ঢাকা : গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশের ব্যাংক খাতে লুটপাটের ভয়ংকর চিত্র উঠে এসেছে। এ সময়ে বিপুল অঙ্কের টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ব্যাংক খাতের দুর্নীতি ও ঋণখেলাপি নিয়ে তথ্য গোপন রাখা হতো। কিন্তু ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর এ চিত্র ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
সিপিডির এক গবেষণা অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে ২৪টি বড় কেলেঙ্কারির ঘটনায় প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা লুট হয়েছে। এর বাইরেও এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো এবং নাসা গ্রুপের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলো ভয়ংকর জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকা লুটপাট করেছে।
এস আলম গ্রুপ একাই ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই ৬৫ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় এস আলমের অনিয়ম ও লুটপাটের পরিমাণ অনেক বেশি।
সরকারের পতনের পর ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দ্রুত বেড়েছে। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা। জুনে এটি বেড়ে হয় ২ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরের মধ্যে এই অঙ্ক আরও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা।
খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনার প্রেক্ষিতে আগামী মার্চে এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। বর্তমানে কোনো ঋণ ছয় মাস পর খেলাপি ধরা হলেও আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী তিন মাস পর থেকে ঋণ খেলাপি গণ্য হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এস আলম গ্রুপের পুরো ঋণ খেলাপি হলে এটি ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকায় পৌঁছাবে। বেক্সিমকো গ্রুপ তাদের ৩৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধে অক্ষমতা প্রকাশ করেছে। নাসা গ্রুপের ঋণের বড় অংশও খেলাপি হওয়ার পথে।
খেলাপি ঋণ বাড়ায় ব্যাংকগুলোতে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেপ্টেম্বরে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৫৬ হাজার কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি এবং তারল্য সংকট আরও প্রকট হবে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যেও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলো এখন অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) নিতে চাইছে না। এর ফলে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে, যা পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে।
বর্তমানে ডলার সংকটের কারণে বেসরকারি ব্যাংকগুলো এলসি কম করছে। তবে সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই হার বেড়েছে। সরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার এখন ৪০ শতাংশ ছাড়িয়েছে।
নতুন সরকার লুটপাট ও অর্থ পাচার বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে ডলারের সরবরাহ বেড়েছে এবং ব্যাংক খাতে তারল্য ফিরে আসতে শুরু করেছে। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোতে সংকট এখনও কাটেনি।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। লুটপাট ও ঋণখেলাপির এই চিত্র ভবিষ্যতের অর্থনীতিতে ভয়ংকর প্রভাব ফেলতে পারে। তাই সরকারের কড়া নজরদারি ও কার্যকর নীতি প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।