বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য মার্কিন অর্থায়ন নিয়ে চলমান অনিশ্চয়তার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা চলতি সপ্তাহে ঢাকা সফরে আসছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের বিভিন্ন খাতে আন্তর্জাতিক সহায়তা হ্রাসের নীতির পর থেকেই রোহিঙ্গা তহবিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ ছিল। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার ছাড় করলেও, দীর্ঘমেয়াদে এই সহায়তা কমে যাওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্রমতে, যুক্তরাষ্ট্র আপাতত রোহিঙ্গা তহবিল পুরোপুরি বন্ধ না করলেও এর পরিমাণ কমাতে পারে। মঙ্গলবার (১৫ এপ্রিল) মার্কিন দক্ষিণ ও সেন্ট্রাল এশিয়া ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি নিকোল এন চুলিক চার দিনের সফরে ঢাকায় পৌঁছাবেন। এর একদিন পর দেশটির পূর্ব এশিয়া ও প্যাসিফিক ব্যুরোর ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যান্ড্রু হেরাপ এবং মিয়ানমারে নিযুক্ত মার্কিন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত সুসান স্টিভেনসনও তার সঙ্গে যোগ দেবেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প দায়িত্ব নেওয়ার পর চুলিকই হতে যাচ্ছেন বাংলাদেশ সফরকারী সর্বোচ্চ পদের মার্কিন কর্মকর্তা।
এই সফরে মার্কিন প্রতিনিধিদল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা ইস্যু ও অগ্রাধিকার বিষয়াবলি সংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন অথবা পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও মার্কিন দলের সাক্ষাতের চেষ্টা চলছে, যদিও তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এ ছাড়া বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেও তাদের বৈঠকের কথা রয়েছে।
ঢাকা ও ওয়াশিংটনের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, বৈঠকে বাংলাদেশ মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর আরোপিত উচ্চ শুল্ক প্রসঙ্গ, অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি এবং আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক উত্তরণে মার্কিন সহায়তা চাইবে। অন্যদিকে, ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের সার্বিক পরিস্থিতি, রোহিঙ্গা সংকট, আঞ্চলিক নিরাপত্তা, অবৈধ অভিবাসী ফেরত পাঠানো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান সম্পর্ক এবং চীনের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতার মতো বিষয়গুলো আলোচনায় গুরুত্ব পাবে।
একজন স্থানীয় কূটনীতিকের মতে, এই সফরে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য থাকবে মার্কিন শুল্ক প্রসঙ্গ, যা প্রায় ৩৭ শতাংশে পৌঁছানোয় রপ্তানি বাণিজ্যে ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর বিষয়টিও বিবেচনাধীন রয়েছে। পাশাপাশি সরকারের সংস্কার উদ্যোগ ও নির্বাচন নিয়েও আলোচনা হবে। অন্যদিকে, মার্কিন প্রতিনিধিদল রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার পরিস্থিতি, বিশেষ করে রাখাইনের পরিবর্তিত অবস্থা এবং আসন্ন মিয়ানমার নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানতে চাইবে। রোহিঙ্গা তহবিলের বিষয়েও তারা তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে পারে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো আরও বলছে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে কিছুটা টানাপড়েন এবং চীনের সঙ্গে ঢাকার ঘনিষ্ঠতা ওয়াশিংটনের নজরে রয়েছে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের চীন সফর নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চেয়েছে এবং ঢাকা তার জবাব দিয়েছে। এই বিষয়গুলোও মার্কিন কর্মকর্তাদের আলোচনায় স্থান পেতে পারে।
একজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক জানান, সফরের অন্যতম প্রধান ইস্যু রোহিঙ্গা ও মিয়ানমার। যুক্তরাষ্ট্র যে রোহিঙ্গা অর্থায়ন কমাবে, সেই বার্তা এই সফরে দেওয়া হতে পারে। তবে কী পরিমাণ কমবে বা ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন নিয়েও যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রত্যাশার কথা জানাবে এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমর্থন চাইবে।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর মনে করেন, মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের দেশের এজেন্ডা নিয়েই আসছেন এবং এই সফর দুই দেশের সরাসরি আলোচনার একটি সুযোগ। তিনি বলেন, “আমরা শুনতে পাচ্ছি মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ে তারা কথা বলতে চান। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছিল, যদিও সম্প্রতি এর একটি অংশ স্থগিত করা হয়েছে। আমাদের দিক থেকে শুল্কের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।”
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সংকট শুরুর পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বড় দাতা দেশ হিসেবে ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত ওয়াশিংটন বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ২৪০ কোটি ডলার সহায়তা দিয়েছে। মার্কিন কর্মকর্তাদের এই সফর তাই রোহিঙ্গা অর্থায়নের ভবিষ্যৎ এবং সামগ্রিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।