বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বাংলাদেশের বাজেট: ৭ কোটি থেকে ৭.৯৭ লক্ষ কোটি টাকার পথপরিক্রমা

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২ জুন ২০২৫ | ১০:৫১ পূর্বাহ্ন


দেশের প্রথম বাজেট ছিল আকারে খুবই ছোট। আর স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর সেই বাজেটের কলেবর যেমন বড় হয়েছে, তেমনি বেড়েছে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও। এই দীর্ঘ সময়ে যতগুলো বাজেট দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর আকার কেমন ছিল, কারা এবং কবে তা উপস্থাপন করেছিলেন, এবং বাজেট পেশ করার সময় তাদের বক্তব্যে কী ধরনের বিষয় প্রাধান্য পেয়েছিল, তারই একটি বিবরণ এখানে তুলে ধরা হলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাজেট উপস্থাপন ও পরিসংখ্যান প্রকাশের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সরকারের আয়-ব্যয়ের খাতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন বিষয়, এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাইরেও উন্নয়ন ব্যয়ের খাত বিস্তৃত হয়েছে, ফলে এডিপির তুলনায় সামগ্রিক উন্নয়ন বাজেটের আকারও বৃদ্ধি পেয়েছে।

প্রথম বাজেটটি দিয়েছিল মুজিবনগর সরকার, যা ১৯৭১ সালের ১৯ জুলাই উপস্থাপন করা হয়। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী এটি পেশ করেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর অনুমোদন দিয়েছিলেন। সেই বাজেটে রাজস্ব আয় দেখানো হয়েছিল ৭ কোটি ৭৪ লক্ষ ১৮ হাজার ৯৯৮ টাকা, ব্যয় ৮ কোটি ৬২ লক্ষ ৪৮ হাজার ২০৪ টাকা এবং ঘাটতি ছিল ৮৮ লক্ষ ২৯ হাজার ২০৬ টাকা। বাজেটের ব্যাখ্যামূলক টিকায় বলা হয়েছিল, স্বাধীনতা যুদ্ধের অপরিহার্য ব্যয় মেটাতে এই বাজেট তৈরি করা হচ্ছে, যা জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৭১, এই তিন মাসের জন্য প্রযোজ্য এবং এই সময়ের মধ্যেই দেশ স্বাধীন করার আশা ব্যক্ত করা হয়েছিল।

এরপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন শনিবার একইসঙ্গে দুটি অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। ১৯৭১-৭২ অর্থবছরের বাজেটটি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে ৩০ জুন ১৯৭২ পর্যন্ত কার্যকর ছিল, যেখানে রাজস্ব আয় ছিল ৪৮.৫২ কোটি টাকা, রাজস্ব ব্যয় ৯৯.১৩ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ৫১.৪৬ কোটি টাকা। একইসঙ্গে পেশ করা ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ২৯১.৫৮ কোটি টাকা, রাজস্ব ব্যয় ২১৮.৪৩ কোটি টাকা, যার ফলে রাজস্ব উদ্বৃত্ত ছিল ৭৩.১৫ কোটি টাকা। এই অর্থবছরে উন্নয়ন, পুনর্নির্মাণ ও পুনর্বাসন ব্যয় ছিল ৫০১ কোটি টাকা, যার মধ্যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল ৩১৮.৩০ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের মোট বাজেট ছিল ৭১৯.৪৩ কোটি টাকা, মোট আয় ২৮৫.৩৮ কোটি টাকা এবং মোট ঘাটতি ৪২৭.৮৫ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের সামনে বাজেট পেশ করতে না পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে আশা ব্যক্ত করেন যে ভবিষ্যতে আর এভাবে বাজেট প্রচার করতে হবে না।

পরবর্তী ১৯৭৩-৭৪ অর্থবছরের বাজেট তাজউদ্দীন আহমদ সংসদে বসেই পেশ করেন, যা ছিল বৃহস্পতিবার, ১৪ জুন, ১৯৭৩। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ছিল ৪১১.৩১ কোটি টাকা, রাজস্ব ব্যয় ২৯৫.৩০ কোটি টাকা এবং রাজস্ব উদ্বৃত্ত ১১৬.০১ কোটি টাকা। উন্নয়ন ও পুনর্নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৫২৫.৩৫ কোটি টাকা, যার মধ্যে এডিপি ছিল ৪৪৯.৯৭ কোটি টাকা। মোট ৮২০.৬৫ কোটি টাকার এই বাজেটে মোট আয় ছিল ৩৭৪.৩২ কোটি টাকা এবং মোট ঘাটতি ৪০৯.৩৪ কোটি টাকা। অর্থনীতির নানা সমস্যা তখন দৃশ্যমান হতে শুরু করায় অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় সেগুলোর উল্লেখ করেছিলেন।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের শেষ বাজেট ছিল ১৯৭৪-৭৫ অর্থবছরের, যা তিনি ১৯৭৪ সালের ১৯ জুন বুধবার পেশ করেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ও ব্যয় উভয়ই ৪৭০.২৩ কোটি টাকা এবং এডিপি ৫২৫ কোটি টাকা ধরা হয়েছিল। মোট ৯৯৫.২৩ কোটি টাকার এই বাজেটে মোট আয় ছিল ৪৭০.২৩ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৫২৫ কোটি টাকা। চরম অর্থনৈতিক সংকট, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও ডলার সংকট এবং আসন্ন দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে এই বাজেট উপস্থাপিত হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ২৩ জুন সোমবার এ আর মল্লিক দেশের নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭৫-৭৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। তখন দেশে কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, দুর্ভিক্ষ এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন (বাকশাল গঠন) চলছিল। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ছিল ৭৫৫.৩৮ কোটি টাকা, রাজস্ব ব্যয় ৫৯৯.১৯ কোটি টাকা, রাজস্ব উদ্বৃত্ত ১৫৬.১৯ কোটি টাকা এবং এডিপি ৯৫০.২৯ কোটি টাকা। মোট বাজেট ছিল ১৫৪৯.৪৮ কোটি টাকা, মোট আয় ৭৫৫.৩৮ কোটি টাকা এবং মোট ঘাটতি ৭৯৪.১০ কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী এ আর মল্লিক সম্পূর্ণ সাধু ভাষায় এই বাজেট বক্তৃতা দেন, যা পরবর্তীতে আর দেখা যায়নি।

স্বাধীনতার পরে দ্বিতীয়বারের মতো সংসদের বাইরে, বঙ্গভবন থেকে রেডিও-টেলিভিশনের মাধ্যমে বাজেট উপস্থাপন করা হয় ১৯৭৬ সালের ২৬ জুন শনিবার। সেনাবাহিনীর প্রধান, উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা হিসেবে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৬-৭৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এতে রাজস্ব আয় ছিল ৯৬৬.৩৮ কোটি টাকা, রাজস্ব ব্যয় ৭৬৭.৮৭ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ১৯৮.৫১ কোটি টাকা এবং এডিপি ১১০০ কোটি টাকা। মোট বাজেট ছিল ১৮৬৭.৮৭ কোটি টাকা, আয় ৯৬৬.৩৮ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৯০১.৪৯ কোটি টাকা। এই বাজেটেই প্রথমবারের মতো কালো টাকা সাদা করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

পরের বছর, ১৯৭৭ সালের ২৫ জুন শনিবার, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জিয়াউর রহমান ১৯৭৭-৭৮ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ১,১৫৬.৬১ কোটি টাকা, ব্যয় ৯৩৬.৩১ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ২৫০.৩০ কোটি টাকা এবং এডিপি ১১৫০.৬৫ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়। মোট বাজেট ছিল ২,০৮৬.৯৬ কোটি টাকা, আয় ১,১৫৬ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৯৩০.৩৫ কোটি টাকা। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এ বাজেটেও অব্যাহত রাখা হয়।

জিয়াউর রহমান তার তৃতীয় বাজেটটি পেশ করেন ১৯৭৮ সালের ৩০ জুন শনিবার, ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরের জন্য। তখন তিনি রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ছিল ১,৩৭৬.৫০ কোটি টাকা, ব্যয় ১,০৫৩.০৯ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৩২৩.৪১ কোটি টাকা এবং এডিপি ১৩৯০.৮৭ কোটি টাকা। মোট বাজেট ২,৪৪৩.৯৬ কোটি টাকা, আয় ১,৩৭৬ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ১,০৬৭.৪৬ কোটি টাকা। নতুন বেতন স্কেল কার্যকর করার কারণে এ বাজেটে ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছিল।

তিন বছর পর আবার সংসদে বাজেট পেশ করা হয়। নতুন অর্থমন্ত্রী মীর্জা নুরুল হুদা ১৯৭৯ সালের ২ জুন শনিবার ১৯৭৯-৮০ অর্থবছরের বাজেট দেন। সে সময় অর্থনীতি ভালো ছিল না, মূল্যস্ফীতির চাপ ও প্রবৃদ্ধি কমে গিয়েছিল। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ছিল ১,৮১২.০২ কোটি টাকা, ব্যয় ১,১৯৩.৯৬ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৬০৮.০৬ কোটি টাকা এবং এডিপি ২০৭০ কোটি টাকা। মোট বাজেট ৩,২৬৩.৯৬ কোটি টাকা, আয় ১,৮১২.০২ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ১,৪৫১.৯৪ কোটি টাকা।

এরপর অর্থমন্ত্রী হিসেবে আসেন এম সাইফুর রহমান। তিনি ১৯৮০ সালের ৭ জুন শনিবার ১৯৮০-৮১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এতে রাজস্ব আয় ছিল ২,১৯৩.৩৮ কোটি টাকা, ব্যয় ১,৪০৮.০৩ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৭৮৫.৩৫ কোটি টাকা এবং এডিপি ২৭০০ কোটি টাকা। মোট বাজেট ৪,১০৮.০৩ কোটি টাকা, আয় ২,১৯৩ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ১,৯১৪.৬৫ কোটি টাকা। বাজেট বক্তৃতায় তিনি জিয়াউর রহমানের খাল কাটা কর্মসূচি এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেন।

রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর মাত্র পাঁচ দিন পর, ১৯৮১ সালের ৬ জুন শনিবার, এম সাইফুর রহমান ১৯৮১-৮২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ২,৭৬৭ কোটি টাকা, ব্যয় ১,৬৬২ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ১১০৫ কোটি টাকা এবং এডিপি ৩০১৫ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়। মোট বাজেট ছিল ৪,৬৭৭ কোটি টাকা, আয় ২,৭৬৭ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ১,৯১০ কোটি টাকা। তবে ১৯৮২ সালের মার্চে জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসন জারির ফলে এই বাজেট পুরোপুরি বাস্তবায়িত হতে পারেনি।

সামরিক শাসক লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদের শাসনামলে অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আব্দুল মুহিত তার প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৮২ সালের ৩০ জুন বৃহস্পতিবার, ১৯৮২-৮৩ অর্থবছরের জন্য। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ছিল ২,৭৬৭.৮২ কোটি টাকা, ব্যয় ২,০৩৭.৬৩ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৭৩০.১৯ কোটি টাকা এবং এডিপি ২৭০০ কোটি টাকা। মোট বাজেট ৪,৭৩৭.৬৩ কোটি টাকা, আয় ২,৬৬৭.৮২ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ১,৯৬৯.৮১ কোটি টাকা। এ বাজেটে মহার্ঘ ভাতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।

আবুল মাল আব্দুল মুহিত তার পরবর্তী বাজেট, ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছরের জন্য, ১৯৮৩ সালের ৩০ জুন শনিবার পেশ করেন। তখনো সামরিক শাসন চলছিল। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৩,৩৯৬.৭৬ কোটি টাকা, ব্যয় ২,৪১৩.৫৪ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৯৮৩.২২ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন বাজেট ৩৪৮৩.৮৬ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। মোট বাজেট ছিল ৫,৮৯৭.৪০ কোটি টাকা, আয় ৩,৩৯৬.৭৬ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ২,৫০০.৬৪ কোটি টাকা। এই বাজেট বক্তৃতাটি ছিল তখনকার সময় পর্যন্ত দীর্ঘতম।

এরপর নতুন অর্থ উপদেষ্টা এম সাইদুজ্জামান ১৯৮৪ সালের ২৭ জুন বুধবার ১৯৮৪-৮৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এতে রাজস্ব আয় ৩,৪৬৫ কোটি টাকা, ব্যয় ২,৮০২.৮০ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৬৬২.২০ কোটি টাকা এবং এডিপি ৩৮৯৬ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ৬,৬৯৮.৮০ কোটি টাকা, আয় ৩,৪৬৫ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৩,২৩৩.৮০ কোটি টাকা। এ বাজেটে নতুন আয়কর আইন চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়।

এম সাইদুজ্জামান অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে ১৯৮৫ সালের ৩০ জুন রোববার ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরের বাজেট দেন। লে. জেনারেল এইচ এম এরশাদ তখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৩,৭৫৪ কোটি টাকা, ব্যয় ৩,৩১৩ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৪৪১ কোটি টাকা এবং এডিপি ৩৮২৫.৭২ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ৭,১৩৮.৭২ কোটি টাকা, আয় ৩,৭৫৪ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৩,৩৮৪.৭২ কোটি টাকা।

১৯৮৬ সালের ২৭ জুন শুক্রবার এম সাইদুজ্জামান ১৯৮৬-৮৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। তখন তিনি অর্থ উপদেষ্টা এবং মুখ্য অর্থ সচিব। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৪,৪৬৮ কোটি টাকা, ব্যয় ৩,৭৪০ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৭২৮ কোটি টাকা এবং এডিপি ৪,৭৬৪ কোটি টাকা ধার্য করা হয়। মোট বাজেট ছিল ৮,৫০৪ কোটি টাকা, আয় ৪,৪৬৮ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৪,০৩৬ কোটি টাকা।

তার পরের বাজেটটিও এম সাইদুজ্জামান দেন ১৯৮৭ সালের ১৮ জুন বৃহস্পতিবার, ১৯৮৭-৮৮ অর্থবছরের জন্য। এতে রাজস্ব আয় ৪,৯১৫ কোটি টাকা, ব্যয় ৪,৪৮১ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৪৩৪ কোটি টাকা এবং এডিপি ৫০৪৬ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ৯,৫২৭ কোটি টাকা, আয় ৪,৯১৫ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৪,৬১২ কোটি টাকা। এ বাজেটে ২০% কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়।

অর্থমন্ত্রী হিসেবে মেজর জেনারেল (অব.) এম এ মুনএম ১৯৮৮ সালের ১৬ জুন বৃহস্পতিবার ১৯৮৮-৮৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৫,৫৬৯ কোটি টাকা, ব্যয় ৫,২৫০ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৩১৯ কোটি টাকা এবং এডিপি ৫৩১৫ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ১০,৫৬৫ কোটি টাকা, আয় ৫,৫৬৯ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৪,৯৯৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের একমাত্র পরিপূর্ণ অর্থনীতিবিদ অর্থমন্ত্রী ড. ওয়াহিদুল হক ১৯৮৯ সালের ১৫ জুন বৃহস্পতিবার ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরের বাজেট দেন। তখন অর্থনীতি চরম সংকটে ছিল। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৭,১৮০.৫৩ কোটি টাকা, ব্যয় ৬,৯০০ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ২৮০.৫৩ কোটি টাকা এবং এডিপি ৫৮০৩.০২ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ১২,৭০৩.০২ কোটি টাকা, আয় ৭,১৮০.৫৩ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৫,৫২২.৪৯ কোটি টাকা।

এরশাদ আমলের শেষ বাজেটটি পেশ করেন মেজর জেনারেল (অব.) আবদুল মুনএম, ১৯৯০ সালের ১৪ জুন বৃহস্পতিবার, ১৯৯০-৯১ অর্থবছরের জন্য। অর্থমন্ত্রী ড. ওয়াহিদুল হকের পদত্যাগের পর তিনি পুনরায় দায়িত্ব পান। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৭৫৬২.৭৮ কোটি টাকা, ব্যয় ৭,৩০০ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ২৬২.৭৮ কোটি টাকা এবং এডিপি ৫৬৬৮ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ১২,৯৬৮ কোটি টাকা, আয় ৭,৫৬২.৭৮ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৫,৪০৫.২২ কোটি টাকা।

এরশাদের পতনের পর ক্ষমতায় আসা বিএনপি সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালের ১২ জুন বৃহস্পতিবার ১৯৯১-৯২ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ৮,৫০৩.০৯ কোটি টাকা, ব্যয় ৮,০৮৩.২৫ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৪১০.৮৪ কোটি টাকা এবং এডিপি ৭৫০০ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ১৫,৫৮৩.২৫ কোটি টাকা, আয় ৮,৫০৩.০৯ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৭,০৮০.১৬ কোটি টাকা। এ সময় তিনি মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ব্যবস্থা প্রবর্তনের ঘোষণা দেন।

এম সাইফুর রহমান তার পরবর্তী বাজেটগুলো পেশ করেন যথাক্রমে ১৯৯২ সালের ১৮ জুন (১৯৯২-৯৩ অর্থবছর, মোট বাজেট ১৭,২০০ কোটি টাকা), ১৯৯৩ সালের ১০ জুন (১৯৯৩-৯৪ অর্থবছর, মোট বাজেট ১৯,০৫০ কোটি টাকা), ১৯৯৪ সালের ৯ জুন (১৯৯৪-৯৫ অর্থবছর, মোট বাজেট ২০,৯৪৮ কোটি টাকা), এবং ১৯৯৫ সালের ১৫ জুন (১৯৯৫-৯৬ অর্থবছর, মোট বাজেট ২৪,৭০৭ কোটি টাকা)। এই সময়ে কাঠামোগত সংস্কার, বাণিজ্য উদারীকরণ, এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে শাহ এ এম এস কিবরিয়া প্রথম বাজেট পেশ করেন ১৯৯৬ সালের ২৮ জুলাই রোববার, ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের জন্য। এই বাজেটে রাজস্ব আয় ১৭,১২০ কোটি টাকা, ব্যয় ১২,১০৩ কোটি টাকা, উদ্বৃত্ত ৫,০১৭ কোটি টাকা এবং উন্নয়ন ব্যয় ১২,৫০০ কোটি টাকা ছিল। মোট বাজেট ২৫,২৫৮ কোটি টাকা, আয় ১৭,১২০ কোটি টাকা এবং ঘাটতি ৮,১৩৮ কোটি টাকা। এ বাজেটে ৭% প্রবৃদ্ধি অর্জন ও দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়।

শাহ এ এম এস কিবরিয়া তার পরবর্তী বাজেটগুলো পেশ করেন: ১৯৯৭ সালের ১২ জুন (১৯৯৭-৯৮ অর্থবছর, মোট বাজেট ২৭,৭৮৬ কোটি টাকা; প্রথমবারের মতো বয়স্ক ভাতা চালু), ১৯৯৮ সালের ১১ জুন (১৯৯৮-৯৯ অর্থবছর, মোট বাজেট ৩০,০৯৬ কোটি টাকা; কালোটাকা বিনিয়োগের সুবিধা), ১৯৯৯ সালের ১০ জুন (১৯৯৯-২০০০ অর্থবছর, মোট বাজেট ৩৬,১৭৮ কোটি টাকা; বিলাসবহুল গাড়ি কিনে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ), ২০০০ সালের ৮ জুন (২০০০-০১ অর্থবছর, মোট বাজেট ৪২,৮৫৯ কোটি টাকা; সফটওয়্যার ও কৃষিপণ্যের জন্য তহবিল, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ), এবং ২০০১ সালের ৭ জুন (২০০১-০২ অর্থবছর, মোট বাজেট ৪৪,৭৬৫ কোটি টাকা; পিএসআই ও কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক)।

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান পুনরায় বাজেট পেশ করেন। তিনি ২০০২ সালের ৬ জুন (২০০২-০৩ অর্থবছর, মোট বাজেট ৪৪,৮৫৪ কোটি টাকা; শুরু থেকেই কালোটাকা সাদা করার সুযোগ), ২০০۳ সালের ১২ জুন (২০০৩-০৪ অর্থবছর, মোট বাজেট ৫১,৯৮০ কোটি টাকা; নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে রিটার্ন দাখিল বাধ্যতামূলক), ২০০৪ সালের ১০ জুন (২০০৪-০৫ অর্থবছর, মোট বাজেট ৫৭,২৪৮ কোটি টাকা; টিআইএন থাকলেই রিটার্ন ও জীবনযাত্রার মান সম্পর্কিত তথ্য দেওয়া বাধ্যতামূলক), ২০০৫ সালের ৯ জুন (২০০৫-০৬ অর্থবছর, মোট বাজেট ৬৪,৩৮৩ কোটি টাকা; কালোটাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত), এবং ২০০৬ সালের ৮ জুন (২০০৬-০৭ অর্থবছর, মোট বাজেট ৬৯,৭৪০ কোটি টাকা) বাজেট উপস্থাপন করেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা হিসেবে এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম দুটি বাজেট পেশ করেন। প্রথমটি ২০০৭ সালের ৭ জুন (২০০৭-০৮ অর্থবছর, মোট বাজেট ৮৭,১৩৭ কোটি টাকা; ভ্যাটের আওতা বৃদ্ধি, করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি), এবং দ্বিতীয়টি ২০০৮ সালের ৯ জুন (২০০৮-০৯ অর্থবছর, মোট বাজেট ৯৯,৯৬২ কোটি টাকা; স্থানীয় শিল্প সংরক্ষণে শুল্ক কাঠামোয় পরিবর্তন)।

আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে আবুল মাল আবদুল মুহিত একনাগাড়ে বেশ কয়েকটি বাজেট পেশ করেন। তিনি ২০০৯ সালের ১১ জুন (২০০৯-১০ অর্থবছর, মোট বাজেট ১,১৩,৮১৯ কোটি টাকা; অপ্রদর্শিত আয় বিনিয়োগের সুযোগ), ২০১০ সালের ১০ জুন (২০১০-১১ অর্থবছর, মোট বাজেট ১,৩২,১৭০ কোটি টাকা; পিপিপি চালু, সঞ্চয়পত্রের সুদে কর), ২০১১ সালের ৯ জুন (২০১১-১২ অর্থবছর, মোট বাজেট ১,৬৩,৫৮৯ কোটি টাকা; নতুন মূসক ও আয়কর আইনের খসড়া), ২০১২ সালের ৭ জুন (২০১২-১৩ অর্থবছর, মোট বাজেট ১,৯১,৭৩৮ কোটি টাকা; মুঠোফোনের বিলের ওপর সারচার্জ), ২০১৩ সালের ৬ জুন (২০১৩-১৪ অর্থবছর, মোট বাজেট ২,২২,৪৯১ কোটি টাকা; করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি), ২০১৪ সালের ৫ জুন (২০১৪-১৫ অর্থবছর, মোট বাজেট ২,৫০,৫০৬ কোটি টাকা; উচ্চ আয়ের ওপর কর বৃদ্ধি), ২০১৫ সালের ৪ জুন (২০১৫-১৬ অর্থবছর, মোট বাজেট ২,৯৫,১০০ কোটি টাকা; করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি), ২০১৬ সালের ২ জুন (২০১৬-১৭ অর্থবছর, মোট বাজেট ৩,৪০,৬০৫ কোটি টাকা; কর দিবস ৩০ অক্টোবর নির্ধারণ), ২০১৭ সালের ১ জুন (২০১৭-১৮ অর্থবছর, মোট বাজেট ৪,০০,২৬৬ কোটি টাকা; নতুন মূসক আইন স্থগিত), এবং ২০১৮ সালের ৭ জুন (২০১৮-১৯ অর্থ海外, মোট বাজেট ৪,৬৪,৫৭৩ কোটি টাকা) বাজেট উপস্থাপন করেন।

পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট পেশ করেন। তিনি ২০১৯ সালের ১৩ জুন (২০১৯-২০ অর্থবছর, মোট বাজেট ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা; স্টার্টআপ তহবিল, প্রবাসী আয়ে প্রণোদনা), ২০২০ সালের ১১ জুন (২০২০-২১ অর্থবছর, মোট ব্যয় ৫,৬৮,০০০ কোটি টাকা; করোনা মোকাবিলায় প্রণোদনা), ২০২১ সালের ৩ জুন (২০২১-২২ অর্থবছর, মোট ব্যয় ৬,০৩,৬৮১ কোটি টাকা; সঞ্চয়পত্র ও বাড়ির নকশায় টিআইএন বাধ্যতামূলক), ২০২২ সালের ৯ জুন (২০২২-২৩ অর্থবছর, মোট বাজেট ৬,৭৮,০৬৪ কোটি টাকা; পাচার করা অর্থ সাদা করার সুযোগ), এবং ২০২৩ সালের ১ জুন (২০২৩-২৪ অর্থবছর, মোট বাজেট ৭,৬১,৭৮৫ কোটি টাকা; করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি, ন্যূনতম কর ২ হাজার টাকা) বাজেট উপস্থাপন করেন।

সর্বশেষ, ২০২৪ সালের ৬ জুন আবুল হাসান মাহমুদ আলী অর্থমন্ত্রী হিসেবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেন, যার মোট আকার ছিল ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এই বাজেট পেশের দুই মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে এবং বাজেট বাস্তবায়নের দায়িত্ব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে আসে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাজেটে কোনো পরিবর্তন না এনে উন্নয়ন ব্যয় সংযত করে এবং অনেক প্রকল্পের বাস্তবায়ন পিছিয়ে দেয়।

এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় বাংলাদেশের বাজেট অর্থনীতি ও সামাজিক উন্নয়নের নানা ধাপ অতিক্রম করেছে, যা দেশের অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল।