সোমবার, ১৯ মে ২০২৫, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাঁশখালীতে ২০০ একর বনভূমি দখল: সালমান এফ রহমানের ছেলেও জড়িত!

বাঁশখালীতে ২০০ একর সরকারি জমি দখল করে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ তৈরি করেছেন প্রভাবশালীরা। ইউপি চেয়ারম্যান জাল খতিয়ানে সালমান এফ রহমানের ছেলের কাছে ৯৯ একর জমি বিক্রি করেন। আদালতের রায় অমান্য করে জমি দখল অব্যাহত থাকায় বন বিভাগ জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন | প্রকাশিতঃ ১৯ অক্টোবর ২০২৪ | ১১:৪২ অপরাহ্ন

বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলা বাঁশখালীতে সরকারি খাসজমি ও সংরক্ষিত বনভূমি বছরের পর বছর ধরে প্রভাবশালী মহলের দখলে রয়েছে। প্রায় ২০০ একর সরকারি জমি অবৈধভাবে দখল করে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে চিংড়ি ঘের, লবণ মাঠ এবং ব্যক্তিগত স্থাপনা। জাল খতিয়ান তৈরি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে এই জবরদখল চলেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে এই জমি উদ্ধারের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসন এক্ষেত্রে দৃশ্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে, যা আইনের শাসন এবং রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির সুরক্ষার ক্ষেত্রে বড় প্রশ্ন তৈরি করেছে।

জবরদখলকৃত এই সরকারি জমির ইতিহাস বেশ দীর্ঘ ও জটিল। উপকূলীয় বন বিভাগের ছনুয়া রেঞ্জের খুদুকখালী মৌজায় অবস্থিত এই জমি একসময় ‘ফ্রেন্ডস ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯৬৬ সালে ২৫ বছরের জন্য নারকেল বাগান করার শর্তে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ইজারার শর্ত ভঙ্গ করে সেখানে লবণ মাঠ ও চিংড়ি ঘের তৈরি করা হয়। শর্ত ভঙ্গের দায়ে জেলা প্রশাসন দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে ১৯৬৭ সালে ইজারা বাতিল করে দেয়। তবে ইজারাগ্রহীতারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যান। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া শেষে ১৯৮৮ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ জেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বহাল রেখে ইজারা বাতিল ঘোষণা করেন। এর মাধ্যমে জমিটি সম্পূর্ণরূপে সরকারি খাসজমি হিসেবে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আসে। একই সময়ে, এই মৌজার ৯০ একর জমি সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ১৯৮৪ সালে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং এর মধ্যে ১৬ একর জমি সংরক্ষিত বনভূমি হিসেবেও ঘোষণা করা হয়।

আইনিভাবে সরকারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও জমিটি সম্পূর্ণভাবে দখলমুক্ত হয়নি। এর মধ্যে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সালের মধ্যে বন বিভাগ প্রায় ২০০ একর জমিতে পরিবেশ সুরক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনায়ন (বাইন ও কেওড়া গাছ) সৃজন করে। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০০৯ সালের ১ ডিসেম্বর স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের নেতৃত্বে প্রায় ৮০-৯০ জনের একটি দল বন বিভাগের সৃজিত প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার বাইন ও কেওড়া গাছ নির্মমভাবে কেটে ফেলে। এরপর রাতের আঁধারে বুলডোজার দিয়ে বনের মাটি কেটে সেখানে নতুন করে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ তৈরি করে জমিটি জবরদখল করে নেয়।

এই ন্যাক্কারজনক ঘটনায় বন বিভাগের পক্ষ থেকে বাঁশখালী থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার সহযোগীদের আসামি করা হয়। পরবর্তীতে হাইকোর্ট আসামীদের বিরুদ্ধে ওই জমিতে প্রবেশ ও কার্যক্রম পরিচালনার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, আদালতের এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে দখলকারীরা সেখানে নির্বিঘ্নে চিংড়ি ও লবণ চাষ চালিয়ে যেতে থাকে।

দখল প্রক্রিয়াকে পাকাপোক্ত করতে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটে। অভিযোগ উঠেছে, ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার কয়েকজন সহযোগী যোগসাজশ করে খুদুকখালী মৌজার ৯৯ একর সরকারি খাসজমির একটি জাল বিএস খতিয়ান তৈরি করেন। এরপর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে এবং এই জাল দলিলের ভিত্তিতে ওই ৯৯ একর জমি বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের ছেলে আহমেদ সায়ান ফজলুর রহমানের কাছে ‘এস্কর্প হোল্ডিংস লিমিটেড’ নামক একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ৯ কোটি ২৫ লাখ টাকায় বিক্রি করে দেন।

এই ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং উপকূলীয় বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন জাল দলিলের বিষয়টি প্রমাণ করে জমির মালিকানা পুনরায় সরকারের নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়। আইনি জয়লাভ এবং আদালতের রায়ে সায়ান হেরে যাওয়ার পর তিনি আর এই বনভূমির জায়গায় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেননি। তবে আইনিভাবে সরকারের মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হলেও জমিটি অদ্যাবধি আহমেদ সায়ানকে যারা (পলাতক ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার চাচা বশির আহমদের ছেলেদের দখলে আছে বর্তমানে) জাল দলিল সৃজন করে বিক্রি করেছে তাদের দখলে আছে। জাল দলিলে বিক্রি করা হারুন বাহিনীই তাদের প্রভাব ধরে রেখেছে। জমি বিক্রির এই অবৈধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ও তার পরিবারের সদস্যরা বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভবান হয়েছেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এর প্রমাণ হিসেবে দেখা যায়, চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদ ১৫০ শতক জমির ওপর প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি বিলাসবহুল বহুতল ভবন নির্মাণ করেছেন। তার চাচা ও সাবেক চেয়ারম্যান বশির আহমদের ছেলেরাও অবৈধভাবে সরকারি জমি দখল করে সেখানে বিভিন্ন স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

সুপ্রিম কোর্টের রায় ও মালিকানা সরকারের অনুকূলে আসার পরও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জমি উদ্ধারে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াটা রহস্যজনক। ২০১৮ সালের ১১ মার্চ চট্টগ্রাম উপকূলীয় বন বিভাগ জেলা প্রশাসনকে একটি আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে ৯৯ একর জমি দ্রুত দখলমুক্ত করে বন বিভাগের কাছে হস্তান্তরের অনুরোধ জানায়। কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সাত বছর পেরিয়ে গেলেও এই চিঠির কোনো জবাব জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে আসেনি। শুধু তাই নয়, জেলা প্রশাসন থেকেও ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ সহকারী কমিশনার (ভূমি), বাঁশখালীকে জমির বিস্তারিত তথ্য চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাতেও কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। প্রশাসনের এই দীর্ঘসূত্রিতা এবং নিষ্ক্রিয়তা দখলদারদের আরও উৎসাহিত করেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর হারুনুর রশীদ পলাতক হলেও বন বিভাগ দখলমুক্ত করার একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। ২৬ আগস্ট বন বিভাগের কর্মকর্তারা দখলকৃত এলাকায় গিয়ে জমির সীমানা নির্ধারণ করে লাল পতাকা উত্তোলন করে জমিটি দখলমুক্ত ঘোষণা করেন। তবে বন বিভাগের এই উদ্যোগ ছিল অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী। অভিযোগ উঠেছে, পলাতক ইউপি চেয়ারম্যান হারুনুর রশীদের অনুগত ক্যাডাররা এবং সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম বশির আহমদের ছেলেদের প্রভাব খাটিয়ে দ্রুতই ওই এলাকার বন বিভাগের উত্তোলন করা লাল পতাকা ছিঁড়ে ফেলে এবং পুনরায় জমিটির দখল নিয়ে নেয়। এই ঘটনা প্রমাণ করে স্থানীয় পর্যায়ে দখলদারদের প্রভাব কতটা শক্তিশালী।

স্থানীয় বাসিন্দারা এই পরিস্থিতি নিয়ে গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একজন বাসিন্দা জানান, দখলদাররা শুষ্ক মৌসুমে জমিতে লবণ চাষ এবং বর্ষা মৌসুমে চিংড়ি চাষ করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। স্থানীয় সাবেক চেয়ারম্যান রেজাউল হক চৌধুরী এই জমি দখলমুক্ত করার জন্য দুই হাজার লোক দিয়ে সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিলেও বন বিভাগের কর্মকর্তারা অজানা কারণে সেই প্রস্তাবে সাড়া দেননি।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে উপকূলীয় বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন জানান, তাদের হাতে হাইকোর্টের রায় রয়েছে, কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার মূল দায়িত্ব জেলা প্রশাসনের। তারা জেলা প্রশাসনকে একাধিকবার চিঠি দিয়েছেন কিন্তু কোনো সাড়া পাননি।

বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জেসমিন আক্তার জানান, তারা এখনো জেলা প্রশাসন থেকে এই জমি সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা পাননি। নির্দেশনা পেলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তিনি জানান।

যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে ইউপি চেয়ারম্যান এম. হারুনুর রশীদের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। স্থানীয় সূত্রমতে, সরকার পরিবর্তনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, বাঁশখালীর খুদুকখালীর এই প্রায় ২০০ একর সরকারি খাসজমি ও বনভূমি জবরদখলের ঘটনাটি বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি বেদখল এবং আইন ও প্রশাসনের শিথিলতার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। সর্বোচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশ, বন বিভাগের পক্ষ থেকে বারবার অনুরোধ এবং পরিবেশগত গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও জেলা প্রশাসনের দীর্ঘ সাত বছরের বেশি সময়ের নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক। প্রভাবশালীদের ক্ষমতার দাপট কিভাবে আইনি প্রক্রিয়া এবং প্রশাসনিক উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে, এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ।

তিনি আরও বলেন, বনভূমি ধ্বংস করে অবৈধভাবে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ তৈরি উপকূলীয় পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি। জনগণের প্রত্যাশা, দ্রুততম সময়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে এই মূল্যবান সরকারি সম্পত্তি দখলমুক্ত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে এবং দায়ী প্রভাবশালী সিন্ডিকেটকে জবাবদিহিতার আওতায় আনবে। অন্যথায়, এমন ঘটনা ভবিষ্যতে আরও ঘটবে এবং সাধারণ মানুষ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর আস্থা হারাবে।