শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মহামারি আকারে ছড়াচ্ছে ডেঙ্গু, বাড়ছে রোগীর চাপ

প্রকাশিতঃ ১৭ জুলাই ২০২৩ | ৮:৪৮ পূর্বাহ্ন


ঢাকা : ডেঙ্গু এখন সারাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যাও অনেক বেশি। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে রয়েছে- একে মহামারি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই বর্তমান ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘জনস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা’ হিসেবে ঘোষণা করতে সরকার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। ডেঙ্গুজ্বর নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধের লক্ষ্যে আয়োজিত এক সেমিনার ও সংবাদ সম্মেলনে এই পরামর্শ দেয়া হয়।

গতকাল রবিবার দুপুরে মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অডিটোরিয়ামে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন (বিএমএ)।

তবে গতকাল ভার্চুয়ালি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেছেন, ডেঙ্গুর ভয়াবহ সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক হেলথ ইমার্জেন্সি বা জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণার সময় এখনো আসেনি। এর আগেও করোনা পরিস্থিতিতে দেশে জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছিল। এবারো হয়তো সেটা করা হবে, তবে এটি করার জন্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কথা হতে হবে। আমরা আমাদের উদ্বেগের বিষয়টি জানিয়েছি, যারা সুপারিশ করেছেন, তাদের কথাও আমরা আমলে নিচ্ছি। তবে দেশে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা বা ডেঙ্গু সংক্রমণ আরো বাড়লে স্বাস্থ্যসেবা সংকটে পড়তে পারে। এদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বাড়ায় পাঁচটি সচেতনতামূলক বার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

বিএমএর সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সংগঠনের সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন সেমিনার সিম্পোজিয়াম ও কন্টিনিউইং মেডিকেল এডুকেশন উপপরিষদের চেয়ারম্যান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ। ‘প্রিভিলেন্স রিস্ক অ্যান্ড প্রিভেনশন অব ডেঙ্গু ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমএর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন। আর ‘ডায়গনসিস এন্ড ট্রিটমেন্ট অব ডেঙ্গু’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থান করেন বিএমএর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং বিএসএমএমইউর রিউমাটোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক। বক্তব্য রাখেন মুগদা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মুস্তাফিজুর রহমান।

ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে সরকারের আরো বেশি চিন্তা ভাবনা করা উচিত। বছরব্যাপী ৩৬৫ দিন মশা নিধনে কাজ করা দরকার। সম্প্রতি কলকাতা ভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য বলেন, কলকাতায় দেখেছি মশা নিধনে তাদের একটি আলাদা ইউনিট আছে। তারা বছরব্যাপীই এই কাজ করে। আমি আমাদের ঢাকার দুই মেয়রকে বলেছি, তারাও যদি বছরব্যাপী এডিস মশা নির্মূলে আলাদা ইউনিট করে কার্যক্রম চালায় তাহলে এর সুফল আসবে। আরেকটি কথা বলতে চাই, মশা নিধনে আমাদের এখানে যে ওষুধ ছিটানো হয় তা কতটা শক্তিশালী এটিও পরীক্ষার বিষয়। নিম্নমানের ওষুধ শুধুমাত্র নামকাওয়াস্তে ছিটিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। ডেঙ্গু নিয়ে আমাদের আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে। কারণ এটি এখন ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি কনসার্ন’।

ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, নগর ছাড়িয়ে এই রোগ এখন ছড়িয়েছে গ্রামেও। একটি জেলা বাদে পুরো দেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। ডেঙ্গু পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে রয়েছে একে মহামারিই বলা যায়। তবে মহামারি শব্দটি ব্যবহার করতে আমরা ইতস্তত বোধ করি। ডেঙ্গু এখন জনস্বাস্থ্য সমস্যা। গতবার আমরা দেখেছি, শীতের সময়ও ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আগে এডিস মশা দিনের বেলায় কামড়াত বলে আমরা জানতাম। এছাড়া জানতাম, স্বচ্ছ পানিতে এডিস বংশ বিস্তার করে। কিন্তু সম্প্রতি করা এক গবেষণা বলছে, এডিস মশা রাতেও কামড়ায়। নোংরা পানিতেও এডিসের লার্ভা মিলছে। ফলে দ্রুতই এডিস এবং ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে। গত বছর অক্টোবরে ডেঙ্গুর পিক সিজন ছিল। কিন্তু এ বছর দেখা যাচ্ছে, খুব আগেই ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটেছে। গত বছরের এক গবেষণায়, দেশের এক চতুর্থাংশ মানুষের শরীরে অ্যান্টিবডি মিলেছে। তার মানে বোঝা যাচ্ছে অধিকাংশ মানুষই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। ফলে এ বছর তারা যদি ডেঙ্গুর অন্য ধরন দিয়ে আক্রান্ত হন- তাদের ঝুঁকি বেশি। আমাদের এডিস মশা নির্মূলের পাশাপাশি জনগণকেও এই কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। আন্তঃমন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠনেরও সুপারিশ করেন তিনি।

ডেঙ্গুর বিভিন্ন উপসর্গ বর্ণনার পাশাপাশি অধ্যাপক ডা. সৈয়দ আতিকুল হক বলেন, যেসব এলাকায় বেশি বেশি রোগী আক্রান্ত হচ্ছে- তারা দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, চিকিৎসকদের উচিত প্রটোকল মেনে ডেঙ্গুরোগীর চিকিৎসা দেয়া। ডেঙ্গু হলেই রোগীদের স্টেরয়েড ও এন্টিবায়োটিক দেয়ার দরকার নেই। প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। তাছাড়া রোগী যদি গুরুতর না হয়; তবে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন নেই। প্লাটিলেট দেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শরীরে প্লাটিলেটের মাত্রা কমলেই প্লাটিলেট দেয়া একেবারেই জরুরি নয়। ১০ হাজারের নিচে প্লাটিলেট নামলেই রোগীকে প্লাটিলেট দেয়ারও প্রয়োজন নেই। রোগীর শ্বাস প্রশ্বাস, রক্তচাপ ঠিক আছে কিনা সেটি দেখতে হবে।

ডা. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, চিকিৎসক সংকটে ডেঙ্গুরোগী ব্যবস্থাপনা এবং অপরাপর রোগীদের সেবা অব্যাহত রাখতে আমাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। কাজ করতে গিয়ে অনেক চিকিৎসকও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবুও আমরা সেবা দিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, চিকিৎসক সংকট কাটলে আমরা আরো ভালো সেবা দিতে পারব।

অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অসময়ে বৃষ্টিপাত, জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অন্যতম কারণ। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে যেমন কাজ করতে হবে; তেমনি আমাদেরও সচেতন হতে হবে। ফুল হাতা শার্ট-প্যান্ট-মোজা পরা, ঘুমানোর সময় মশারি টাঙানো, ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে সব সময় মশারির মধ্যে থাকা জরুরি।

ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে যুক্ত হয়ে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘পাবলিক হেলথ ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করার মতো অবস্থা এখনো হয়েছে বলে আমি মনে করি না।

বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণ প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে মহাপরিচালক বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। তবে বেড ভাড়া এবং অন্যান্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে নির্ধারিত করে দেয়া হয়নি। শনিবার এক সভায় বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় নির্ধারণ মনিটরিং টিম করা হয়েছে।

ডেঙ্গু নিয়ে ৫ বার্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের: প্রায় প্রতিদিনই রেকর্ড ভাঙছে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা। এমন পরিস্থিতে পাঁচটি সচেতনতামূলক বার্তা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গতকাল স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব ডা. মো. শিব্বির আহমেদ ওসমানী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ বার্তা দেয়া হয়।

বার্তাগুলো হলো- জ্বরের শুরুতে অবশ্যই নিকটস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ডেঙ্গু শনাক্তকরণ পরীক্ষাসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিন। বাসার ভেতর ও চারপাশে, নির্মাণাধীন ভবন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ ভবনের বিভিন্ন স্থানে জমে থাকা পানি অপসারণ করুন ও পরিষ্কার রাখুন। দিনে অথবা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি ব্যবহার করুন। ডেঙ্গুজ্বর কমে গেলে অবহেলা না করে অবশ্যই পরবর্তী জটিলতা এড়াতে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। মনে রাখবেন এ বিষয়ে অবহেলা আপনার ও আপনার পরিবারের জীবন সংশয়ের কারণ হতে পারে।