
এক ঘনঘোর বর্ষায়। জেএম প্যারাডাইসে, তার অফিসে বসে আছি। একুশে পত্রিকার অফিস। যেমন রোজ বসি। সন্ধ্যা নেমে বুড়ো হচ্ছিল রাত। আর কেউ নেই সেদিন, আমরা দুজন কেবল গল্পে মশগুল।
হঠাৎ। কয়েক সেকেন্ড দেখি সে আনমনা। নিষ্পলক। তারপরই আমার কাছে জানতে চাইল, বর্ষা আপনার কেমন লাগে! বলি, আমার সবচেয়ে পছন্দের ঋতু। তার চোখমুখ যেন ঝলমল করে ওঠে।
বাইরে তখনও ঝরছে বারিধারা, তুমুল হরষে। বলে- আপনাকে একটা গান শোনাই। ভালো লাগবে। আপনার প্রিয় রবীন্দ্রসংগীত। খুব শান্ত-ধীরকণ্ঠে গেয়ে ওঠে- কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে…। কণ্ঠে তার কী মায়া। চোখ বন্ধ করে শুনি খানিকক্ষণ।
বলি- এটাতো বর্ষার গান নয়, পূজা ও প্রার্থনা সংগীত। আরাধ্য দেবতার জন্য ভক্তের আকুলতা। বলে, আমিই না হয় ভক্ত হয়ে চাইলাম আমার আরাধ্য কাউকে। তারপর থেকে বহুবার তার কণ্ঠে শুনেছি গানটি। যেন আমাদেরই দুজনের হৃদয়ের কথা।
আজাদ তালুকদার এবং আমার-আমাদের এমনই হৃদয়ের এক সময় ছিল, আমরা হুটহাট করে আড্ডায় মাততাম। মশগুল হতাম। বেরিয়ে পড়তাম। আজাদ গাইত। মন খুলে গাইত। সুকণ্ঠ। ভীষণ মায়াময়। তার কেন জানি বিরহের, দুঃখ জাগানিয়া গান খুব পছন্দ।
আজাদের সাথে আমার বেশি জমতো গানের গল্পে। আমি গান পছন্দ করি ভীষণ। সেও তাই। কখনো কখনো বইয়ের।
আজাদ আর আমার-আমাদের ঠাসবুনোটের বন্ধনের অধ্যায়টি বহু স্মৃতিমোড়া। যেখানে একজীবনের মধুর রসায়ন বা বহু বর্ণিল গল্পে পূর্ণঝুরি। সে না হয়, আরেক দিন বলা যাবে।
আজাদ যেদিন অনন্তলোকে গেল, সেদিনও ঘোর বর্ষণ হচ্ছিল। এখনও তো, তেমনই বর্ষাকাল।
আজ, সেই বর্ষাকালেরই এক দিনে তারও জন্মদিন। তার আগের দিন আমার। দুজনের পিঠাপিঠি জন্মদিন বলে, একটা আনন্দও ছিল তার। বলত, আমরা হয়তো কোনো জনমে ভাই ছিলাম।
আমার জন্মদিনে, হোক অফিস বা বাসায়, আরও কয়েকজন সাথে নিয়ে দারুণ হৈ হৈ করে কেক নিয়ে হাজির আজাদ। কী প্রাণস্ফূরণ!
অদ্ভুত ব্যাপার, যে বছর সে চিরতরে পাড়ি জমাল, সেবারের শেষ জন্মদিনে ভার্চুয়ালি শুভেচ্ছা জানালে বিদেশের হাসপাতালের বেডে শুয়ে একশব্দে উত্তর দিয়েছে- ‘ভাইরে’।
আমাদের হৃদয়ের গল্পে মাঝে ছেদ পড়েছিল, সত্য। হয়তো তার অভিমান, নয়তো আমাদের। কী জানি কি কারণ! আমরা যেটা দারুণ উচ্ছ্বাসে বলতাম কফি হাউসের আড্ডা, সেটাও ধূসর হয়ে উঠেছিল মাঝে। শেষ কিছুদিন আমাদের দেখা-কথা বলাটি হয়ে উঠেছিল- অনেকটা লৌকিক। চলতি পথিকের মতো। তবে ভার্চুয়ালি হলেও জন্মদিনের উইশ বিনিময়টা মিস হয়নি কখনো।
সব ছিন্ন হয়ে এখন তাই এই জন্মদিনেও কী আর করি, বলি- ভাইরে আমাদের বরফসাগরের স্বরূপ আর দেখা হয়নি। না হোক, আমাদের শুভ্র-সুন্দর থাকার শুভেচ্ছা বিনিময় তো হতে পারে।
শুভ জন্মদিন আজাদ তালুকদার।
লেখক : রিজিওনাল এডিটর, চ্যানেল ২৪, চট্টগ্রাম স্টেশন।