বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ডলারকে আর বিশ্বাস নেই?

সোনা কিনছে বিশ্বের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো
একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৯ জুলাই ২০২৫ | ২:৫৩ অপরাহ্ন


বিশ্ব অর্থনীতিতে এক নীরব কিন্তু শক্তিশালী পরিবর্তন আসছে। মার্কিন ডলারের উপর বহু দশকের নির্ভরতা কমিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো এখন ঝুঁকেছে সোনার দিকে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ডলারকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করার যে নজির যুক্তরাষ্ট্র দেখিয়েছে, তারপর থেকেই এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং ডলারের প্রতি আস্থা কমে যাওয়াই এই নতুন ‘গোল্ড রাশ’-এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।

কেন এই সোনার মোহ?

ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের (ডব্লিউজিসি) সর্বশেষ সমীক্ষা অনুযায়ী, ৪৩ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের সোনার ভান্ডার আরও বৃদ্ধি করতে আগ্রহী। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর মূল কারণ হলো রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ডলারের একচ্ছত্র আধিপত্যের ওপর আস্থা হারানো। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলো এখন ডলারের বিকল্প হিসেবে সোনাকে একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে দেখছে এবং তাদের সোনা কেনা অব্যাহত রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

চীন ও ব্রিকসের নেতৃত্বে ডলারের বিকল্প খোঁজা

এই ডলারনির্ভরতা কমানোর দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে আছে চীন এবং ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)। এই দেশগুলো একদিকে যেমন ডলারের বিকল্প মুদ্রা ব্যবস্থা তৈরিতে আগ্রহী, তেমনি তারা সবাই সোনার বড় ক্রেতা।

চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, পিপলস ব্যাংক অব চায়না, টানা সপ্তম মাসের মতো সোনার মজুত বাড়িয়েছে। চলতি বছর সোনার দাম রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পরও তাদের এই কেনা অব্যাহত রাখা এটাই প্রমাণ করে যে, ডলারনির্ভরতা কমাতে বেইজিং কতটা মরিয়া। এর আরেকটি বড় প্রমাণ হলো মার্কিন ট্রেজারি বন্ড বিক্রি করে দেওয়া। ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই দুই মাসেই চীন প্রায় ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের মার্কিন ঋণপত্র বিক্রি করে দিয়েছে।

বিশ্বজুড়ে বাড়ছে সোনার ভান্ডার

এই প্রবণতা শুধু চীনে সীমাবদ্ধ নয়। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ইনভেস্টর ডট কমের তথ্যমতে, গত বছরের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর হাতে প্রায় ৩৬ হাজার ২০০ টন সোনা ছিল, যা তাদের মোট সরকারি রিজার্ভের প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২৩ সালের শেষে এই হার ছিল প্রায় ১৫ শতাংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ধারণা করছে, এ বছর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত আরও ৯০০ টন সোনা কিনবে।

ডব্লিউজিসির সমীক্ষা জানাচ্ছে, বর্তমানে ৪৭ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরাসরি বড় ও ছোট খনি থেকে সোনা সংগ্রহ করছে, বাকিটা কেনা হচ্ছে বাজার থেকে।

সোনার দামের ওপর প্রভাব

কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর এই বিপুল চাহিদার সরাসরি প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্সপ্রতি ৩,৫০০ ডলারে পৌঁছে সর্বকালীন উচ্চতায় উঠেছিল। বর্তমানে দাম কিছুটা কমে ৩,২৫০ ডলারে থাকলেও আর্থিক বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদি তাদের সোনা কেনা অব্যাহত রাখে, তাহলে এর দাম আবারও বাড়তে পারে।

সব মিলিয়ে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অস্থিরতা যত বাড়ছে, ততই দেশগুলো কাগজের মুদ্রার চেয়ে হাজার বছরের পুরোনো নিরাপদ বিনিয়োগ সোনাকেই বেছে নিচ্ছে, যা বিশ্ব অর্থনীতির প্রচলিত সমীকরণকে নতুন করে সাজাতে বাধ্য করছে।