
মাওলানা শামছুল ইসলাম হাকেমী : হজ-প্রতিটি মুসলিমের জীবনের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত ইবাদত। পবিত্র কাবা শরীফে গিয়ে হজ পালন করার স্বপ্ন প্রতিটি মুমিনের হৃদয়ে জ্বলজ্বল করে। কিন্তু যখন সরকার হজের খরচ কমানোর নামে এমন কৌশল নেয় যা হাজীদের জন্য আরও কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তখন প্রশ্ন জাগে-এটা কি সত্যিই সেবা নাকি এক নির্মম প্রহসন?
সরকার সম্প্রতি ২০২৫ সালের হজের জন্য দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। প্রথমটি ‘আজিজিয়া প্যাকেজ’ নামে পরিচিত, খরচ ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকা। দ্বিতীয়টি ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে খরচ কমেছে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?
সরকার এবার প্যাকেজ থেকে খাবারের খরচ বাদ দিয়েছে। প্রত্যেক হাজীকে খাবারের জন্য ৪০,০০০ টাকা এবং কুরবানির জন্য ৭৫০ সৌদি রিয়াল (প্রায় ২৩,৮৫৯ টাকা) নিজে বহন করতে হবে। আগের বছরগুলোতে খাবারের খরচ প্যাকেজের মধ্যে ছিল। তাহলে খরচ কমলো কোথায়? বরং বেড়েছে! গত বছর দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মধ্যে আবাসন-খাবারসহ প্যাকেজের খরচ ছিল ৫ লাখ ৭৮ হাজার ৮৪০ টাকা। এবার খাবার বাদ দিয়ে খরচ ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। খাবারের খরচ যোগ করলে মোট খরচ দাঁড়ায় ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬৮০ টাকা। অর্থাৎ, খরচ কমার বদলে বেড়েছে প্রায় ৩৬,৮৪০ টাকা!
৪ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ টাকার আজিজিয়া প্যাকেজে আবাসন কাবা শরীফ থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। আমাদের অধিকাংশ হাজী বয়স্ক, তাদের জন্য এই দূরত্ব থেকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা কী পরিমাণ কষ্টকর হবে, তা কেবল ভাবলেই হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে যায়। হজের সময় মক্কায় গাড়ি চলাচল সীমিত। পায়ে হেঁটে দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করা বয়স্কদের জন্য প্রায় অসম্ভব। বাসে যাতায়াতের সুবিধা থাকলেও সময় মেনে চলা, যানজট এবং ভিড়ের কারণে তা আরও দুর্বিষহ।
আমরা দেখেছি, বাংলাদেশি হাজীরা সময় মেনে চলতে পারেন না। কেউ ঘুমিয়ে থাকেন, কেউ বা অন্য কাজে ব্যস্ত। ফলে বাস মিস করা যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। অন্যদিকে, বিদেশি হাজীরা সময়ানুবর্তী এবং তাদের বয়সও কম। কিন্তু আমাদের বয়স্ক হাজীদের জন্য এই দূরত্ব থেকে হারাম শরীফে গিয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা কী পরিমাণ কঠিন হবে, তা কি কেউ অনুভব করছেন?
মিনায় ‘ডি’ ক্যাটাগরির সার্ভিসে এয়ার কন্ডিশনের কোনো নিশ্চয়তা নেই। মক্কা ও মদিনায় প্রতি রুমে ছয়জনের আবাসন ব্যবস্থা-হাজীদের জন্য এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। বয়স্কদের জন্য এতজনের সাথে শেয়ার করে থাকা কতটা কষ্টকর, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের উচিত ছিল এসব মানবিক বিষয় বিবেচনা করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা।
সরকার বলছে, বিমান ভাড়া কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু সেটা কি যথেষ্ট? ২০১৯ সালে ভাড়া ছিল ১ লাখ ২৮ হাজার টাকা, যা ২০২৩ সালে বেড়ে ১ লাখ ৯৭ হাজার টাকায় পৌঁছেছে। এবার কিছুটা কমানো হলেও, তা এখনো আকাশচুম্বী। ওমরার সময় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের প্রতিযোগিতার কারণে ভাড়া কম থাকে। হজের সময় অন্য এয়ারলাইন্সকে অনুমতি দিলে ভাড়া অনেক কমানো সম্ভব হতো।
বাংলাদেশ সরকারের সাথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এবং সৌদি এয়ারলাইন্সের চুক্তির কারণে অন্য কোনো এয়ারলাইন্স হজ যাত্রী পরিবহন করতে পারে না। এই একচেটিয়া ব্যবসার ফলে বিমান ভাড়া বেড়েই চলেছে। সিন্ডিকেট ভেঙে তৃতীয় ক্যারিয়ার বিমান সংস্থাগুলোকে সুযোগ দিলে প্রতিযোগিতা বাড়ত, ভাড়া কমত, হাজীরা উপকৃত হতেন।
বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো সরকারের প্যাকেজের সাথে সমন্বয় করতে হিমশিম খাচ্ছে। এত দূরে আবাসন দিলে হাজী পাওয়াই কঠিন হয়ে যায়। ডলার ও সৌদি রিয়ালের মান বৃদ্ধির কারণে খরচ আরও বেড়েছে। তারা সাধারণত ১,২০০ মিটারের মধ্যে প্যাকেজ ঘোষণা করে। এবার সরকারি প্যাকেজের সাথে সমন্বয় করা তাদের জন্য প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
সরকার কি সত্যিই হাজীদের কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করছে, নাকি খরচ কমানোর নামে সুবিধা কমিয়ে তাদের আরও বিপাকে ফেলছে? হজ একটি পবিত্র ইবাদত। এতে কোনো প্রকার কষ্ট বা বিঘ্ন না ঘটে, তা নিশ্চিত করা সরকারের নৈতিক দায়িত্ব। কিন্তু বর্তমান প্যাকেজগুলো দেখে মনে হচ্ছে, সরকার শুধু বাহ্যিক প্রদর্শনীতে ব্যস্ত, বাস্তবে হাজীদের কষ্টের পাহাড় বাড়িয়ে দিয়েছে।
সরকারের করণীয় কী ছিল? বিমান ভাড়া কমানো। তৃতীয় ক্যারিয়ার বিমান সংস্থাগুলোকে অনুমতি দিয়ে প্রতিযোগিতা বাড়িয়ে বিমান ভাড়া কমানো উচিত ছিল। হাজীদের কাছে আবাসন নিশ্চিত করে তাদের কষ্ট লাঘব করা প্রয়োজন ছিল। খাবারের খরচ প্যাকেজে রেখে প্রকৃত খরচ নির্ধারণ করা উচিত ছিল। মিনায় এয়ার কন্ডিশনসহ সেবা নিশ্চিত করা এবং রুমে মানুষের সংখ্যা কমানো উচিত ছিল।
হজের খরচ কমানোর নামে সরকারের এই নির্মম কৌশল কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। হাজীদের কষ্টের কথা বিবেচনা করে, তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা নিশ্চিত করে হজ প্যাকেজ ঘোষণা করা উচিত ছিল। হজ পালন মুসলিমদের ধর্মীয় কর্তব্য, এবং এতে কোনো প্রকার কষ্ট বা বিঘ্ন না ঘটে তা নিশ্চিত করা সরকারের পবিত্র দায়িত্ব। আমরা জোরালোভাবে আশা করি, সরকার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করবে এবং হাজীদের জন্য সত্যিকারের সাশ্রয়ী ও মানবিক হজ প্যাকেজ ঘোষণা করবে।
লেখক : কলামিস্ট