মোহাম্মদ বেলাল উদ্দিন, বাঁশখালী (চট্টগ্রাম) : বাঁশখালী উপকূলে ২৯৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বেড়িবাঁধ, নির্মাণের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই সাগরে বিলীন হওয়ার পথে। উপজেলার খানখানাবাদ ইউনিয়নের কদমরসুল ও প্রেমাশিয়া এলাকায় বাঁধের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
প্রেমাশিয়া ও কদমরসুলের মাঝামাঝি অংশে তিনটি স্থানে বড় ধরনের ভাঙন দেখা দিয়েছে, যা বাঁধের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে। শুধু ভাঙনই নয়, বাঁধের যে সামান্য অংশ এখনও টিকে আছে, সেখানেও বড় বড় ফাটল ধরেছে এবং তা ক্রমশ নিচের দিকে দেবে যাচ্ছে, যা আরও বড় বিপদের ইঙ্গিত। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জিও ব্যাগ ব্যবহার করে ভাঙন প্রতিরোধের চেষ্টা করলেও তা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে।
খানখানাবাদ ইউনিয়ন ভূমি অফিসের পশ্চিমে বাঁধের অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়; সেখানে মাত্র এক থেকে দেড় ফুট অংশ অবশিষ্ট আছে। কদমরসুলের হাছিয়াপাড়া অংশে বেড়িবাঁধের কোনো চিহ্নই অবশিষ্ট নেই। কদমরসুল বড় মাওলানা মাজার এলাকায় বালিয়াড়ি ও বাঁধের উচ্চতা প্রায় সমান হওয়ায় সামান্য জলোচ্ছ্বাসেই লোকালয়ে পানি প্রবেশ করার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
খানখানাবাদের আজিম উদ্দিন মাওলানা বাড়ি ও কালা গাজীপাড়ার পশ্চিমেও বাঁধের বেশিরভাগ অংশ বিলীন হয়ে গেছে। রত্নপুরের হালিয়াপাড়া অংশে তো কোনো কাজই করা হয়নি, যা সেখানকার বাসিন্দাদের জন্য চরম ঝুঁকির কারণ।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, বাঁধের এই করুণ অবস্থার প্রধান কারণ হল অপরিকল্পিত নকশা এবং নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রীর ব্যবহার। তাদের মতে, শুরু থেকেই নির্মাণকাজে গাফিলতি ছিল, যার ফলস্বরূপ আজ এই পরিণতি।
অন্যদিকে, পাউবোর কর্মকর্তারা এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। তাদের দাবি, সাঙ্গু নদীর মোহনায় চর জেগে ওঠায় নদীর স্বাভাবিক স্রোতের গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে এবং সেই পরিবর্তিত স্রোত সরাসরি বাঁধের উপর আঘাত হানছে। এই কারণে বাঁধের কিনারে গভীর খাড়ি তৈরি হয়েছে, যা ভাঙনকে আরও ত্বরান্বিত করছে।
অর্থাৎ, স্থানীয়রা যেখানে নির্মাণ ত্রুটিকে দায়ী করছেন, পাউবো সেখানে প্রাকৃতিক কারণকে সামনে আনছে।
বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় বাঁশখালীর স্থানীয় বাসিন্দারা এক চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের স্থায়ী ঝুঁকিতে তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ১৯৯১ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালীতে অসংখ্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল, সেই স্মৃতি আজও তাদের মনে গভীর ক্ষত হয়ে আছে। ২০১৬ সালের ঘূর্ণিঝড় রোয়ানুও এই এলাকায় সাতজনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
শুধু প্রাণহানিই নয়, বেড়িবাঁধের ভাঙনের কারণে এখানকার মানুষ বারবার ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। জলোচ্ছ্বাস আর ঝড়ের তান্ডবে তাদের বসতভিটা, সহায় সম্বল সবকিছু মুহূর্তেই ভেসে যায়। ফলে, তাদের জীবনযাত্রা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং তারা অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। বারবার ঘরবাড়ি হারানোর কারণে তাদের মধ্যে এক স্থায়ী আতঙ্ক বিরাজ করছে, যা তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তুলেছে।
কদমরসুল এলাকার বাসিন্দা শাহেদুল আলম বলেন, ‘প্রতি বছরই বর্ষাকাল ও ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মূলত সংস্কারের নামে নিম্ন মানের সামগ্রী দিয়ে কাজ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার ও পাউবোর কর্মকর্তারা বাঁধের টাকা লুটপাট করেছেন। নামের স্থায়ী বেড়িবাঁধ স্থায়ী হলো কোথায়?’
বেড়িবাঁধ ঘেঁষা নুরুদ্দিনের বাড়ির যৌথ সাত পরিবারের মধ্যে একমাত্র জালাল উদ্দিনের পরিবার টিকে আছে। তিনি বলেন, ‘এক প্রকার সাগরের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে আছি। ১৯৯১ সালের পর অন্তত ছয়বার ঘর তৈরি করেছি। প্রতিবার জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ভেসে গেছে। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করতে দেখে ঋণ নিয়ে ঘর করেছি। দুই বছর না যেতেই বেড়িবাঁধ আবার ভেঙে গেছে। এখন ঝড় হলে আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটে।’
বাঁশখালী উপকূলে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সাড়ে ৯ বছর আগে প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের বাজেট ছিল ২৫১ কোটি টাকা। কিন্তু পরবর্তীতে প্রকল্পের কাজ চলাকালীন বিভিন্ন কারণে এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৯৩ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। এই প্রকল্পের অধীনে বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদীর পাড়ে ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল।
এই প্রকল্পের কাজ চলাকালীন সময়েই নির্মাণকাজে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃক বেড়িবাঁধে ব্যবহৃত বিভিন্ন ব্লকের মান পরীক্ষা করা হয়। সেই পরীক্ষায় মোট ১১ হাজার ৩৬টি ব্লকের মধ্যে ৩ হাজার ৭৮৭টি ব্লক অত্যন্ত নিম্নমানের বলে প্রমাণিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে এই নিম্নমানের ব্লকগুলির ব্যবহারের কারণেই বাঁধটি টেকসই হয়নি এবং অল্প সময়ের মধ্যেই ভেঙে গেছে।
বাঁধের এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার ‘দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলায় টেকসই পানি ব্যবস্থা প্রকল্প (প্রথম পর্যায়)’ নামে আরও একটি নতুন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। এই নতুন প্রকল্পের জন্য ৮৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১১.৫৮ কিলোমিটার বাঁধের পুনরাকৃতিকরণ (পুনর্নির্মাণ/মেরামত) এবং ১.১০ কিলোমিটার নদীর তীর সংরক্ষণের কাজ করা হবে। এই নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে পূর্বের ভুলত্রুটি শুধরে একটি টেকসই বাঁধ নির্মাণের আশা করা হচ্ছে।
পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদ জানান, পরীক্ষায় বাতিল হওয়া ব্লকগুলোর জন্য ঠিকাদারকে কোনো বিল দেওয়া হয়নি। বিষয়টি নিয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্ত চলছে।
তিনি আরও বলেন, সাঙ্গু নদীর মোহনায় চর জাগার কারণে স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় বাঁধের বেশি ক্ষতি হয়েছে। নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে বাঁধকে আরও শক্তিশালী করা হবে।