বুধবার, ৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

নবায়নযোগ্য শক্তি কি বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের সমাধান?

প্রকাশিতঃ ১৯ নভেম্বর ২০২৪ | ৯:২৬ পূর্বাহ্ন


নজরুল কবির দীপু : নবায়নযোগ্য শক্তি বর্তমান বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি এমন শক্তি, যা প্রকৃতির অবিরাম প্রক্রিয়ায় পুনরায় উৎপাদিত হয় এবং তুলনামূলক স্বল্প সময়ে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য হয়। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জলবিদ্যুৎ এবং বায়োগ্যাস। জীবাশ্ম জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কারণে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং বিদ্যুতের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে বাংলাদেশেও নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনা অনেক বেশি।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তির জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। বিষুবরেখার সন্নিকটে হওয়ায় বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৪.৫ কিলোওয়াট আওয়ার/বর্গমিটার সৌর বিকিরণ পাওয়া যায়। এটি সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য একটি অত্যন্ত উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করেছে। বিশ্বব্যাংকের তৈরি সৌরসম্পদের মানচিত্র অনুযায়ী, দেশের দক্ষিণাঞ্চল, উপকূলীয় দ্বীপসমূহ এবং পার্বত্য এলাকাগুলো সৌরশক্তি উৎপাদনের জন্য বেশি উপযোগী।

একটি সমীক্ষায় জানা গেছে, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বোচ্চ উৎপাদন সক্ষমতা ২৪০ গিগাওয়াট হতে পারে। বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রধান উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি। ২০২৪ সালের স্রেডার প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে সৌরশক্তি থেকে ১০৮৪.৫৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, যা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৩ শতাংশ।

তুলনামূলকভাবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে রয়েছে। সানেমের ২০২৩ সালের বিশ্লেষণ অনুসারে, ভারত নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ২৩ শতাংশ এবং পাকিস্তান ৪৩ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এসব পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট হয়, নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে আরো এগিয়ে আসতে হবে।

জীবাশ্ম জ্বালানির সীমিত মজুত এবং এর ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরতা বাংলাদেশে বড় অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করতে পারে। জ্বালানি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, কোনো নতুন প্রাকৃতিক গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে এবং বর্তমান হারে ব্যবহার অব্যাহত থাকলে, ২০২৫-২০৩১ সালের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত শেষ হয়ে যেতে পারে। এর ফলে আমদানি করা তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ওপর নির্ভরতা বাড়বে, যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল।

জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কেবল অর্থনৈতিক সংকট নয়, পরিবেশের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে। গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। পাশাপাশি, জীবাশ্ম জ্বালানির ধোঁয়া এবং দূষিত কণার কারণে শ্বাসকষ্টজনিত রোগসহ নানা স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়।

পক্ষান্তরে, নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহার করলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানো সম্ভব। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে এবং স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি হ্রাস করে। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তি অর্থ সাশ্রয়ের মাধ্যমেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, কেবল ২ গিগাওয়াট নবায়নযোগ্য শক্তি স্থাপন করলে প্রতি বছর জ্বালানি আমদানি খাতে ১.১ বিলিয়ন ডলার সাশ্রয় সম্ভব।

তবে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পগুলোর জন্য প্রারম্ভিক বিনিয়োগ অত্যন্ত বেশি। এটি অনেক সময় উন্নয়নশীল দেশের জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে।

দ্বিতীয়ত, নবায়নযোগ্য শক্তি উৎপাদনের পর তা সংরক্ষণ করতে উন্নত ব্যাটারি ব্যবস্থার প্রয়োজন হয়। এই ব্যাটারিগুলো অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং এগুলো সংরক্ষণে দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পরিকল্পনার অভাব রয়েছে।

তৃতীয়ত, সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য বড় পরিমাণ জমি প্রয়োজন। বাংলাদেশে জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি হওয়ায় বসতি ও কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়।

চতুর্থত, নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারি নীতির অস্পষ্টতা এবং আর্থিক সহায়তার অভাব অন্যতম প্রধান বাধা। এ খাতের উন্নয়নে বেসরকারি খাত এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে যৌথ সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।

নবায়নযোগ্য শক্তির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হলে সুদূরপ্রসারী এবং টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সমীক্ষা অনুযায়ী, দেশের মোট জমির মাত্র ৪ শতাংশ ব্যবহার করেই নবায়নযোগ্য শক্তির মাধ্যমে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো সম্ভব। জমির সংকট মেটাতে ভবনের ছাদে সৌর প্যানেল স্থাপন, ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প এবং স্মার্ট গ্রিড প্রযুক্তি কার্যকর সমাধান হতে পারে।

নবায়নযোগ্য শক্তি প্রকল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারকে আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সহযোগিতা নিতে হবে। এ ছাড়া, ক্লাইমেট ফান্ড গঠন করে সহজ ঋণ এবং সরকারি ভর্তুকি নিশ্চিত করা যেতে পারে। বেসরকারি খাতকেও এ খাতে বিনিয়োগে উৎসাহিত করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়িয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা এবং আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য শিল্পে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে টেকনিক্যাল ট্রেনিং এবং প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন গুরুত্বপূর্ণ।

নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংকট দূর করার পাশাপাশি পরিবেশ সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। এটি কেবলমাত্র একটি বিকল্প শক্তি নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে। সঠিক পরিকল্পনা, আর্থিক সহায়তা এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নবায়নযোগ্য শক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য শক্তির বিপ্লব ঘটানোর।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।