আছে। আমার ওপরও চট্টগ্রামের মানুষের হক আছে। আমি সততার সাথে এই হকটা পরিশোধ করার চেষ্টা করছি। মানুষ যদি চিকিৎসা না পায়, তাহলে আমার প্রয়োজন কী, হাসপাতালের প্রয়োজন কী?’

অভিযোগগুলোর বিষয়ে আবার জানতে চাইলে তিনি সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেন, ‘আমি এসব কথা এড়িয়ে চলি। হ্যাঁ, আমি মাঝে মাঝে শক্ত কথা বলি, যখন দেখি রোগী পাচার করার চেষ্টা করতেছে, কাউকে যদি সন্দেহ করি, কোন অনিয়ম দেখি, সেখানে একটু খারাপ ব্যবহার করি। আমি তো সব মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারি না। অতটুকু ক্ষমতা নেই। ভুল-ক্রুটির ঊর্ধ্বে কেউ নয়, সেটা দেখিয়ে দিলে সংশোধন হতে পারি।’

একুশে পত্রিকার প্রতিবেদন সম্পর্কে অপ্রীতিকর মন্তব্য করেছিলেন কিনা আবার জানতে চাইলে সদুত্তর না দিয়ে ডা. নোমান খালেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ করি না। আমার সঙ্গেও কেউ যদি খারাপ ব্যবহার করে, আমি অভিযোগ করি না। তবে মানুষ হিসেবে হয়তো আমি সবসময় নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারি না।’

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ দুঃখজনক। ডা. নোমান খালেদের সঙ্গে আমি এ বিষয়ে কথা বলবো।’

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. হাসান শাহারিয়ার কবির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ডা. নোমান খালেদ একজন প্রথিতযশা চিকিৎসক। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ আমি কখনো শুনিনি। যদি তিনি এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন, সেটা অবশ্যই উচিত হয়নি। চিকিৎসা প্রার্থী যেই হোক না কেন চিকিৎসককে সেবা দিতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কী বিষয় তাকে সংক্ষুব্ধ করলো সেটা জানার জন্য তার সাথে আমি কথা বলবো। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আমাকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ বা আপত্তি জানালে আমি ব্যবস্থা নেব।’