একুশে ডেস্ক : কর্মসংস্থান ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার মীর মোহাম্মদ শাহীন সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন তার বিরুদ্ধে উঠা গুরুতর অভিযোগের কারণে। ২০১১ সালে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে ব্যাংকটিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। এ পর্যন্ত তার কর্মজীবন প্রায় ১৪ বছর পূর্ণ হয়েছে, এবং এই সময়কালে একাধিক পদোন্নতিও পেয়েছেন। তার বেতন-ভাতা বেড়েছে, তিনি নিজের পছন্দমতো ব্রাঞ্চে কাজ করেছেন এবং নানা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছেন। তবে সম্প্রতি তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ উঠে এসেছে, যা ব্যাংকটিতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
মীর মোহাম্মদ শাহীনের পদোন্নতি, বেতন বৃদ্ধি এবং সুবিধাগুলি তার দক্ষতা ও কর্মনিষ্ঠার ফল হিসেবে বিবেচিত ছিল। কর্মসংস্থান ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর থেকে তিনি অনেকেই প্রশংসিত হন তার পেশাদারিত্ব এবং কাজের প্রতি দায়বদ্ধতার জন্য। তবে, মানবজমিনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে যে, তার নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু সন্দেহজনক তথ্য রয়েছে, যা একটি বড় ধরনের জালিয়াতির ইঙ্গিত দেয়।
শাহীনের নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং তার কর্মজীবন নিয়ে যে তথ্য বেরিয়ে এসেছে, তা সত্যিই অবাক করার মতো। মানবজমিনের অনুসন্ধানে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, শাহীনকে সিনিয়র অফিসার পদে নিয়োগ দেওয়ার সময় তার নামের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু কাগজপত্র এবং নথির সঙ্গে বড় ধরনের গরমিল ছিল। বিশেষ করে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে সকল নথিপত্র দাখিল করা হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে গুরুতর অসঙ্গতি ও জালিয়াতির প্রমাণ মিলেছে।
প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, শাহীন যে কাগজপত্র জমা দিয়েছিলেন, তা যাচাই-বাছাইয়ের পর দেখা যায় অনেকগুলো নথি ভুয়া ছিল এবং কিছু নথির উপর জাল সিল রয়েছে। বিশেষত মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাওয়ার জন্য যে সকল প্রমাণপত্র প্রয়োজন ছিল, সেগুলোতে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছিল এবং কিছু ক্ষেত্রে সরাসরি জালিয়াতি ঘটানো হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তার পরিবারের সদস্যদের নাম এবং তাদের সাথে সম্পর্কিত নথি।
এছাড়াও, শাহীনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে আরও কিছু দুর্বলতা এবং অস্বাভাবিকতা পাওয়া গেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে যে, শাহীন তার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মাধ্যমে কিছু অস্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেছেন।
যেহেতু শাহীনের চাকরির শুরু থেকেই অনেকেই তাকে একজন নির্ভরযোগ্য এবং কঠোর পরিশ্রমী অফিসার হিসেবে চিনতেন, তাই তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ শোনা অনেকের জন্য একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ কিছু সূত্র জানায়, “তিনি একেবারে আত্মবিশ্বাসী এবং দায়িত্ববান একজন কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার কাজের দক্ষতা এবং সুনাম অনেকের মধ্যে প্রশংসিত ছিল। তবে, এখন তার বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠলে সবাই হতবাক।”
এখন প্রশ্ন উঠেছে, এত বছর ধরে কীভাবে তার জালিয়াতি ধরা পড়েনি? ব্যাংক কর্তৃপক্ষও অবাক হয়ে গেছে, কেন তারা তার নিয়োগ এবং পরবর্তী পদোন্নতির সময় এই বিষয়গুলো যাচাই করেনি। এদিকে, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্রুত একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এবং তারা পুরো বিষয়টি খতিয়ে দেখছে।
শাহীন নিজে শুরুতে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। তিনি দাবি করেছেন, “আমার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি সবসময় সৎভাবে কাজ করেছি এবং ব্যাংকটির জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করেছি।” তবে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের তদন্তে এ পর্যন্ত যেসব প্রমাণ পাওয়া গেছে, তা তাকে দায়ী করে।
তদন্ত কমিটির সদস্যরা জানিয়েছেন, যদি প্রমাণিত হয় যে, শাহীন তার নিয়োগ এবং পদোন্নতির জন্য জালিয়াতি করেছেন, তবে তাকে তীব্র শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। ব্যাংকটির নীতিমালা অনুযায়ী, এমন ধরনের ঘটনা ঘটানোর জন্য তিনি চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে পারেন, এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া, এই ঘটনায় আরও কিছু কর্মকর্তার নামও আসতে পারে, যারা শাহীনের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাকে সহায়তা করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তাদের দায়িত্বও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। যদি তদন্তে কোনো কর্মকর্তারও জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনুসন্ধান বলছে, শুধুমাত্র মীর মোহাম্মদ শাহীন একাই নয়, ২০১১ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া গেজেট নম্বর বসিয়ে ব্যাংকটিতে অন্তত ১৪৫ জন চাকরি নিয়েছেন। সকলেই বহাল তবিয়তে আছেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়াদের কেউ কেউ এখন সহকারী মহাব্যবস্থাপক, সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, প্রিন্সিপাল অফিসার, সিনিয়র অফিসার, অফিসার, সহকারী অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অফিসার পদে পদোন্নতি পেয়েছেন। কেউ কেউ ২ থেকে ৩ বারও পদোন্নতি পেয়েছেন। অনেকে পছন্দমতো নিজ জেলায় চাকরি করছেন। সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন।
ভুয়া গেজেট নম্বরে যারা নিয়োগ পেয়েছেন: চাকরিতে নিয়োগের সময় সিনিয়র অফিসার, অফিসার, সহকারী অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অফিসার হিসেবে নিয়োগ পাওয়া প্রত্যেকেই পদোন্নতি পেয়ে এখন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার (এসপিও) হিসেবে কর্মরত আছেন। তারা হলেন- রাসেল আহমেদ, মামুনুর রশীদ, খালেদ সাইফুল্লাহ, বাসুদেব মণ্ডল, সালমা রহমত, মুহাম্মদ শরিফুল ইসলাম, সেলিম রেজা, ইমতিয়াজ হায়াত খান, মীর মোহাম্মদ শাহীন, মোবারক হোসেন, সাঈমা হাশেম, মোহাম্মদ মোরশেদ মিয়া, এসএম সেলিম রেজা, সরকার মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক, একেএম রেজাউল কবীর খান, নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, আরজুমান আরা, রাশেদা বেগম, মোহাম্মদ মহিউদ্দিন রাসেল, মোসাম্মৎ শিউলী সুলতানা, খন্দকার মোবাশ্বের হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম, রাসেল সরকার, শেখ মুঞ্জীল আলী, মোহাম্মদ মাহমুদুল হক খান, নুরুজ্জামান মিয়া, শাহনেওয়াজ হক, ফেরদৌসী সুলতানা, আশরাফুল ইসলাম, মাহফুজা আখতার, কাজী লাইলুম মুনীরা, সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন, মাহমুদা আক্তার, সুব্রুত মজুমদার, এনামুল হক, মোহাম্মদ কামরুল হাসান, মোহাম্মদ ইব্রাহিম মজুমদার, আমির হোসেন মোল্লা, আলী আক্কাছ মিজি, সৈয়দা সোহেলী পারভীন, মোশাররফ হোসেন, খলিফা কামরুল হাসান, কাজী গোলাম শোয়েব, আতিকুর রহমান খোশনবীশ, মতিউর রহমান, আনিসুর রহমান, কবির হোসেন, ঝর্ণা রায়, সাবরিনা মমতাজ সাবিনা, নাজিয়া জাফরিন, এস এম সফিউল আজম, সজল কুমার মণ্ডল, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ আমিন খালিদ চকদার, বিদ্যুৎ কুমার সরকার, পল্লব কুমার সেন, মৃদুলেন্দু বড়াল, মোহাম্মদ মাসুদ, মোহাম্মদ আবদুল রহমান, এ বি সালেহীন, মৌসুমী ইসলাম সুমী, মাহবুব আলম, শাহরিয়ার রুবেল, হাফিজুর রহমান, মীর মো. রবিউল আলম, সেলিম রেজা, মোহাম্মদ বদরুল আলম, রেজাউল আলম, এসএম নুরুদ্দিন, মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন, মাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন, আব্দুস সালাম, মুনতাসির নাজিম দোলন, মো. নাদিম, আব্দুল্লাহ আল হাদী, এটিএম নাজমুস সাকলাইন, আজিজুর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, ইসমেতারা ইসলাম রিমি, মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম, আসকে নবী ফাজলে রাব্বী, মোহাম্মদ মাসকুর রহমান, এএসএম মুশফিকুর রহমান, ফয়সাল আহমেদ, সাইদুল ইসলাম, মুহাম্মদ আল আমিন, নাছরিন আক্তার, বিপিন মজুমদার, সেকেন্দার আলী, গোলাম ওয়াদুদ, খন্দকার মেহেদী হাসান, জাকির হোসেন, রাশিদুল ইসলাম, মনজুর রহমান, ফারহানা ইয়াছমিন, রাশিদুল আলম, মোহাম্মদ জান্নাতুল হাসান, আবুল হোসেন, রাসেলুজ্জামান, সোনিয়া রহমান, লায়লা আখন্দ রিয়ান, মাজহারুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির ও সোহানুর রহমান। তবে ভুয়া সনদে চতুর্থ শ্রেণিতে নিয়োগ পাওয়া ৩৮ জন এমএলএসএস ও নিরাপত্তা প্রহরী কেউই এখনো পদোন্নতি পাননি। এদের মধ্যে কেউ কেউ চাকরিতে থেকেই উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছেন।
ব্যাংকটি মনে করছে, এই ঘটনা তাদের গ্রাহকদের প্রতি বিশ্বাস এবং আস্থা নষ্ট করতে পারে। তাই তারা তৎক্ষণাৎ পদক্ষেপ নিয়েছে, যাতে করে ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনা আর না ঘটে। এছাড়া, ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় আরও কঠোর পর্যবেক্ষণ এবং যাচাই-বাছাই ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
ভুয়া সনদে চাকরি নেয়া কর্মসংস্থান ব্যাংকের আরেক সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার শাহনেওয়াজ খান বলেন, আমি কোটায় নিয়োগ পেয়েছি। নাকি সাধারণ নিয়োগ হয়েছে তা মনে করতে পারছি না। তবে আমার পিতার মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে। তাহলে মন্ত্রণালয়ের তালিকায় নাম নেই কেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, আমি চাকরি পাওয়ার পরে আমার বাবার সনদ হয়েছে। পরে উপজেলা তালিকায় নাম না থাকার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
ইমতিয়াজ হায়াত খান নামের আরেক প্রিন্সিপাল অফিসার বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগ পাইনি। আমার পিতা মুক্তিযোদ্ধা নয়। পরে ব্যাংক থেকে পাঠানো তালিকায় কোটায় নিয়োগ পেয়েছেন এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এমন হওয়ার কথা নয়। ব্যাংক হয়তো ভুল করেছে।
জানতে চাওয়া হলে কর্মসংস্থান ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) এস এম এমাম মাসুম বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা চেয়েছিল। আমরা ইতিমধ্যে তালিকা পাঠিয়ে দিয়েছি। এখন চাকরি পাওয়াদের কে আসল কে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদে চাকরি নিয়েছেন, তা আমাদের জানা নেই। যদি এমন কিছু হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মন্ত্রণালয় থেকে এখনো আমাদের কিছু জানানো হয়নি। মন্ত্রণালয় ক্লিয়ারেন্স দিলে আমাদের পরবর্তী প্রসিডিউর শুরু হবে।
১৪৭ জন ব্যক্তি কীভাবে ভুয়া গেজেট নম্বর দিয়ে চাকরি পেলো- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসলে আমি নিয়োগ পেয়েছি ১ বছর হয়েছে। তাই কীভাবে কী হয়েছে তা আমি অবগত নই। আমি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি জানাবো।