মাসুদ ফরহান অভি : সুইডেনে নতুন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ‘স্ট্রাম কুর্স’ বারবার কোরআন শরীফ পুড়িয়ে তাদের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করছে। এককথায় তারা বোকা। তারা ফেরাউন, নমরুদ, আবু লাহাব, উতবা, শায়বার ইতিহাস জানে না। তারা এও জানে না, এই কোরআনের হেফাজতকারী স্বয়ং আল্লাহ।
আজ তাদের আচরণ গোটা দুনিয়ার মানবজাতির হৃদয়ে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। আজকে হয়তো আরাফা’র ময়দান থেকে লক্ষ লক্ষ হজপালনকারীর লানত তাদের উপর আছড়ে পড়ছে। তারা পৃথিবীজুড়ে ফ্যাসাদ সৃষ্টির লক্ষেই যে এই ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছে, তা স্পষ্ট। এই আচরণ অসহ্য, এদের পতন অনিবার্য।
তারা জানে না, আল্লাহ’র পক্ষ থেকে নবী-রাসূলদের ওপর অবতীর্ণ কিতাব ও সহিফার সবগুলোই লাওহে মাহফুজে সংরক্ষিত। যে কোরআন তারা পুড়িয়ে উল্লাস করছে, সে কোরআনের সুরা বুরুজের ২১-২২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহুওয়াতাআ’লা স্পষ্ট করেই বলেছেন- ‘বরং এটি মহান কোরআন, যা লাওহে মাহফুজে লিপিবদ্ধ।’
এই লাওহে মাহফুজ সৃষ্টির দৃষ্টিসীমার ঊর্ধ্বে। মানবজাতির অর্জিত জ্ঞানের ঊর্ধ্বে, কল্পিত ধারণারও ঊর্ধ্বে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লার নিজ সংরক্ষিত সংরক্ষণ ফলক লাওহে মাহফুজ তাঁরই ইচ্ছাতেই সুনিয়ন্ত্রিত।
ওই সুইডিশ বোকাদের জ্ঞানের অহংকার এতই নিম্নমানের, কোরআন যে এমন একটি গ্রন্থ পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞানীরা মিলেও যে এর কোনো ত্রুটি, বিচ্যুতির ছায়া পায়নি তা তাদের মস্তিষ্কে স্থাপন করতে পারেনি। তারা জানে না, এটি এমন একটি গ্রন্থ, যে গ্রন্থ শুরু থেকে আজ পর্যন্ত অক্ষত অবস্থাতেই রয়েছে। যার কোনো পরিবর্তন নেই, পরিবর্ধন নেই, পরিমার্জনও নেই। যেটি পরিবর্তনের লক্ষ্যে স্পর্শ করা কোনো মানব কিংবা দানব, জিন কিংবা ফেরেশতা কারোরই পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। মানুষের চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি কিংবা গবেষণাও লাওহে মাহফুজের সম্পর্কে আদৌ কোনো তথ্য আনয়ন করার ন্যূনতম ক্ষমতা দেখাতে পারেনি।
কোরআন নিয়ে মহান আল্লাহ নিজেই চ্যালেঞ্জ ঘোষণা করেছেন সুরা বণী ইসরাইলে। এই সুরার ৮৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘যদি সমগ্র মানব ও জ্বিন জাতি এই কোরআনের অনুরূপ কিছু রচনার জন্যে জড়ো হয় এবং তারা পরস্পরের সাহায্যকারীও হয়; তবুও তারা কখনো এর অনুরূপ রচনা করে আনতে পারবে না।’
সুরা হিজর’র ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন, ‘এই যিকর (কোরআন) আমিই নাযিল করেছি, আর আমি নিজেই এর হেফাজতকারী।’
কোরআনুল কারীমের সুরা ওয়াকিয়াতে (আয়াত:৭৭-৮০) বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই এটা সম্মানিত কোরআন, যা আছে এক গোপন কিতাবে, যারা পবিত্র, তারা ব্যতীত অন্য কেউ একে স্পর্শ করবে না, এটা সৃষ্টিকূলের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ।’
কোরআনের সুরা জাসিয়াতে ঔদ্ধত্যতা দেখানো ব্যক্তিদের ব্যাপারে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া আছে। এই সুরার ৭-৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ’লা বলেন, ‘দুর্ভোগ প্রত্যেক ঘোর মিথ্যাবাদী মহাপাপীর, যে আল্লাহর আয়াতের আবৃত্তি শোনে অথচ ঔদ্ধত্যের সঙ্গে (নিজ মতবাদে) অটল থাকে। যেন সে তা শোনেইনি। সুতরাং ওকে মর্মন্তুদ শাস্তির সংবাদ দাও।’
সুইডিশ ওই বোকাদের উচিত, এখনই কোরআনের সুরা কাসাস পড়া। ফেরাউনের পরিণতিটা বুঝে নেওয়া। পৃথিবীর প্রথম স্বৈরশাসক নমরুদের পরিণতির গল্প বুঝে পড়া। তাদের উচিত আবু লাহাব, উতবা, শায়বা এবং আবু জেহেলদের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া।
সুরা আম্বিয়ায় আল্লাহ বলছেন, ‘কাফেররা কি ভেবে দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর মুখ বন্ধ ছিল, অতঃপর আমি উভয়কে খুলে দিলাম এবং প্রাণবন্ত সবকিছু আমি পানি থেকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’
২০১৭ সালে সুইডেনে স্ট্রাম কুর্স নামের একটি কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হয়। রাসমুস পালুডান নামের ড্যানিশ বংশোদ্ভূত একজন সুইডিশ নাগরিক এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে এক ভিডিও বার্তায় রাসমুস বলেছিলেন, ‘ইসলাম ও মুসলিমরা হচ্ছে আমাদের শত্রু। এই পৃথিবীতে যদি একজন মুসলিমও না থাকেন, তাহলে খুব ভালো হবে। তাহলে আমরা চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাব।’
সুইডেনের ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় স্ট্রাম কুর্স। কিন্তু একটি আসনেও জয় পায়নি তারা। গত ১৪ এপ্রিল সুইডেনের দক্ষিণাঞ্চলীয় লিঙ্কোপিং শহরে পবিত্র কোরআনের একটি কপি পোড়ায় কট্টরপন্থী এই গোষ্ঠীটি। গতকাল আরও একবার কোরআন পোড়ালো তারা।
আমার ধারণা, এই দলটি বিশ্বজুড়ে আলোচনায় আসতে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। কারণ যুগে যুগে ইসলামই এই পৃথিবীতে ন্যায় ও অন্যায়ের পার্থক্য সবার আগে সুস্পষ্ট করেছে পরিপূর্ণ জীবন-বিধান হিসেবে। এই জীবন ব্যবস্থা তৈরি করে দিয়েছে কোরআন। যেটি সমস্ত মানবজাতির জন্য একটি স্পষ্ট গাইডলাইন। যে গাইডলাইন সৃষ্টির প্রতি স্রষ্টার। এখানে মানুষের কোনো হাত নেই। মানুষ কেবলই এই বিধান প্রতিপালনকারী। এই বিধানকে বিতর্কিত করতে পারলেই আলোচনায় থাকা যাবে- এমন সস্তা ধারণা নিয়েই সুইডেনের নতুন গজিয়ে ওঠা এই রাজনৈতিক দল কোরআনকে অবমাননা করছে।
এবার সুইডিশ এই নাগরিকরা কোরআন পুড়িয়েছে ঈদুল আজহা ও হজ্বের এই কল্যাণময় সময়ে। আমরা দু-হাত তুলে দোয়া করি, সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে তারাই যেন এই কোরআনের পথে এসে ঈমান গ্রহণ করেন। যেমন করে মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে ঈমান গ্রহণ করেছিলেন আল্লাহ’র রাসুলের চাচাতো ভাই আবু সুফিয়ান ইবনুল হারিস, যেমন করে ঈমান গ্রহণ করেছিলেন হযরত উমর (রা.)।
লেখক: প্রাক্তন শিক্ষার্থী, যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।