রেহানা বেগম রানু : ছোটকাল থেকে ইচ্ছে ছিল মানুষের জন্য কাজ করবো। যেখানেই যে সেক্টরে কাজ করি না কেন তা হবে জনকেন্দ্রিক। এই সুপ্তইচ্ছা পূরণের জন্য শুরু হয় সুন্দরের সঙ্গে পথচলা, উঠাবসা। খেলাঘর করেছি সেই তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ার সময়।
এখনকার শিশুদের মতো প্লে-নার্সারি কিংবা প্রথম শ্রেণী থেকে ধারাবাহিক পড়াশোনা আমার হয়ে উঠেনি। সরাসরি ক্লাস থ্রিতে ভর্তি হই। বলা যায়, যখন বর্ণমালা চিনছি, শিখছি তখনই হেঁটেছি সুরের পথে। জলছবি খেলাঘরের সুবাদে ফুলকিতে নিয়মিত, মাঝে মাঝে শিল্পী নিকেতনে সুরচর্চায় মেতেছি।
মুসলিম হল, শিল্পকলা, শিশু একাডেমি, বিশেষ বিশেষ দিবস, আনন্দমেলা, পহেলা বৈশাখসহ সংস্কৃতির নানান ভেন্যু, শাখা-প্রশাখায় ঘুরে বেড়িয়েছি।
অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থী থাকাকালে ত্রিতরঙ্গ ভেঙে একটা অংশের (চুনিলাল) গড়া সুরাঙ্গনে যুক্ত হই। দেশাত্মবোধ, মা, মাটি, স্বদেশের প্রতি নিজেকে উৎসর্গ করার ইচ্ছেটি এসময় তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। মানবিক মানুষ হওয়া, মানুষের জন্য কল্যাণ করার নেশায় বুঁদ হই আমি।
এসএসসি পাশ করে কলেজে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গে আমার চিন্তা ও কাজের জগত বেড়ে যায়। দেশজুড়ে শুরু হয় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের দামামা। সেই আন্দোলনের আমি একজন সাধারণ যোদ্ধা। আগ্রাবাদ মহিলা কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী আমি। স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করতে কলেজে ছাত্রলীগের কমিটি গঠনের উদ্যোগ নিই।
ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি সাংস্কৃতিক ও রাজপথের আন্দোলনে। ‘নতুন বাংলাদেশ গড়বে বলে ছাত্রমিছিলে ট্রাক চাপালে’, ‘কারার ঐ লোহ কপাট’, ‘এই লড়াই বাঁচার লড়াই, এই লড়াইয়ে জিততে হবে’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি’, ‘তীর হারায়ে ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’সহ নানা জাগরণী সংগীতে মুখর হয়ে উঠে চট্টগ্রামের রাজপথ। সেই রাজপথের আমি নিত্যকর্মী। নাটকে-গানে রাজপথে সক্রিয় হতে গিয়ে দেখা মেলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা জননেতা আবদুল্লাহ আল নোমান, এম এ মান্নান ও এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে। কাজীর দেউড়ি, লালখানবাজার, লালদিঘী, নিউ মার্কেটসহ নগরীর বিভিন্ন স্পট জনসভা, জনসংগীত আর ট্রাকমিছিলে সরব থাকতো সকাল থেকে রাত। এসব আন্দোলনে যুক্ত হয়ে গানে গানে সাধারণ মানুষকে উজ্জীবিত করি।
সমাবেশে নেতারা আসবেন, বক্তৃতা করবেন। তাদের বক্তৃতা শোনার জন্য গণজমায়েত ধরে রাখতে কখনো গেয়েছি জাগরণী গান, কখনো করেছি বক্তৃতা। অনুষ্ঠান উপস্থাপনাও করেছি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালায়।
চট্টগ্রামে আউটার স্টেডিয়ামে ’৮৯ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিজয়মেলায় সম্পৃক্ত হই সাংস্কৃতিক কর্মসূচির মধ্যদিয়ে। সেখানে যুক্ত হই গান ও উপস্থাপনার সঙ্গে।
জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রাম কলেজে আবদুল্লাহ আল মামুনের ‘অরক্ষিত মতিঝিল’ মঞ্চস্থ হবে। নায়িকা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য চট্টগ্রাম ও মহসীন কলেজের কেউ রাজি হচ্ছিল না।
আগ্রাবাদ কলেজের বান্ধবী রুনু একদিন জানালো, শিবিরের ভয়ে নায়িকা চরিত্র খুঁজে না পাওয়ায় চট্টগ্রাম কলেজে একটি নাটক হতে পারছে না। জামায়াত-শিবিরের রোষানল কিংবা টার্গেটে পরিণত হতে পারে সেই আশংকায় কোনো মেয়ে নাটকটিতে অভিনয় করতে রাজি হচ্ছে না। বললাম, আমিই করবো সেই নাটক। দেখি শিবির আমাকে কী করে! আয়োজকদের সাথে কথা হলো, ঠিক হলো। আমার অভিনয়ে যথারীতি সেই নাটক মঞ্চস্থ হলো। বাহবা পেলাম অনেকের।
’৯৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের সভানেত্রী নিলুফার কায়সারের সঙ্গে প্রথমে পরিচয়, তারপর সখ্যতা গড়ে উঠে। তার সঙ্গে মহিলা লীগের নানা সভা-সমাবেশে আমি নিয়মিত পার্টিসিপেন্ট। আমাকে ’৯৬ তে ডবলমুরিং থানা মহিলা লীগের আহ্বায়ক করেন তিনি। এরপর নিয়মিত মহানগর মহিলা লীগের সভা-সমাবেশ অর্গানাইজ করার দায়িত্ব দিতেন আমাকে। মহিলা লীগের অনুষ্ঠানের প্রেসরিলিজ তৈরি করে সংবাদপত্রে পাঠানো, বিভিন্ন দিবস সামনে রেখে অনুষ্ঠান সাজানোর কাজটা আমাকেই করতে হতো। ’৯৮ সাল থেকে একাধিকবার মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলায় মহিলা উপ পরিষদের সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করি।
’৯৮ সালে চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের দপ্তর সম্পাদের দায়িত্ব পাই। ২০০০ সালে দ্বিতীয় সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ উপলক্ষে ’৯৯ সালের শেষের দিকে নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমা হিলের বাসভবনে একটি মহিলা সমাবেশের আয়োজন হয়।
সমাবেশে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সংরক্ষিত আসনে কারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক তা নিয়ে আলোচনা হয়। মহিউদ্দিন চৌধুরী সেখানে বক্তৃতা দিতে বলেন আমাকে। বক্তৃতার একপর্যায়ে তিনি বলেন, আমার সম্পর্কে বলতে।
আমার মাস্টার্স এবং এলএলবি তখন শেষ পর্যায়ে। প্রকাশনা ও বইয়ের ব্যবসা আমার। আছে হ্যান্ডিক্র্যাফটসের যৌথ ব্যবসা। এটুকু বলার পর মাঝপথে আমাকে থামালেন নূরজাহান বারী (মহানগর মহিলা লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক)। বললেন, মহিউদ্দিন ভাই ও (আমি) কিন্তু ভালো গানও করে। গতকাল টিভিতে তার গান শুনেছি। এই তুমি এটা বলছো না কেন নূরজাহান আপা বললেন আমাকে। একথা শুনে মহিউদ্দিন চৌধুরী ডাক দিলেন তার এপিস শমসেরকে। তাকে দিয়ে তৎক্ষণাৎ হারমোনিয়াম আনালেন।
আমি খালিগলায় গাইতে চাইলে তিনি বললেন, হারমোনিয়াম ধরো। একটা নয়, দুটি গানই করতে হলো। বোঝা গেলো গান ভালোবাসেন তিনি। গান শোনার পর বললেন, তুমি নির্বাচন করবে। আমি! বামে-ডানে তাকাচ্ছিলাম। ভাবলাম আমাকে নয়তো! হ্যাঁ তোমাকেই বলছি, তুমিই নির্বাচন করবে।
আমি হ্যাঁ-না কিছু না বলে সেদিন বাসায় চলে গেলাম। বাসায় পৌঁছতে না পৌঁছতে একের পর এক ফোন আসতে থাকে মা’র বাসায়। সবাই অগ্রিম অভিনন্দন, সাধুবাদ জানাচ্ছেনÑ আপনি তো নমিমেশন পেয়ে গেলেন। কমিশনারও হয়ে যাবেন। কেউ কেউ দুষ্টুমীও করলেন। বলেন, হুজুরকে (মহিউদ্দিন চৌধুরী) গান শুনিয়ে মনোনয়ন পেয়ে গেলেন!
বলে রাখি, আমার সাংগঠনিক কর্মকা-, বেড়ে উঠা, পড়াশোনা, ডোর টু ডোর কানেকশন সবই দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ড ঘিরে। নির্বাচন করলে এই ওয়ার্ড থেকে করবো সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেখানে বাঁধ সাধেন যিনি আমাকে নির্বাচন করতে অনুপ্রাণিত করলেন সেই মহিউদ্দিন চৌধুরীই। বলেন, ‘তুমি নির্বাচন করবে উত্তর আগ্রাবাদ থেকে। দক্ষিণে আমার প্রার্থী আছে।’
শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লাম। ওমা! কী বলেন মহিউদ্দিন ভাই। আমার নাড়ির সম্পর্ক যেখানটায়, ভিত্তিমূল যে ওয়ার্ডে, সেই ওয়ার্ডে নয় আমাকে নির্বাচন করতে বলছেন উত্তর আগ্রাবাদ থেকে। মহিউদ্দিন ভাই হয়তো ভুলেই গেছেন আমি দক্ষিণ আগ্রাবাদের ভোটার এবং এখানেই আমার সবকিছু। বিষয়টা জানতে পারলে হয়তো তার ভুল ভাঙবে। সে আশায় ফরম সংগ্রহ করি দুই ওয়ার্ড (উত্তর ও দক্ষিণ আগ্রাবাদ) থেকে। পরে জানলাম তিনি জেনে-বুঝেই আমাকে উত্তর আগ্রাবাদে প্রার্থী হতে বলছেন।
মূলত সাধারণ আসনে তার এক ঘনিষ্ঠ প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বি হতে চান আবুল কালাম কালাম বি.এসসি। ঘনিষ্ঠ প্রার্থীর পথ নির্বিঘœ রাখতে মহিউদ্দিন চৌধুরী কৌশলে আবুল কালামকে সরিয়ে দিতে চান। বলেন, তুমি এবার নির্বাচন করো না। তোমার বউ করুক। নেতার কথায় নির্বাচন থেকে সরে গেলেন কালাম ভাই। দক্ষিণ আগ্রাবাদ এলাকায় সংরক্ষিত আসনে প্রার্থী হলেন তার স্ত্রী আফরোজা কালাম। রাজনীতির এই কৌশলে দুই ওয়ার্ডে ফরম নিয়েও শেষপর্যন্ত উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে নির্বাচন করতে বাধ্য হলাম। ২৪ নং উত্তর আগ্রাবাদ, ২৩ নং পাঠানটুলি, ১২ নং সরাইপাড়া ওয়ার্ড নিয়ে আমার সংরক্ষিত ওয়ার্ড। কিন্তু এখানেই শেষ নয়।
দক্ষিণ আগ্রাবাদের গণমান্য লোকজন তাদের প্রার্থী হিসেবে আমাকে চাইছেন। তাই আফরোজা কালাম ফরম জমা দিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে শুরুতেই বাধাগ্রস্ত হন। স্থানীয় অধিবাসী কেন্দ্রীয় যুবলীগের তৎকালীন প্রেসিডিয়াম মেম্বার আলতাফ হোসেন বাচ্চু, যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির তৎকালীন সদস্য জাফরুল হায়দার সবুজসহ অনেকেই আফরোজা কালামকে সাফ জানিয়ে দেন রানুই এখানে নির্বাচন করবে। তার জন্য আমরা কাজ করবো। আফরোজা কালাম তার স্বামীসহ একদিন আমার বাসায় এসে হাজির। বলেন, যেখানেই যাচ্ছি আপনার কথাই আসছে, বলছেন আপনাকেই তারা ভোট দেবেন। আপনি উইথড্র না করলে আমি এখানে কীভাবে নির্বাচন করবো। আকুতি ঝরে পড়ে আফরোজা কালামের।
বললাম, ঠিক আছে মহিউদ্দিন ভাইও যেহেতু চাচ্ছেন আমি উত্তর আগ্রাবাদেই নির্বাচন করবো। দক্ষিণ আগ্রাবাদ থেকে প্রত্যাহার করলাম। ফরম যাচাই-বাছাইয়ের দিন জেলা পরিষদ প্রাঙ্গণে নগর আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. আফছারুল আমীনের সঙ্গে দেখা হয়। আমি কোন এলাকা থেকে নির্বাচন করছি তিনি জানতে চান। বললাম, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ৯। জানতে চান কোন কোন ওয়ার্ড। উত্তর আগ্রাবাদ, উত্তর পাঠানটুলি, সরাইপাড়া- সঙ্গে সঙ্গে আফছার ভাই বললেন, উত্তর পাঠানটুলি হলো ‘মিনি পাকিস্তান’, সরাইপাড়া-উত্তর আগ্রাবাদ বিএনপি জোন। তুই-ই ত হড়আর ভিতর যাই ফইরতা লাইগ-গো (তুমি তো খড়ার মধ্যে পড়তে যাচ্ছো)। যোগ করেন আফছার ভাই। জবাব দিলাম, চা-ই না হড়আর মইধ্যে বান ডাকিত ফারি ন্যে (দেখি না খড়ার মধ্যে বন্যা ডাকতে পারি কিনা)।
এরপর দৃঢ়চেতা মন নিয়ে নেমে পড়লাম নির্বাচনী মাঠে। নেমেই মানুষের ব্যাপক সাড়া। আগ্রাবাদের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল ইব্রাহিমের উত্তর আগ্রাবাদে বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। ইব্রাহিম ভাই ও আমার ভগ্নিপতি আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল নূর, উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের কমিশনার প্রার্থী মোহাম্মদ সোলায়মানের নিরঙ্কুশ সমর্থন ও সহযোগিতা নির্বাচনী মাঠে আমাকে বেশ এগিয়ে দেয়।
নির্বাচনী প্রচারণার জন্য সময় পাই মাত্র ১৩ দিন। কিন্তু এই অল্প সময়ে যেখানেই যাচ্ছি দলমত নির্বিশেষে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাবেক সংসদ সদস্য প্রবীণ আওয়ামী নেতা ইসহাক মিয়া, তৎকালীন যুবলীগ নেতা সৈয়দ মাহমুদুল হক, উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের সভাপতি মুন্সী মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা ফিরোজ ভাই, আওয়ামী লীগ নেতা সামাদ ভাই, অধ্যাপক আব্দুল বাকি, মুনমুন কমিউনিটি সেন্টারের মালিক ইসলাম, পানওয়ালা পাড়ার হাজী আব্দুস সালাম, সাত্তার হাজী, সমাজসেবক আলী ফজল, মুহুরীপাড়ার প্রয়াত রাজামিয়া সওদাগর, চৌমুহনীর প্রয়াত ইউসুফ মিয়া, সরদার আজিজ ১২ নং মিস্ত্রিপাড়ার জেঠা রফিক, আওয়ামী লীগ নেতা ছুট্টু মিয়া, আওয়ামী লীগ নেতা সাবের সওদাগর, উত্তর আগ্রাবাদের সমাজসেবক শামসু ভাই (আনন্দিপুর), কমিশনার এসএম জাফর, ২৩ নং ওয়ার্ডের কমিশনার প্রার্থী হাজী জহুরুল হক, অধ্যাপক নজরুল (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী), পাঠানটুলি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি দোস্ত মোহাম্মদ, প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান ভাই, আসিফ খান, জসিম চিশতি, ১২ নং সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যাপক আসলাম (পরে কমিশনার), পাহাড়াতলী থানা আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রয়াত শেখ জমির, জেঠা রফিকসহ আওয়ামী পরিবারের অনেকের সহযোগিতা যেমন পেয়েছি, তেমনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছেন বিএনপি নেতা ও সদ্য প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা ফরিদ খান (বাঘা নানা), কমিশনার শামসুল আলম, বিএনপি নেতা বাবুল হক (পরে কমিশনার), বিএনপি নেতা সফি সরদার (পানওয়ালাপাড়া), বিএনপি নেতা জহির সর্দার (পাঠানটুলি), সাবেক কমিশনার ইসহাক (মৌলভীপাড়া), সমাজসেবক হাশেম, খুরশীদ মেম্বার, প্রয়াত বিএনপি নেতা শফি (ঈগল হেলথ ক্লাব), কমিশনার নিয়াজ মোহাম্মদ খান, বিএনপি নেতা সাইফুল আলম, ফাতেমা বাদশাসহ দলমত নির্বিশেষে আমার পক্ষে কাজ করেছেন। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা, নিরঙ্কুশ সমর্থন নির্বাচনী মাঠে আমাকে নানা প্রতিকূলতা ডিঙাতে সাহায্য করে।
এদিকে প্রচারণা চালাতে গিয়ে প্রতিদিন নিত্যনতুন সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। অপপ্রচারের জাল বিস্তৃত হয়ে আছে চারপাশে। বলা হয়, আমি আমেরিকা থাকি। ভোট দিলে মানুষ আমাকে খুঁজে পাবে না। ভোট নিয়ে আমেরিকা চলে যাবো। এরপর বলা হলো বইংগা (চট্টগ্রামের বাইরের অঞ্চলের মানুষ)।
কমিশনার প্রার্থী অধ্যাপক আসলামের এক নির্বাচনী সমাবেশে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হলো। গিয়ে দেখি আমার নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী আইনুন নাহারও সেখানে উপস্থিত। সেদিন আমাদের প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমার প্রতীক কলসী। আইনুন নাহারের প্রতীক সেলাই মেশিন। সমাবেশে উপস্থিত গণমান্যদের দাবি, সংরক্ষিত আসনের দুই প্রার্থীকে বক্তৃতা করতে হবে। আইনুন নাহারের পক্ষে সেলিম মিয়া বক্তব্য রাখেন। উপস্থিতজনরা জানান, তারা প্রার্থীর বক্তব্য শুনবেন।
আইনুন নাহার বক্তব্য রাখেন। বলেন, তার মার্কা সেলাই মেশিন। গরীবদুঃখী নারীদের জন্য তিনি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন। সেলাই শেখাবেন। তাকে সবাই যেন ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করে।
এরপর আমার পক্ষে ডা. আফছারুল আমীনের (পরে মন্ত্রী) শ্যালক বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী কামরুল ভাই বক্তৃতা দিতে প্রস্তৃতি নেন। যথারীতি উপস্থিত লোকজন আমার কথা শুনতেই আগ্রহী। এ অবস্থায় কামরুল ভাই ও আমার ভগ্নিপতি আবদুল নূর কিছুটা নার্ভাস এই ভেবে, আমি অপ্রস্তুত, নতুন মানুষ- কী বলতে কী বলে ফেলি। তাদের আশ্বস্ত করি, বলি, মানুষ যখন চাচ্ছে আমিই বলি।
মাইকে আমার নাম ঘোষণা হলো। মুরুব্বিদের শ্রদ্ধা ও সালাম জানিয়ে শুরু করলাম- ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীকে শুভেচ্ছা জানাই। নির্বাচনে আমি প্রথম দাঁড়িয়েছি। আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই। আমি আপনাদের সঙ্গে কোনো ওয়াদা করবো না। ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা ভঙ্গ করার মতো কোনো মানসিকতা আমার নেই।
আমাদের কী কাজ আমি জানি না। আমার প্রতীক কলসী। আমার কলসী যদি আপনাদের দোয়ায় কানায় কানায় পূর্ণ হয়, আমি জয়ী হয়ে আপনাদের সাধ্যমত সেবা দেয়ার চেষ্টা করবো। এখানে আমার বোন আইনুন নাহার আপা রয়েছেন। প্রতিযোগিতায় হারজিত থাকে। আমরা দুই প্রার্থী এখানে উপস্থিতি আছি। আপনারা বিচার-বিবেচনা করে যে রায় দেবেন সে রায়কে আমি শ্রদ্ধা জানাব। আপনাদের ভোটে আমার বোন (প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী) যদি জয়ী হয় আমি তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো।’
এরপরও পুরো নির্বাচনী মাঠে মাদ্রাজি, নন বেঙ্গলি, বইংগা-এসব অপপ্রচারের জবাব দিতে গিয়ে কোথাও কোথাও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে প্রমাণ করতে হয়েছে আমি চট্টগ্রামের মানুষ। এমনকি আমার খালার কাছে গিয়েও আমাকে বইংগা বানাতে কুণ্ঠা করেননি প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী।
উত্তর আগ্রাবাদ চারিয়াপাড়ার সমাজসেবক শাহজাহান ও রফিক ভাই। রোজা-রমজানের দিন। এলাকায় গণসংযোগে দেখা। তারা বললেন পরবর্তী গণসংযোগে তাদের বাসায় ইফতার করতে হবে। পরে কোনো এক গণসংযোগ শেষে কর্মী-সমর্থকসহ শাহজাহান ভাই ও রফিক ভাই আমাকে ইফতার করতে বাসায় নিয়ে যান। কিছুক্ষণ পর সমর্থকদের নিয়ে সেখানে প্রবেশ করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আইনুন নাহার। আমরা ভেতরের কক্ষে চুপচাপ বসে আছি। তখন নিজের কানে শুনতে পাই নতুন ও অদ্ভুত এক অপপ্রচার। প্রতিদ্বন্দ্বীকে পাশে রেখেই তার এক নারী সমর্থক বলতে লাগলেন, আমি নাকি আমেরিকায় থাকি। ভোট নিয়ে আমেরিকা চলে যাবো। এলাকার লোক আমাকে পাবে না- বলেই তিনি স্থানীয় লোক, তাকে যে কোনো সময় পাওয়া যাবে, তাই তাকে যেন ভোটটা দেওয়া হয়। নির্বাচনে জেতার জন্য মানুষ কী ধরনের মিথ্যাচার করতে পারে তা কাছ থেকে দেখলাম।
সরাইপাড়ায় গণসংযোগে গিয়ে এলাকার নাট্যব্যক্তিত্ব আব্দুস সালাম মাস্টারের অপত্য স্নেহ ও শুভাশীষ পেয়েছি। তিনি আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করেন, বলেন তুমি বিপুল ভোটে জিতবে। তার দোয়া নিয়ে আলী ফজল নানাসহ বের হতেই দেখা পাই তার সন্তান প্রয়াত অ্যাডভোকেট জুনাইদুস সালাম বুলবুলের। থলে হাতে বাজার থেকে ফিরছিলেন তিনি। তাকে উইশ করার সঙ্গে সঙ্গে বললেন, আপনি কি নির্বাচন করছেন? বললাম, নির্বাচন করছি বলেই তো আপনার বাবার দোয়া নিয়ে এলাম। বুলবুল ভাই অনুশোচনা করলেন। বলেন, আমি তো আপনার প্রতিদ্বন্দ্বীকে কথা দিয়েছি তার জন্য কাজ করবো। এখন আমি কী করি। নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলাম।
ক্ষাণিক পর পত্রিকান্তরে আমার প্রকাশিত বিভিন্ন লেখার প্রসঙ্গ তুলে বললেন, তিনি আমার লেখার একনিষ্ঠ, দৈনিক আজাদীতে নিয়মিত পড়েন আমার লেখা। তখন সবে আমি এলএলবি পাশ করেছি। সেটা তিনি জানতেন- সেদিক দিয়েও একই ঘরানার। আমার গানের জগত, সৃজনশীল কাজের খবরও রাখতেন তিনি। এসব প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেন, আপনার মতো একজন মানুষ জনপ্রতিনিধি হলে আমরাই ভাগ্যবান হবো, এলাকার উন্নয়ন হবে- বলেই জীবনে এই প্রথম ওয়াদা ভঙ্গ করবো। আমার সঙ্গে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং বাজারের থলেটা পরিচিতজনের হাতে দিয়ে আমাদের সঙ্গে গণসংযোগে মিলে গেলেন বুলবুল ভাই।
টানা ১৩ দিন নির্বাচনী গণসংযোগ শেষে নির্বাচন হলো। এলাকার মানুষ বিপুল ভোটে আমাকে কমিশনার নির্বাচিত করলেন। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ৪১টি ওয়ার্ডের মধ্যে আমি সর্বোচ্চ ভোট পেলাম। স্থানীয় পত্রিকায় এ নিয়ে আলাদা শিরোনামে নিউজ হয়। নানা জায়গা থেকে অভিনন্দন আসতে থাকে। এলাকার লোকজন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিশাল বিজয় মিছিল করে। পুরো নগরে সর্বাধিক ভোটে বিজয়ী হওয়ার খবর পত্রিকায় দেখে যুবলীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম মেম্বার আলতাফ হোসেন বাচ্চু পরদিন সকালে আমার মার বাসায় (যেখানে আমি থাকতাম) এসে হাজির হন, শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।
আমার ভগ্নিপতি আব্দুল নূর, আমার নির্বাচনী প্রস্তাবকারী জাকির হোসেন জাকু মামা, আব্দুল্লাহ আল ইব্রাহিম, মোজাম্মেল ভাই, কামরুল ইসলামসহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে নবনির্বাচিত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর চশমা হিলের বাসায় যাই। মেয়র আমাদের অভ্যর্থনা জানান। আমার নির্বাচনী ফলাফলে উচ্ছ্বসিত তিনিও। উপস্থিত লোকজনের মুখে মুখে তখন আমার সর্বোচ্চ ভোট পাওয়ার বিষয়টি। জাকু মামা আমার জয়ের প্রসঙ্গ টেনে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে বললেন, আমার খালা (আমি) তো সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জিতলেন। মহিউদ্দিন চৌধুরী জবাব দেন, এখন তো কমিশনার হলো, ভবিষ্যতে সে মেয়র হবে।
এরপর বিভিন্ন সময় দারুল ফজল মার্কেটে দলীয় সমাবেশে মহিউদ্দিন চৌধুরী নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ প্রেসিডন্টে-সেক্রেটারির সামনে ছোট বোন সম্বোধনে আমার প্রশংসা করতেন। আমি ভালো বলি, বেশি ভোট পেয়েছি এসব উল্লেখ করে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দিতেন। বলাবাহুল্য, সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া, চৌধুরীর প্রশংসা ও সুনজর পরবর্তীতে ব্যক্তি বিশেষের চক্ষুশূলেও পরিণত হয়েছিলাম।
সেই যাই হোক, এবার শপথ গ্রহণের পালা। নবনির্বাচিত মেয়র, ৪১টি ওয়ার্ডের ৫৪ জন নির্বাচিত কমিশনার সবাই একসঙ্গে শপথ গ্রহণের জন্য ঢাকা যাই। আমাদের জন্য হোটেল আশরাফীর রুম ভাড়া করা হলো। হোটেলে একদিন অবস্থান করে তৎকালীন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী জিল্লুর রহমানের কাছে আমরা শপথ গ্রহণ করি। এরপর ধানম-িতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে নির্বাচনী এলাকায় ফিরে আসি। এসেই দেখি চারদিকে সংবর্ধনার জোয়ার। দেওয়ানহাট মোড়ে মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী, পাঠানটুলি ওয়ার্ডের নির্বাচিত কমিশনার আলহাজ্ব এসএম জাফর ও আমাকে সংবর্ধনা দেয় পাঠানটুলি এলাকাবাসী। এরপর আমার তিন ওয়ার্ডের পক্ষ থেকে পৃথকভাবে, রোটারী ক্লাব ও মমতাসহ নানা সংগঠন আমাকে সংবর্ধিত করে।
শপথ গ্রহণের পর এলাকার মানুষ আসতে শুরু করে তাদের নানাবিধ সমস্যা নিয়ে। জাতীয়তা সনদ, ওয়ারিশান সনদের পাশাপাশি রাস্তাঘাট, নালা-নর্দমার উন্নয়নের দাবিতে মানুষের লাইন বাড়তে থাকে একজন নির্বাচিত কমিশনারের কাছে। একবুক আশা নিয়ে তারা আসেন, আশাহত হয়ে ফিরে যান। এলাকাবাসীকে সনদ দেওয়া ও উন্নয়ন কর্মকা-ে সম্পৃক্ত হতে না পারার যন্ত্রণা নিয়ে সিটি করপোরেশনের সাধারণ সভায় অনুমতি সাপেক্ষে মাননীয় মেয়রের কাছে জানতে চাই, মাননীয় মেয়র আমরা তিনটি ওয়ার্ড থেকে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এলাকাবাসীকে আমাদের সেবা দিতে হবে।
আমাদের কাছে প্রতিদিন মানুষ জাতীয়তা ও ওয়ারিশান সনদ নিতে আসে। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ও নালা-নর্দমা সংস্কারের জন্য আসে। কিন্তু আমরা কোনোটাই করতে পারছি না। আমরা এলাকার মানুষকে সেবা দিতে চাই। আপনার নেজারত শাখা থেকে আমাদেরকে জাতীয়তা সনদের বই সরবরাহ করা হোক।
মেয়র বলেন, আপনাদেরকে আইন এসব কিছুই দেয়নি। বললাম, তাহলে আমাদের কী কাজ! তিনি বললেন, আপনাদের কোনো কাজ নেই। সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে জিএম-এ আসবেন, খাওয়া-দাওয়া করবেন তারপর চলে যাবেন।
ও মা এ কেমন কথা! ভীষণ হতাশ হই মেয়রের কথায়। বাসায় এসে ভাবি, মানুষের ভোট নিলাম, কিন্তু তাদেরকে কোনো সেবা দিতে পারব না তা হতে পারে না। না, একটা উপায় আমাকে অবশ্যই বের করতে হবে।
মানুষকে নির্বাচনের সময় কোনো ওয়াদা দিইনি। কিন্তু আমাকে জয়ী করলে সেবা দেওয়ার চেষ্টা করবো বলেছিলাম। কথাগুলো বার বার আমার মাঝে প্রতিধ্বনি হতে থাকে। আইন আমাদের অধিকার দেয়নি-মেয়র সাহেবের কথাটিও বারবার বাজতে থাকে। গেজেট বের করে মনোযোগ দিয়ে পড়ি। সিটি করপোরেশন ম্যানুয়েল পড়ি। গেজেটে দেখতে পাই, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি মানেই সনদপত্র ইস্যু করতে পারবেন।
পরবর্তী সাধারণ সভায় গিয়ে মেয়রকে অ্যাড্রেস করে বলি, মাননীয় মেয়র আপনি গত জিএম-এ বলেছিলেন আইন আমাদের সনদপত্র দেওয়ার অধিকার দেয়নি। আমি গেজেট পড়ে দেখেছি। সেখানে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে নির্বাচিত জনপ্রতিধিরা সনদ ইস্যু করতে পারবেন। সঙ্গে সঙ্গে মেয়র গর্জে উঠেন। বলেন, আমাকে আইন দেখাবেন না। মহিলারা কোনো কাজ করতে পারবে না। আমি বলি, মাননীয় মেয়র এটা মিনি পার্লামেন্ট। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে এসেছি তাদের সেবা দেওয়ার জন্যে। আমাদের আগে সংরক্ষিত আসনে সরাসরি ভোটে কমিশনার নির্বাচিত হয়নি। তখন ছিলো সিলেকশন। তাই তারা সনদপত্র দিতে পারত না। আমি প্রথমবারের মতো নির্বাচিত হয়েছি। জনগণের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। আইনে যেহেতু বলা আছে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সনদ দিতে পারবেন। সংরক্ষিত আসন থেকে আমরাও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। এখানে কে সংরক্ষিত, কে সাধারণ ওয়ার্ড সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আমি সনদ ইস্যু করবোই। আপনার নেজারত সরবরাহ না করলেও আমি নিজেই নিজের টাকায় সনদ ছাপিয়ে সনদ ইস্যু করবো।
বলেই জিএম থেকে আমি বের হয়ে যাই। জামালখান ওয়ার্ড কমিশনার অ্যাডভোকেট এম এ নাসের থেকে একটা সনদপত্র সংগ্রহ করে সেই ফরম্যাড অনুযায়ী সনদ ছাপতে দিই। দুদিন পর প্রেস থেকে সনদ ডেলিভারি নিয়ে জাতীয়তা সনদ ইস্যু করতে থাকি।
সংরক্ষিত আসনের অন্য কমিশনারদেরও উদ্বুদ্ধ করি। বলি আপনারাও ছাপিয়ে সনদ দিতে থাকুন। কিন্তু তারা কেউ সাহস করেন না। মহিউদ্দিন চৌধুরীকে ঘিরে তাদের অনেক ভয়। মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর তখন একচ্ছত্র আধিপত্য সিটি করপোরেশন ও পুরো নগরজুড়ে। তিনি দিনকে রাত, রাতকে দিন বললে তাই বলবে সবাই- বিষয়টি যেন মীমাংসিত। জিএম-এ থমথমে ভাব থাকতো সবসময়। ওনি বলবেন সবাই শুনবেন। এ যেন স্বৈরাচারী মনোভাবের অন্যরূপ, ভয়ানক সংস্করণ।
এদিকে, মানুষজনকে কিছুটা সেবা দিতে পেরে আমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি। পরবর্তী জিএম-এ সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদের সব কথাই যেন আমাকে বলতে হবে। সংরক্ষিত আসনের ১৩ জনের ১০ জনই আমি যা বলি তাতে সায় দিতেন। বাইরে থেকে সমর্থন দিতেন।
বাকি ৩ জন মনে মনে সমর্থন দিলেও মেয়রের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতেন না। উন্নয়ন-বরাদ্দে সম্পৃক্ত করার জন্য সংরক্ষিত আসনের কমিশনারগণ জিএম-এ বরাবরই তাদের অধিকারের কথা বলতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করতেন। কেউ কেউ হাতে স্লিপ ধরিয়ে দিতেন।
পরবর্তী জিএম-এ অধিকার নিয়ে আবারও কথা বলি। মেয়রকে বলি, মাননীয় মেয়র, আপনার আন্তরিকতার ছোঁয়ায় আমরা আমাদের ওয়ার্ডে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড করতে চাই। যেহেতু আমাদের তিন ওয়ার্ড, তিনগুণ ভোটার, তিনগুণ মানুষ। সেই হিসেবে আমাদের তিনগুণ বরাদ্দ হওয়া উচিত। তিনগুণ যদি নাও দেন তাহলে প্রাথমিকভাবে সাধারণ ওয়ার্ডের একজন কমিশনার যে বরাদ্দ পাচ্ছেন আমাদেরকে তিন ওয়ার্ড মিলে সেই পরিমাণ বরাদ্দ দিন।
আমার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ওই জিএম-এ সাধারণ আসনের কমিশনারদের ১০ লাখের পাশাপাশি সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদেরও প্রথমবারের মতো দুই লাখ করে তিন ওয়ার্ডের জন্য ৬ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলো।
বরাদ্দ পেয়ে আমরা আনন্দিত হই এই ভেবে, এলাকার উন্নয়নে কিছুটা হলেও অবদান রাখার পথ তৈরি হলো। নির্বাচনের আগে যার বাসায় ইফতার করে গণসংযোগ শুরু করি সেই দোস্ত মোহাম্মদ ভাইয়ের (উত্তর পাঠানটুলি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সভাপতি) খান বাড়ি বাই লেইন, যিনি নির্বাচনের আগে আমার মাথায় হাত রেখে দোয়া করে বলেছিলেন আমি জিতবো, সরাইপাড়া ওয়ার্ডের সেই আব্দুস সালাম মাস্টার সড়কের বাইলেইন, উত্তর আগ্রাবাদের চৌমুহনী-চারিয়াপাড়া সংলগ্ন বিএনপি নেতা মাহবুব ও সমাজসেবক শাহজাহান ভাইয়ের বাড়ির পেছনে গ্রামের চেয়েও ভয়ঙ্কর অবস্থা, বাঁশের সাকো বসিয়ে হাজার হাজার মানুষের ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল; সেই সাকো সরিয়ে স্ল্যাব নির্মাণসহ তিনটি প্রকল্পের তালিকা পাঠাই পাঠানটুলি-উত্তর আগ্রাবাদের একসিয়েন রফিক সাহেব এবং সরাইপাড়ার একসিয়েন এয়াকুব নবীর কাছে।
বলে রাখি, উত্তর আগ্রাবাদে বাঁশের সাকোর বদলে স্ল্যাব বসাতে হলে বিএনপি নেতা মাহবুব ও পার্শ্ববর্তী একজনের দুই হাত করে জায়গা ছাড়তে হবে। এর আগে প্রাক্তন কমিশনার সিরাজ ভাই, সোলায়মান ভাই উদ্যোগ নিয়েও জায়গার মালিকদ্বয় প্রয়োজনীয় জায়গা ছাড়তে রাজি না হওয়ায় কাজটি করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে শহরে বাস করে গ্রামের চেয়েও ভয়ানক অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলেন সেই এলাকার মানুষ। এলাকাবাসীর মুখে এই সঙ্কটের কথা শুনে আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। দুইজন কমিশনার ফিরে গেলেন। আমিই বা কী করতে পারি। টাকা বরাদ্দ আনলাম, কিন্তু কাজ করতে পারব না তা কী করে হয়। সিদ্ধান্ত নিলাম এই কাজ আমাকে পারতেই হবে। তাই জায়গার মালিক মাহবুব ভাইসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বসলাম। বললাম, ভাই আপনারাই তো দলমতের উর্ধ্বে উঠে আমাকে নির্বাচিত করেছেন আপনাদের কাজ করার জন্য। আমি তো বরাদ্দ আনলাম। বরাদ্দ এনে ভাবলাম প্রথমে আপনাদের কাজটাই করবো। কারণ এই একটি কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার মানুষের কষ্ট, নাভিশ্বাস। আপনারা দুই-তিন হাত জায়গা ছাড়লেই বিশাল এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। মাত্র দুই হাত জায়গা ছেড়ে আপনারা হজ্বের চেয়ে বড় সওয়াব পাবেন, মানুষ আপনাদের দোয়া করবে। সেদিক দিয়ে আপনাদের আমি ভাগ্যবান বলবো। কমিশনার আমি আজ আছি, কাল নেই। দোয়া, চলাচল-সুবিধা সব আপনারই ভোগ করবেন।
তারা আগে থেকেই আমাকে বোন জানতেন। সেটা স্মরণ করিয়ে বললাম, বোন জানেন, স্নেহ করেন বোনের জন্য কি এটুকু করতে পারবেন না। সঙ্গে সঙ্গে এলাকার গণ্যমান্য মানুষের সামনে জায়গা ছাড়তে তারা রাজি হয়ে যান। জায়গা পেলাম, কাজ শুরু করবো-ঠিক এই সময় জানতে পারলাম দুই লাখ টাকায় এই কাজটা হবে না।
একসিয়েন রফিক সাহেবকে ফোন করলাম। বললাম, কন্ট্রাক্টর সাহেব এই টাকায় কাজ হবে না বললেন। জানালেন তার সাড়ে তিন লাখ টাকা লাগবে। একসিয়েন সাহেবকে অনুরোধ করলাম, অনেক কষ্টে আমি জায়গা বের করেছি। এই কাজটি করতে না পারলে আমি কষ্ট পাবো। এসময় পাশে সিটি করপোরেশনের আরেকটি রাস্তার কাজ চলছিল। রফিক সাহেবকে বললাম, এই কাজের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করে যেভাবেই হোক সাড়ে তিন লাখ টাকায় কাজটা করাতে হবে। একই কন্ট্রাক্টরের পাশ হওয়া প্রকল্পের সঙ্গে সমন্বয় করে পুরো কাজটিই করতে রফিক সাহেব আমাকে সহযোগিতা করেন। দুই লাখ টাকার বরাদ্দে সাড়ে তিন লাখ টাকার কাজ হয়ে গেলো। এলাকার মানুষ দারুণ খুশি।
পাঠানটুলি ওয়ার্ডের কাজ পেলেন একজন নবীন কন্ট্রাক্টর। কাজ পেয়ে তিনি ফোনে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। বললেন, ‘আপা কাজটি আমি পেয়েছি। কাজটা কোথায় হবে একবার যদি দেখিয়ে দিতেন।’ খানবাড়ি বাই লেইনে কাজের স্পট দেখিয়ে দিলাম। বললাম, দুই লাখ টাকার এই কাজে কী পরিমাণ রড, সিমেন্ট, বালি, ইট, লেবার চার্জসহ আনুষঙ্গিক সবকিছুর একটা তালিকা নির্মাণাধীন কাজের সামনে টাঙিয়ে দেবেন। এতে করে এলাকার জনগণের মাঝে আপনার-আমার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় থাকবে। শুনে অমনই মুখটা ভার করে ফেললেন কন্ট্রাক্টর।
খানিক চিন্তা করে বললেন, আপা আমি একের পর এক সিডিউল কিনে এ পর্যন্ত ৯৬ হাজার টাকা খরচ করে এই প্রথম দুই লাখ টাকার কাজটা পেলাম। আর আপনি বলছেন, এই কাজের নির্মাণ সামগ্রীর তালিকা টাঙাতে। এরকম হলে আমার কীই বা লাভ থাকবে! আমার দিকে তাকাতে হবে। আপনি যদি এমন করে বলেন, তাহলে কাজটি তো আমার পক্ষে করা কঠিন হবে। তাকে বললাম, এলাকার মানুষজন যাতে সন্তুষ্ট হয় সেভাবেই গুণগত মান বজায় রেখে কাজটা করেন। এলাকার মানুষও সম্পৃক্ত হলো সেই কাজে।
যাই হোক ভালোভাবেই কাজটা শেষ হলো। কন্ট্রাক্টর সাহেব বিলে আমার স্বাক্ষর নিতে আসলেন। সঙ্গে একটি খাম। বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপা এটা আপনার। জানতে চাইলাম খামটা কিসের! বললেন, সামান্য কিছু টাকা আছে এখানে। বললাম, আপনার সাহস তো কম নয়। জীবনেও এই কাজ করবেন না আমার সঙ্গে। এই খাম আপনি রেখে দিন। থতমত খেয়ে গেলেন কন্ট্রাক্টর সাহেব। এরপর বিলে স্বাক্ষর করে তাকে ছেড়ে দিলাম।
পরে জেনেছি, পার্সেন্টেজ প্রশ্নে অন্য কন্ট্রাক্টরের সঙ্গে বিষয়টি শেয়ার করে ওই কন্ট্রাক্টর বললেন, অন্য কমিশনাররা যেখানে পার্সেন্টেজের জন্য দর কষাকষি করে সেখানে আগ্রাবাদের কমিশনার (আমি) এধরনের কথা ও প্রস্তাবে উল্টো ধমক দেন। আরো কয়েকটি জায়গায় এটি উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার হওয়ায় সংরক্ষিত আসনের দুইজন কমিশনার মাইন্ড করলেন এবং উষ্মা প্রকাশ করে আমাকে বললেন, আপনার জন্য কন্ট্রাক্টররা আমাদেরকেও টাকা দিতে চাচ্ছে না।
যাই হোক, এই দুটি কাজ শেষ করে ইঞ্জিনিয়ার নবী সাহেবকে ফোন দিয়ে জানতে চাইলাম সরাইপাড়ার আব্দুস সালাম মাস্টার সড়কের বাইলেনের কাজ কখন শুরু হবে। তিনি জানান, আপনার ওখানে তো কমিশনার সাহেব (অধ্যাপক আসলাম) একটা নাম দিয়ে রেখেছেন কাজের জন্য। ওনি কীভাবে নাম দেবেন? এটা তো আমার প্রজেক্ট। পাল্টা প্রশ্ন করে বললাম, ওনি কি তার প্রজেক্টে আমার দেওয়া রাস্তার কাজ করবেন? আমার প্রজেক্টে কেন ওনি নাম দেবেন। আপনি আমার কাজ শুরু করুন।
এরপর যথারীতি আমার প্রজেক্টের কাজ শুরু হলো। তার আগে অধ্যাপক আসলাম ফোন করে বললেন, আপনার প্রজেক্টে আমি একটা রাস্তার নাম দিয়েছি। মানে? আমার প্রজেক্টে আপনি কীভাবে নাম দেবেন। আপনার প্রজেক্টে কি আমি রাস্তার নাম দিতে পারবো? এরপর তিনি চুপ হয়ে গেলেন। সেই কাজটিও যথারীতি সম্পন্ন হলো। ছোট হলেও তিনটি কাজ সুন্দরভাবে করতে পেরে কিছুটা তৃপ্ত হই, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলি।
যথারীতি আমাদের কথা বলার জায়গা জিএম। মেয়রকে বলি, আমরা তিন ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত। ওয়ার্ড কার্যালয়ে প্রত্যেক কমিশনারের নাম ও কার্যকাল নিয়মানুযায়ী উল্লেখ করা হয়। কিন্তু সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদের নামও সেভাবে ওয়ার্ড কার্যালয়ে পাশাপাশি রাখার ব্যবস্থা করার জন্য অনুরোধ করি। বলি, তিন ওয়ার্ড থেকে আমাদের কাছে সেবা নিতে প্রচুর লোকজন আসে। আমাদের জন্য একটা কার্যালয় সেই সঙ্গে প্রয়োজনীয় লোকবলের দাবিটিও তুলে ধরি মেয়রের কাছে। মেয়র সাহেব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন, বললেন-বাসার ড্রয়িং রুমই হবে আপনাদের অফিস।
উত্তরে বলি, কারো ড্রয়িং রুম অফিস হয় এটা আমার জানা নেই। আমাদের ড্রয়িং রুমে মানুষজন আসবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু অফিসিয়াল কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অফিস-লোকবল আমাদের লাগবেই। অফিসের কাজ অফিসেই হবে, ড্রয়িং রুমে নয়।
পরবর্তী জিএম-এ পাঠানটুলি ওয়ার্ড কমিশনার এসএম জাফর ও সরাইপাড়া ওয়ার্ড কমিশনার অধ্যাপক আসলাম দুজনই জানান, ওয়ার্ড কার্যালয়ে তাদের চেয়ারের পাশাপাশি সংরক্ষিত আসনের কমিশনার হিসেবে সম্মান করে আমার জন্য একটা চেয়ার রাখা হয়েছে। যাতে ওয়ার্ড অফিসে গিয়ে আমি বসতে পারি। বললাম, আপনাদের উদারতার জন্য ধন্যবাদ। আমি শুধু আমার একার জন্য অফিসের কথা বলিনি। দাবিটি সংরক্ষিত আসনের সকল কমিশনারদের জন্য উত্থাপন করেছি। যেটি সিটি করপোরেশনের উদ্যোগেই হতে হবে। যেদিন সবাই চেয়ারে বসতে পারবেন আমিও সেদিন বসবো। তার আগে নয়।
আমার এসব কথা ভালোভাবে নিতে পারছিলেন না মেয়র সাহেব। তাই তিনি আমাকে প্রতিপক্ষ ভাবতে শুরু করেন। কীভাবে আমাকে বঞ্চিত করা যায় সেটিই তাঁর মাথায় ঘুরতে থাকে। আমরা তখন বিরোধীদলে (২০০১ এর পর থেকে)। সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। প্রায় মিছিল-মিটিংয়ে সভাপতি নিলুফার কায়সারের সমর্থনে আমার করা মহিলা লীগের ৬ থানা কমিটির কর্মী ছাড়াও আমার অনুসারী কর্মীদের নিয়ে হাজির হতাম। বলা চলে সরকারবিরোধী মিটিংয়ে আমার উপস্থিতি থাকতো অগ্রভাগে। এসব মিটিংয়ে আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পদস্থ নেতারা একজন করে বক্তৃতা দেয়ার সুযোগ পেতেন। সেই নিয়মে দেখা গেছে মহানগর মহিলা লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আমার নাম সামনে চলে এসেছে। খোরশেদ আলম সুজন ভাই, অ্যাডভোকেট ইব্রাহিম হোসেন বাবুল ভাই বক্তার তালিকায় আমার নাম লিখে বলতেন তুমি বক্তৃতা দেবে। কিন্তু পরবর্তীতে সেই তালিকা থেকে মহিউদ্দিন চৌধুরী সাহেব আমার নাম কেটে দিতেন।
সিটি করপোরেশনের অনুষ্ঠানেও একই অবস্থা। দেখা যেতো, জনসংযোগ কর্মকর্তা কোনো অনুষ্ঠান সঞ্চালনা কিংবা অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে আমার নাম লিখেছেন। কিন্তু আমার নামটি দেখার সঙ্গে সঙ্গে মেয়র কেটে দিতেন।
অথচ এই মেয়রই কমিশনার নির্বাচিত হওয়ার প্রথম দিকে আমার প্রশংসা করতেন। আওয়ামী লীগের ৪১ ওয়ার্ডের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সামনে আমি ভালো বক্তা, শিক্ষিত বলে প্রশংসা করতেন। তার চশমা হিলের বাসভবন, দারুল ফজল মার্কেট, লালদিঘী পাড়ের মিটিংয়ে আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দিতেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যামেরিটার্স অধ্যাপক, দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ড. আনিসুজ্জামান স্যারের উপস্থিতিতে লালদিঘির মাঠে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে ৪১ ওয়ার্ডের কমিশনারের মধ্য থেকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমাকেই বেছে নিয়েছিলেন চৌধুরী। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন-গুরউয়ারে বক্তৃতা দিতে দি-অ। অর্থাৎ ছোটটাকে বক্তৃতা দিতে দাও। নগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ইঙ্গো-মার্কিন হামলায় ট্রাকে চড়ে নগরজুড়ে স্পটে স্পটে সমাবেশ করতাম, বক্তৃতা দিতাম। অনুষ্ঠান শেষে মেয়র সাহেব সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞেস করতেন কার বক্তৃতা ভালো হয়েছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীরা যখন বলতেন আমার বক্তৃতা ভালো হয়েছে। শুনে চৌধুরী বলতেন, ও তো ভালো বক্তা। এসবও নিত্যদিন আমার কানে বাজতো।
অথচ সেই তিনিই কিনা করপোরেশনের জিএম-এ কিছু ন্যায্য দাবি ও অধিকার আদায়ের প্রশ্নে আমার মতো একজন সাধারণ কর্মীকে বঞ্চিত করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলেন। ভাবতেই নিদারুণ কষ্ট পেতাম।
২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় আসার পর জাতীয় মহিলা সংস্থা, চট্টগ্রাম শাখার চেয়ারম্যান করা হয় তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক প্রয়াত দস্তগীর চৌধুরীর সহধর্মীণি ডা. কামরুন্নাহার দস্তগীরকে। নিয়মানুযায়ী সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত আসনের তিনজন কমিশনারকে জাতীয় মহিলা সংস্থার পরিচালক করা হবে। সে হিসেবে চেয়ারম্যান কামরুন্নাহার দস্তগীর আমাকে ফোন করে জানান, পরিচালক হিসেবে তারা আমাকে রাখতে চান। আমার পছন্দমতো আরো দুজনের নাম দিতে বলেন। কামরুন্নাহার আপাকে জানাই আমার পাশাপাশি কমিশনার জোবাইরা নার্গিস ও মমতাজ খানকে রাখতে।
আবার বলি- একটা কাজ করুন, সরাসরি মেয়র মহোদয়ের কাছে তিনজনের নাম চেয়ে চিঠি পাঠান। তখন তিনি বলেন, ওনি আপনার নাম দিবেন তো! বললাম, দেখুন না, দিতেও পারেন। ভাবলাম, এই সুযোগে মেয়রের কাছে আমি কোন্ জায়গায় আছি সেই পরীক্ষাটাও হয়ে যাক।
কামরুন্নাহার আপা তিনজনের নাম চেয়ে মেয়রের কাছে চিঠি পাঠালেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, উত্তরে মেয়র সাহেব যাদের নাম পাঠালেন সেখানে আমি নেই। তিনি যাদের নাম পাঠালেন তারা হলেন হাসিনা জাফর, শাহনাজ মালিক হেলেন ও নূরজাহান জাহাঙ্গীর।
বলে রাখি, কামরুন্নাহার দস্তগীরকে চেয়ারম্যান করার আগে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী ও চট্টগ্রামের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমাকে চেয়ারম্যান করার কথা বলেছিলেন। তার তখনকার এপিএস আবু সৈয়দ সরদারই পরবর্তীতে সেই কথা আমাকে জানান। বলেন, বিএনপি না করি তাতে সমস্যা নেই আওয়ামী লীগের সিরিয়াস কর্মী না হলে জনাব খসরু আমাকে মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান করার কথা চিন্তা করেন।
শুধু তাই নয়, দল পরিবর্তন করার আশ্বাস পেলে আমাকে সংরক্ষিত আসনের এমপি করার জন্য বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের ভাবনাটিও জানান আবু সৈয়দ সরদার। তারেক জিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আমেরিকা প্রবাসী এনায়েত লাভলুও আমার কাছে এমপি হওয়ার প্রস্তাব নিয়ে এসেছিলেন। আমি এক সপ্তাহ সময় নিই। অনেক চিন্তাভাবনার পর বলি দেই, এটা আমার সঙ্গে যায় না। নীতি-আদর্শ বিসর্জন দিয়ে আমি এমপি হতে চাই না। তিনি আমার কথা শুনে আশ্চর্য হলেন। বললেন, কত বড় বড় নেতা এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য দল বদল করেন, আর আপনি! আমি বলি, বড় নেতারা যা পারবেন তা আমার মতো দায়িত্বশীল কর্মীরা পারবে না।
এরমধ্যেই একবছর অতিবাহিত হতে চললো। সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদের দাবিদাওয়া প্রসঙ্গে মেয়র সাহেবের কোনো ইতিবাচক মনোভাব চোখে পড়ে না। বরং তুচ্ছতাচ্ছিল্য, হেয় প্রতিপন্ন করার একটা প্রবণতা মেয়র সাহেবের মাঝে। একপর্যায়ে সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদের জন্য কার্যালয়, সেই সঙ্গে জনবল নিয়োগ, উন্নয়ন কর্মকা-, ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা, আলোকসজ্জা, সনদপত্র ইস্যু করার ক্ষমতা ইত্যাদি কাজ আমরা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও কেন করতে পারবো না তা জানতে চেয়ে মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী বরাবরে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাই।
লিগ্যাল নোটিশ করপোরেশনে পৌঁছালো ঠিকই। কিন্তু তার জবাব কিংবা সরাসরি এ নিয়ে কোনো কথা না বলে আমার প্রতি একটা বিমাতাসুলভ আচরণ শুরু করেন। সবকিছুতেই যেন আমাকে বঞ্চিত করার একটা প্রচেষ্টা। প্রায় সব কমিশনারকে পর্যায়ক্রমে ভারপ্রাপ্ত মেয়রের দায়িত্ব দেওয়া হলেও আমাকে একবারের জন্যও সে সুযোগ দেননি তিনি। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে করপোরেশন থেকে নারী প্রতিনিধি পাঠানো থেকে আমার নাম বরাবরই বাদ দিতেন।
নানা অধিকার প্রশ্নে প্রতিবাদের কারণে আমার একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি এরমধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। রাজনধানীতে স্থানীয় সরকার বিভাগের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, স্থানীয় সরকার গবেষণা, স্থানীয় সরকার উন্নয়নসহ নানান অনুষ্ঠানে আয়োজকরা আমার উপস্থিতি কিংবা অংশগ্রহণ প্রত্যাশা করে মেয়রের কাছে চিঠি পাঠাতেন। কিন্তু ফাইনালি দেখা যেতো মেয়র সাহেব আমার নামটি বাদ দিতেন। তার এই ধরনের আচরণে খোদ বিস্মিত হতেন আয়োজকরাই। পরে তারা আমার কাছে ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করতেন। বলতেন, আপা আমরা আপনাকেই আশা করেছিলাম। কিন্তু মেয়র সাহেব আপনার নামটা পাঠালেন না। এখন থেকে সরাসরি আপনাকেই আমরা আমন্ত্রণপত্র ইস্যু করবো। এভাবে পরবর্তীতে তাদের একাধিক অনুষ্ঠানে আমি অংশ নিয়েছি।
এখানে বলে রাখি, ২০০০ সালে নির্বাচিত হওয়ার পর ঢাকার এলজিইডি ভবনে মেয়র, কমিশনার, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধিদের নিয়ে তিন দিনব্যাপী একটি কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব, কর্তব্য, ক্ষমতা এসব ছিল কর্মশালার বিষয়। সেই কর্মশালায় আমি ভালো পারফর্ম করে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হই আয়োজকসহ উপস্থিত অতিথিবৃন্দের।
সমাপনী দিনে মুক্ত আলোচনা, ওপেন ফ্লোর সবার জন্য। অতিথি হিসেবে উপস্থিত আছেন প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী। আমি উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে নির্বাচিত কমিশনারদের স্ট্যাটাস কী হবে তা সুনির্দিষ্টকরণ, সংরক্ষিত আসনের কমিশনারদের দায়-দায়িত্ব কী, কমিশনারদের সম্মানী ভাতা, আগামীতে একই ওয়ার্ডে একজন পুরুষ, একজন নারী কমিশনার নির্বাচিত হবে যেখানে দুজনের দায়দায়িত্ব, কর্মকা- সমান হবে। সাধারণ ও সংরক্ষিত আসন এরূপ কোনো বিষয় থাকবে না, দলীয়ভাবে মনোনয়ন দিয়ে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচিত হয়ে আসবে অর্থাৎ ওয়ান ইসটু ওয়ান পদ্ধতিসহ বিভিন্ন দাবিদাওয়া উত্থাপন করি। আমার বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী ও স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক আতাউর রহমান মজুমদার আমাকে সাধুবাদ জানান। তারা দাবিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে আমাকে লিখে দিতে বলেন। আমি সমস্ত দাবি পয়েন্ট আকারে লিখে মুখ্য সচিবের হাতে তুলে দিই।
যাই হোক, ফিরে আসি আগের জায়গায়। বলছিলাম মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর সঙ্গে অধিকার প্রতিষ্ঠার গল্প। অধিকারের কথা বললেই আমি চক্ষুশূলে পরিণত হচ্ছি।
এরমাঝেই মাসিক এক সাধারণ সভায় মেয়রের সঙ্গে আমার তুমুল বাদানুবাদ। একপর্যায়ে দাবিদাওয়ায় অনড় থেকে একাই জিএম বর্জন করে বেরিয়ে আসি। আমি আশ্চর্য হতাম, আমার উত্থাপিত দাবিগুলো সব সংরক্ষিত কমিশনারেরই মনের কথা। তারা নেপথ্যে আমাকে সাধুবাদ ও সমর্থন জানালেও মেয়র সাহেবের সামনে তারা মুখ খুলতে পারতেন না। মেয়র সাহেব যেন যমদূত। কেবল তারাই নন, সাধারণ আসনের কমিশনাররা, বাঘা বাঘা আমলারাও মেয়রের সামনে কথা বলতে সাহস পেতেন না। সবাই ভয়ে জবুথবু। রাজনীতির মাঠেও একই দৃশ্য। সেরকম একটি পরিস্থিতিতে আমি একা লড়ছি। কারণ, আমার মেরুদণ্ড সোজা, কখনো বাঁকা হবে না। আমার জন্য পদে পদে চরম বঞ্চনা, লাঞ্ছনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে থাকলো। সেটি জেনে, মেনেই অধিকার আদায়ে আমি লড়ে যাবো। স্বামী বিবেকানন্দ বলতেন, ‘জীবনে ঝুঁকি নাও, জিতলে নেতৃত্ব দিবে, না হয় অন্য কাউকে পথ দেখিয়ে দেবে।’
[অ্যাডভোকেট রেহানা বেগম রানুর প্রকাশিতব্য ‘জনপ্রতিনিধির ডায়েরি’র অংশবিশেষ]