এম কে মনির : আইন লঙ্ঘন করে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড পৌরসদরের কলেজ রোডের বড় বাজার এলাকায় একটি শতবর্ষী পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ওই পুকুরের অর্ধেক অংশ বালু ফেলে ভরাট করা হয়েছে। কেটে ফেলা হয়েছে পুকুর পাড়ের বেশকিছু গাছও।
সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ড মহাদেবপুর গ্রামের এ পুকুরটির আয়তন প্রায় ৫৯ শতক। যুগ যুগ ধরে পুকুরটি স্থানীয়রা ব্যবহার করে আসছেন।
শুক্রবার (৬ জানুয়ারি) দুপুরে সরেজমিনে কলেজ রোডের বড়বাজারে গিয়ে দেখা যায়, শতবর্ষী ওই পুকুরটিতে ট্রাকে করে বালু ফেলা হচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে পুকুরটি। এসময় পুকুর পাড়ে কেটে ফেলা গাছপালার ডাল পড়ে থাকতে দেখা গেছে। সেখানে থাকা আরও গাছপালা কাটার প্রস্তুতি চলছে।
এসময় কথা হয় পুকুরটির আগের মালিক প্রদীপ ভট্টাচার্যের সঙ্গে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, পুকুরটি আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। পুকুরটি দূষিত হয়ে ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে রূপ নিয়েছে। মশা-মাছির উপদ্রব বেড়েছে। এটি দীর্ঘ দিন ধরে ব্যবহারের অনুপযোগী বলে দাবি করেন তিনি।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, পুকুরটি নিয়ে দুটি পক্ষের বিরোধ রয়েছে। এ নিয়ে আদালতে উভয়পক্ষে মামলাও চলমান আছে। বহুতল ভবন নির্মাণ ও বেশি দামে প্লট বিক্রি করতে পুকুরটি ভরাট করা হচ্ছে। ট্রাকে ট্রাকে রাতদিন বালু ফেলা হচ্ছে পুকুরে। ইতিমধ্যে প্রভাবশালী একটি গ্রুপকে পুকুর ভরাটের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
তারা আরও জানান, শত বছর ধরে পুকুরটি নিত্য কাজে ব্যবহার হয়ে আসছে। পুকুরটিতে একসময় মাছ চাষ হতো। এখনও অনেক মাছ ও জলজ প্রাণি, উদ্ভিদ রয়েছে এ পুকুরে। বালু দিয়ে ভরাটের ফলে সবকিছু চাপা পড়ে যাচ্ছে।
পুকুর ভরাটের ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দা গৌতম অধিকারীর সংশ্লিষ্টতা আছে বলেও অভিযোগ করেন ওই এলাকার বাসিন্দা। জানতে চাইলে গৌতম অধিকারী একুশে পত্রিকাকে বলেন, আমি পুকুরের মালিক নই। আমি এসব বিষয়ে কিচ্ছু জানি না, বলতেও পারব না। তবে এটি সত্য যে পুকুরটি এখন ময়লা-আবর্জনায় ভরে ডোবায় পরিণত হয়েছে। এটি প্রায় ব্যবহারের অনুপযোগী। পুকুরে মশা-মাছির উপদ্রব বেড়ে রোগজীবাণু ছড়াচ্ছে। পুকুর ভরাটের চেয়ে জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ।
পুকুরটির মালিকানা দাবি করে সীবলী সালেম একুশে পত্রিকাকে বলেন, পুকুরের জায়গাটি আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি। বদিউল আলম, এস এম মুরাদ, গৌতম অধিকারীসহ একটি পক্ষ জোরপূর্বক ভরাট করে এটি দখলের পাঁয়তারা করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ইতিমধ্যে আমি পুকুরটি পরিদর্শন করেছি। ভরাটের কাজ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। পুকুর ও জলাশয় ভরাট বেআইনি।
প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী, কোনো পুকুর, জলাশয়, নদী, খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণি পরিবর্তন বা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার, ভাড়া, ইজারা বা হস্তান্তর বেআইনি। কোনো ব্যক্ত এ ধারা লঙ্ঘন করলে আইনের ৮ ও ১২ ধারা অনুযায়ী পাঁচ বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ একই সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী যেকোনো ধরণের জলাশয় ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
তবে এসব আইনের কোন তোয়াক্কা নেই সীতাকুণ্ডে। গত ১ বছরে কেবল পৌরসদরেই ভরাট করা হয়েছে অর্ধ শতাধিক বড় বড় দীঘি ও পুকুর। সীতাকুণ্ডের নামার বাজার এলাকায় বিশাল একটি দীঘি ভরাট করে প্লট আকারে বিক্রি শুরু করেছেন সেটির মালিক কণ্ঠশিল্পী কুমার বিশ্বজিৎ। সীতাকুণ্ডের উত্তর বাজারের দাস পাড়ায় একটি প্রাচীন পুকুর ভরাট করে গড়ে তোলা হয়েছে সীতাকুণ্ড চক্ষু হাসপাতালের বহুতল ভবন ও মার্কেট।
একই এলাকায় ভূঁইয়া টাওয়ারের পেছনে আরেকটি পুকুর ভরাট করা হয়েছে। গত কয়েক মাস আগে প্রশাসন অভিযান চালিয়ে পুকুর ভরাটের কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও তা মানেননি মালিকরা। পৌরসদরের সোবহান বাগ ৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামসুল আলম আজাদ পুকুর ভরাট করে বহুতল ভবন গড়ে তুলেছেন। এছাড়াও সীতাকুণ্ড বাজারের আশেপাশে বেশ কয়েকটি প্রাচীন বড় দীঘি এখন ভরাটের পথে। অনেক দীঘি দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। অনেকগুলো কচুরিপানা, ময়লা-আবর্জনায় ডোবায় পরিণত হয়েছে। এসব দীঘি ও জলাশয় সংরক্ষণে ও পরিবেশ রক্ষায় তেমন কোন উদ্যোগ নেই।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও লেখক জামশেদ উদ্দিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, সীতাকুণ্ডের প্রাচীন দীঘিগুলোর সাথে মহান মুক্তিযুদ্ধের অনেক স্মৃতি জড়িত আছে। সীতাকুণ্ডের দেওয়ান দীঘি, লাল দীঘি, রেলওয়ে ডেবা, গজারিয়া দীঘিসহ বড় বড় দীঘি ও পুকুরগুলোতে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সময় কাটিয়েছেন। যুদ্ধের কৌশল হিসেবেও এগুলোর ভূমিকা রয়েছে। যা আমার লেখা মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। এগুলো সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। তাই সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।
পরিবেশ ও মানবাধিকারকর্মী এম এ আরাফাত এলাহী বলেন, পুকুর ও জলাশয় ভরাট করা বেআইনি। সাময়িক প্রয়োজনের কথা ভেবে আমরা জলাশয় ভরাট করে ফেলি। বৃহত্তর স্বার্থে জলাশয়-জলাধারগুলো অধিগ্রহণ করে সরকারকে সংরক্ষণ করতে হবে। পুকুর ও জলাশয়ের বহুবিধ ব্যবহার আছে। পুকুরে কেউ গোসল করবে, কেউ সাঁতার কাটবে৷ এটি শারীরিক চর্চার একটি জায়গাও। আমরা পান করার চেয়ে পানি ব্যবহার করি বেশি। পুকুর হচ্ছে প্রাকৃতিক পানির প্রধান উৎস। শুধু তাই নয় কোন এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের সময় ফায়ার সার্ভিস যদি দ্রুত পৌঁছাতে না পারে সেক্ষেত্রে পুকুরের পানি দিয়ে স্থানীয়রা আগুন নেভাতে পারবেন। এছাড়া বর্ষাকালে অতি বৃষ্টির পানি জলাশয়-জলাধারে জমা হয়। এতে বন্যা থেকে রেহাই পায় গ্রামবাসী। অন্যদিকে পুকুরের উপর ভবন নির্মাণ করা হলে ঝুঁকি থাকে। ভূমিকম্পে ওই ভবন ধ্বসে যেতে পারে। কেননা এসব ক্ষেত্রে অনেক নিয়ম উপেক্ষিত থেকে যায়।