বেনাপোল প্রতিনিধি : সাধনা আর অধ্যাবসায় থাকলে যে অনেক পথ পাড়ি দেয়া যায় তার জলন্ত প্রমাণ মিজান।একের পর এক আবিষ্কারে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন তিনি।
’একবার না পারিলে দেখ শতবার’ কথাটি বিফলে যায়নি মিজানের বেলায়। সফলতা আজ তার দোরগোড়ায় নতুন নতুন আবিষ্কারের হাতছানি দিচ্ছে। যশোরের র্শাশা উপজেলার এই মোটর সাইকেল মেকানিক মিজান এখন দেশসেরা আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক হতে যাচ্ছেন।
মিজানের একাডেমিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও আজ তিনি নিজের আলোয় আলোকিত। এ যেন অন্ধকারে উৎসারিত আলো। নতুন চিন্তা আর গবেষণায় আজ তার আবিষ্কারের সংখ্যা ৮ টি। তার গবষেণা ও উদ্ভাবন নিয়ে দেশ, জাতি এখন গর্বিত। মিজানের ভবিষ্যত নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছে গোটা দেশ ও জাতি।
শার্শা উপজেলার নিজামপুর ইউনয়িনের আমতলা গাতিপাড়ার অজপাড়া গাঁয়ে ১৯৭১ সালরে ৫ মে জন্মগ্রহণ করেন মিজান। পিতা আক্কাস আলী ও মাতা খোদেজা খাতুন। এখন আর তারা কেউ বেঁচে নেই। পিতা-মাতার ৬ সন্তানের মধ্যে মিজান ৫ম। বর্তমান শার্শা উপজেলা সদরের শ্যামলাগাছি গ্রামে তিনি বাস করনে। দারিদ্র্যের কারণে লেখাপড়া শিখতে পারেননি মিজান। ৮/৯ বছর বয়সেই বেঁচে থাকার তাগিদে নেমে পড়েন মজুরের কাজে। মাঠে শ্যালো মেশিন চালানো এবং মেরামতের কাজ করেন তিনি। পরবর্তীতে নাভারণ বাজারে একটি মোটর সাইকেলের গ্যারেজে কাজ পান তিনি। সেখান থেকেই তার মোটর মেকানিক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়। বর্তমানে শার্শা বাজারে ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসপ নামে একটি মোটর সাইকেলের গ্যারেজ রয়েছে তার। ছোটবেলা থেকেই শখ ছিল নতুন কিছু করা, নতুন কিছু জানা। তবে মেকানিক হিসাবে তার ইঞ্জিন তৈরি করতে প্রবল আগ্রহ।
মিজান প্রথমে উদ্ভাবন করেন হাফ ক্রানসেপ্ট দিয়ে একটি আলগা ইঞ্জিন। এই ইঞ্জিনের সকল যন্ত্রপাতি দেখা যেত বাইরে থেকে। ইঞ্জিনটি একবার জ্বালানি তেল দিয়ে চালু করলে পরবর্তীতে আর তেল লাগতো না। ইঞ্জিনের সৃষ্ট ধোঁয়া থেকে জ্বালানি তৈরি করে নিজে নিজে চলতো ইঞ্জিনটি।
ঢাকার তাজরিন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে শতাধিক শ্রমিকের প্রাণহানির পর মিজান দ্বিতীয় গবেষণা করে উদ্ভাবন করেন স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, যা বাসা বাড়ি, কলকারখানা, অফিস-আদালতে আগুন লাগলে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি রোধে ৫ থেকে ১০ সেকেন্ডের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালু হয়ে আগুন নেভাতে শুরু করে। এটি বিদ্যুৎ না থাকলেও চলবে। এই যন্ত্রটি অল্প জায়গায় রাখা যায়। কোনো জায়গায় আগুন লাগলে যন্ত্রটি তার তাপমাত্রা নির্ণায়ক যন্ত্রের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান নিশ্চিত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম ও লাইট অন করে দেয়। তারপর একইসাথে সংযুক্ত মোবাইল থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে ফোন করে দেয়, পাশাপাশি যন্ত্রটি পানির পাম্পকে সুইচ অন করে দেয়। যা আগুনের অবস্থান নিশ্চিতের ৫/৭ সেকেন্ডের মধ্যেই সম্ভব হয়। অতঃপর পানির পাম্পের সাথে সংযুক্ত পাইপের মাধ্যমে আগুনের অবস্থান পৌঁছে দেয় এবং অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত ফাঁপা বলয়ের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফলে আগুন নিভে যায়। এটি উদ্ভাবনের পর ২০১৫ সালে যশোর জেলা স্কুলের একটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় মিজান এটি প্রদর্শন করে প্রথমস্থান অধিকার করেন।
পরবর্তীতে এটি বিভাগীয় এবং জাতীয় পর্যায়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় প্রথম ও দ্বিতীয়স্থান অধিকার করে। দেশে পেট্রোল বোমায় যখন মানুষের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছিল ঠিক সে সময়ে মিজান উদ্ভাবন করেন তার তৃতীয় উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধ জ্যাকেট। এ জ্যাকেট পরে ড্রাইভার বা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নিরাপদে কাজ করতে পারবেন। এতে করে আগুনের মাঝে গিয়ে জানমাল রক্ষা করার সময় তার শরীরে আগুন স্পর্শ করবে না।
চতুর্থ উদ্ভাবন অগ্নিনিরোধ হেলমেট। এটি ব্যবহার করলে দুর্ঘটনার আগুনে গলার শ্বাসনালি পুড়বে না। পঞ্চম উদ্ভাবন হলো প্রতিবন্ধীদের জীবন-মান উন্নয়নে মোটরকার। এটা বিদ্যুৎ বা পেট্রোলচালিত।
কৃষকদের জন্য স্বয়ংক্রিয় সেচযন্ত্র উদ্ভাবন হলো তার ষষ্ঠ উদ্ভাবন। কৃষকরা দূর-দূরান্তের মাঠে জমিতে পানি দিতে আর ক্ষেতে যেতে হবে না। বাড়ি বসেই সেচযন্ত্রটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বন্ধ বা চালু করতে পারবেন। তাছাড়া এ যন্ত্রটি জমিতে পানির প্রয়োজন হলে নিজে নিজেই চালু হয় এবং পানির প্রয়োজন না থাকলে এটি একা একাই বন্ধ হয়ে যায়। দেশি প্রযুক্তিতে মিজান সপ্তম উদ্ভাবন করেছেন ফ্যামিলি মোটরযান। ব্যবহারযোগ্য এ কার এলাকার মানুষের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে।
মিজানের অষ্টম উদ্ভাবনে রয়েছে পরিবেশ সেফটি যন্ত্র। এটি পরিবেশ রক্ষার্থে বহুমুখী কাজ করে থাকে। যন্ত্রটি বাড়ি, অফিস বা কলকারখানায় ময়লা পরিস্কারের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই এ যন্ত্রটি পরিস্কার করার কাজে ব্যবহার হয়। এ যন্ত্র উদ্ভাবনরে পর ২০১৬ সালের ৫ জুন জাতীয় পর্যায়ে মিজান পরিবেশ পদক লাভ করনে। জেলা, বিভাগ ও জাতীয় পর্যায়ে মিজান এ পর্যন্ত মোট ১৭টি সাফল্য সনদ ছাড়াও পেয়েছেন অসংখ্য ক্রেস্ট ও সম্মাননা পুরস্কার।
এরই মধ্যে তার আবিষ্কৃত দেশীয় প্রযুক্তির মোটরকার প্রধানমন্ত্রীর র্কাযালয়ের এ টু আই প্রকল্পের আওতাভুক্ত হয়েছে। গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নে ছোট ছোট অ্যাম্বুলেন্স তৈরি করার পদক্ষপেও নেওয়া হয়েছে।
খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আ : সামাদ জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে না পড়েও একজন অশিক্ষিত লোক বেশ কিছু নতুন জিনিস আবিষ্কার করে রীতিমত সাড়া ফেলেছে। আমরা তাকে উৎসাহিত করেছি। তিনি ডিজিটাল মেলাসহ জাতীয় পর্যায়ে বেশ কয়েকটি পুুরস্কার পেয়েছেন।
২০১৭ সালে পরিবেশবান্ধব যন্ত্র আবিষ্কারে পরিবেশে অধিদপ্তর। গত ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসে মিজানকে আনুষ্ঠানিকভাবে পরিবেশ পদক প্রদান করে।
মিজান জানান, তার স্বপ্ন দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করা।র্বতমান উদ্ভাবন গবেষণা চলছে দূষিত বায়ু শোধনযন্ত্র আবিষ্কার।