বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অ্যানেসথেসিয়ার পুরনো ওষুধ কেন বাদ?

প্রকাশিতঃ ২৯ মার্চ ২০২৪ | ৫:৫৩ অপরাহ্ন


একুশে ডেস্ক : অ্যানেসথেসিয়ার ব্যবহারসংক্রান্ত জটিলতায় দেশে একাধিক রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠার পর নতুন নতুন যেসব নির্দেশনা দিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ, সেই ধারাবাহিকতায় এতদিন ব্যাপক হারে ব্যবহার হয়ে আসা ওষুধ হ্যালোথেনের বদলে অন্য দুটি ওষুধের ব্যবহার নিশ্চিত করতে আরেকটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে।

বৈধ পথে সরবরাহ না থাকায় ভেজাল হ্যালোথেনের ব্যবহার আগের দুর্ঘটনাগুলোর পেছনে দায়ী হতে পারে বলেও মনে করছে বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট।

দীর্ঘদিন ধরে চলে এলেও সাম্প্রতিক সময়ে এটি কেন বিপজ্জনক হয়ে উঠেছিল? অ্যানেসথেসিয়ার আরও ওষুধ থাকলেও এটিই কেন ব্যবহার করা হতো বাংলাদেশে?

হ্যালোথেন বৃত্তান্ত

যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হেলথের তথ্য বলছে, ১৯৫৬ সালে দেশটিতে হ্যালোথেন প্রচলন শুরু হয়। তখন বড় অস্ত্রোপচারে হ্যালোথেন নিয়মিত ব্যবহার করা হতো। নব্বইয়ের দশক নাগাদ এর প্রয়োগ সীমিত হয়ে আসে। এই হ্রাস পাওয়ার কারণ হিসেবে, যকৃতের ঝুঁকি এবং পরের দিককার ওষুধগুলো অধিকতর নিরাপদ হওয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে দামে অপেক্ষাকৃত সস্তা হওয়ায় উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে ওষুধটির প্রয়োগ চলমান থাকে। বাংলাদেশেও এ কারণেই এই ওষুধটিকে বেছে নেওয়া হত বলে জানাচ্ছেন, বাংলাদেশ সোসাইটি অব অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট, ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড পেইন ফিজিশিয়ান্স এর সভাপতি ডাক্তার দেবব্রত বণিক। ‘নব্বই শতাংশ জায়গায়ই হ্যালোথেন ব্যবহার করা হতো,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি।

তিন থেকে চারটি কোম্পানি এই ওষুধ আমদানি করত। এছাড়া, স্থানীয়ভাবে উৎপাদনও করত একটি কোম্পানি। কিন্তু, গত বছর সেই কোম্পানি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।

বাজারে যোগান কমে গেলে, অবৈধভাবে আমদানি ও ভেজাল মিশিয়ে বিক্রি শুরু হয় বলে ধারণা করছে সোসাইটি অব অ্যানেসথেসিওলজিস্ট। এ ব্যাপারে তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেও অবগত করেন। ‘কিছু কিছু রোগী যখন খারাপ হচ্ছে তখন আমরা বললাম, যদি প্রোপার চ্যানেলে না আসে হ্যালোথেন কোনো মতেই আর ব্যবহার করা যাবে না’, বলছিলেন দেবব্রত বণিক।

হ্যালোথেনের বিকল্প হিসেবে যে আইসোফ্লুরেন বা সেভোফ্লুরেনের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো কি বাংলাদেশে সহজলভ্য? অধ্যাপক দেবব্রত বণিক জানান, ‘আধুনিক ড্রাগগুলো বাজারে পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলোর দাম একটু বেশি।’ তাছাড়া, সেগুলো ব্যবহার করার জন্য যে সরঞ্জাম লাগে বেশির ভাগ হাসপাতালেই তা নেই। সে কারণেই প্রজ্ঞাপনে যত তাড়াতড়ি সম্ভব এগুলোর ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে।

প্রজ্ঞাপনের ভাষ্য

প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ‘সাম্প্রতিক সময়ে অ্যানেস্থেসিয়ার কারণে কতিপয় রোগীর মৃত্যু ও আকস্মিক জটিলতা প্রতিরোধে এবং অ্যানেস্থেসিয়ায ব্যবহৃত ওষুধের গুণগত মান নিশ্চিতকল্পে অ্যানেস্থেসিয়াতে হ্যালোথেন ব্যবহার ও এর বিকল্প নির্ধারণ জরুরি হয়ে পড়েছে।’

এছাড়া অ্যানেস্থেসিয়াজনিত মৃত্যু ও এর অপপ্রয়োগ রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে এতে।

স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের যুগ্ম সচিব জসীম উদ্দীন হায়দার স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনটি বুধবার (২৭ মার্চ) প্রকাশ করা হয়। হ্যালোথেনের বদলে আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন নামে দুটি ওষুধের কথা বলে দেওয়া হয়েছে।

দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারে ‘ইনহেলেশনাল অ্যানেস্থেটিক’ হিসেবে এগুলো ব্যবহার করতে হবে।

হাসপাতালগুলোতে এসব ওষুধের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম, ভেপোরাইজার নেই।

সব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে হ্যালোথেন ভেপোরাইজারের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ভেপোরাইজার প্রতিস্থাপনের জন্য চাহিদা মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

মোট হ্যালোথেন/আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজারের সংখ্যা এবং বিদ্যমান হ্যালোথেন ভেপোরাইজার পরিবর্তন করে আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজার প্রতিস্থাপন করতে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের হিসাব-নিকাশও প্রস্তুত করতে বলেছে স্বাস্থ্য বিভাগ।

নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের অনুমোদন ব্যতীত হ্যালোথেন ক্রয়-বিক্রয় ও ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।

সরকারি ও বেসরকারি দুই ধরনের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত অবেদনবিদদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে চায় সরকার। তাই, তাদের নিয়ে হ্যালোথেনের পরিবর্তে আইসোফ্লুরেন ব্যবহারসংক্রান্ত নির্দেশনা প্রতিপালনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

নতুন অ্যানেস্থেশিয়া মেশিন কেনার ক্ষেত্রে স্পেসিফিকেশন নির্ধারণে স্পষ্টভাবে আইসোফ্লুরেন ও সেভোফ্লুরেন ভেপোরাইজারের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে।

‘চেম্বার বা ডায়াগনস্টিকে অ্যানেসথেসিয়া নয়’

গত ২২ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদফতর একটি অফিস আদেশ জারি করে। বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার পরিচালনার ক্ষেত্রে ১০টি শর্ত আবশ্যিকভাবে প্রতিপালনের নির্দেশনা ছিল এতে।

সেগুলোর অন্যতম হলো, কোনো অবস্থাতেই লাইসেন্সপ্রাপ্ত বা নিবন্ধিত হাসপাতাল ও ক্লিনিক ছাড়া চেম্বারে অথবা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া যাবে না। এছাড়া, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ অবেদনবিদ ছাড়া কোনো ধরনের সার্জারি করা যাবে না।

হাসপাতাল বা ক্লিনিকে লেবার রুম প্রটোকল অবশ্যই মেনে চলতে হবে। অপারেশন থিয়েটারে অবশ্যই অপারেশন থিয়েটার এটিকেট বা শিষ্টাচার মেনে চলতে হবে।

যেকোনো ধরনের সার্জারির জন্য অবশ্যই রেজিস্টার্ড চিকিৎসককে সার্জনের সহকারী হিসেবে রাখতে হবে।

অ্যানেসথেসিয়ায় যে সতর্কতা জরুরি

একটা সময় ছিল যখন অস্ত্রোপচার করা হতো অ্যানেসথেসিয়া ছাড়াই। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সেটি বদলে গেছে। আধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থায় মানব শরীরে ছোট-বড় যেকোনো ধরনের অস্ত্রোপচার করার আগে অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা।

অ্যানেসথেসিয়া দিলে শরীর বা তার কোনো অংশ অবশ হয়ে যায়, ফলে অস্ত্রোপচারের সময় রোগী কোনো ব্যথা অনুভব করেন না। ‘এতে নির্বিঘ্নে অস্ত্রোপচার করে ফেলা যায়’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সাবেক অ্যানেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া।

অ্যানেসথেসিয়ার একাধিক ধরন রয়েছে। যেমন, শরীরের কোনো নির্দিষ্ট অংশে ছোট অস্ত্রোপচার করার সময় কেবল ওই অংশটিকেই অবশ করা হয়। এটি ‘লোকাল অ্যানেসথেসিয়া’ নামেই বেশি পরিচিত। তবে বড় অস্ত্রোপচার করার আগে অনেক সময় পুরো শরীর অবশ করে ফেলা হয়। এসব ক্ষেত্রে রোগী তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় চলে যান এবং একটি নির্দিষ্ট সময় পর আবার জেগে ওঠেন।

ছোট-বড় যা-ই হোক, যেকোনো অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগে রক্ত, হৃদস্পন্দনের হার-সহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে রোগীর বেশ কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানোর বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ‘মূলত রোগীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে এসব পরীক্ষা করা হয়। কোন ধরনের অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া তার জন্য নিরাপদ হবে, এর মাধ্যমে সেটি বোঝা যায়’, বিবিসি বাংলাকে বলেন শাহ আলম ভূঁইয়া।

কাজেই কোনো ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই শরীরে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হলে রোগীর জীবন সংকটাপন্ন, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এছাড়া যাদের জ্বর, ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, শ্বাসকষ্ট, বক্ষব্যাধি বা হৃদযন্ত্রে ত্রুটি আছে, তাদের সে অবস্থায় অ্যানেসথেসিয়া না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন এই চিকিৎসক। ‘এরকম ক্ষেত্রে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়া মোটেও নিরাপদ নয়। বিশেষজ্ঞ চিকিৎকের পরামর্শ নিয়ে সেরে উঠে বা রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখে পরবর্তী সময়ে অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে’, বিবিসি বাংলাকে বলেন ডা. শাহ আলম ভূঁইয়া।

সাম্প্রতিক ঘটনাসমূহ

ভুল চিকিৎসা কিংবা চিকিৎসকের দায়িত্বে অবহেলার কারণে রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ বাংলাদেশে নতুন নয়। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অনেক অভিযোগ ইতোমধ্যে খবর হয়ে এসেছে গণমাধ্যমে।

জানুয়ারির শুরুতে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে লাইফ সাপোর্টে থাকাবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল পাঁচ বছর বয়সী শিশু আয়ান আহমেদের। তাকে ৩১ ডিসেম্বর খৎনা করানোর জন্য হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল পরিবার। কিন্তু অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার পর তার আর জ্ঞান ফেরেনি। এই ঘটনা দেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।

এরপর ফেব্রুয়ারিতে খতনা করাতে গিয়ে মৃত্যু হয় আরেক শিশু আহনাফ তাহমিদের। ঢাকার মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে দশ বছর বয়সী ওই শিশুর মৃত্যু হয়েছিল।

এই দুইটি শিশুর পরিবারেই অভিযোগ ছিল, ‘ফুল অ্যানেসথেসিয়া’ দেওয়ায় মৃত্যু হয় তাদের।

ফেব্রুয়ারিতেই ঢাকার ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে এন্ডোস্কোপি করাতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে রাহিব রেজা নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। তার স্বজনদের অভিযোগ, ল্যাবএইড হাসপাতালে পরীক্ষার রিপোর্ট না দেখেই রাহিব রেজাকে অ্যানেসথেসিয়া প্রয়োগ করা হয়।

স্বজনরা বলেন, ‘শারীরিক জটিলতার মধ্যেই তার এন্ডোস্কোপি করা হয়। যে কারণে তার কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয় এবং এক পর্যায়ে শারীরিক অবস্থা আরও জটিল হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।’

এই ঘটনাগুলো নিয়ে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায় সেগুলো নিয়ে দেশ জুড়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। কিন্তু এর বাইরেও ভুল চিকিৎসা এবং অবহেলায় রোগীর মৃত্যু বা নানা সমস্যার অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। -বিবিসি বাংলা