বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

মার্কিন শুল্ক: সরকারের ‘দুর্বল’ দরকষাকষিতে ব্যবসায়ীরা ‘হতাশ ও ক্ষুব্ধ’

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ২১ জুলাই ২০২৫ | ৯:৪৮ পূর্বাহ্ন


যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ঘোষিত ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপের সময় ঘনিয়ে এলেও সরকারের প্রস্তুতি ও দরকষাকষির দুর্বলতায় গভীর হতাশা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা।

তাদের অভিযোগ, সরকার এককভাবে আলোচনা চালিয়ে এই সংকট মোকাবেলায় বেসরকারি খাত ও বিশেষজ্ঞদের কোনো পরামর্শ নেয়নি, যার ফলে প্রতিযোগী দেশগুলো আলোচনায় এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে।
রোববার রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে দৈনিক প্রথম আলো আয়োজিত ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এসব কথা বলেন।

সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সরকারের কার্যক্রমের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, “বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে, আমরা একটি অত্যন্ত নিরপরাধ, নির্দোষ ও নিষ্পাপ সরকারকে সামনে নিয়ে এগোনোর চেষ্টা করছি। এত দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকার, যাদের রাজনৈতিক বৈধতা থাকে না, তারা সফল দরকষাকষি করেছে এমন নজির কম।”

তিনি বলেন, শুল্ক আলোচনায় সরকারের ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) সই করার সিদ্ধান্ত দেশের ইতিহাসে প্রথম, যা বাংলাদেশের অবস্থানকে আরও দুর্বল করেছে। “লিখিত এ ধরনের চুক্তির কারণে এখন যদি বাংলাদেশ কোনো লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।”

হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ. কে. আজাদ বলেন, “চল্লিশ বছরের ব্যবসায় জীবনে রপ্তানি খাতে এমন সংকট কখনও দেখিনি। আমরা ব্যবসায়ীরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।”

পরিস্থিতির ভয়াবহতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমার এক ক্রেতা ইমেইলে জানিয়েছে, ১ আগস্ট থেকে যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে শুল্কের ৩৫ শতাংশ আমাকে বহন করতে হবে। আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব?”

অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, “আপনারা বলছেন সাত-আট মাসের জন্য দায়িত্বে আছেন। এর পর চলে যাবেন। কিন্তু তখন আমরা যাব কোথায়? সবার ধারণা, আমাদের মাথার ওপর একজন আছেন, তিনি একটা ফুঁ দিয়ে দেবেন, আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।”

বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেন, “তিন দিন আগেও একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলাম। এখন পুরোপুরি হতাশ। কারণ, দুদিন আগে জানা গেল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কার্যালয়। এ বার্তা আগে জানলে আমরা বেসরকারিভাবে লবিস্ট নিয়োগ করতে পারতাম।”

তিনি জানান, দেশের প্রায় একশটি কারখানা, যারা মোট উৎপাদনের ৯০ থেকে ১০০ ভাগই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে, তারা সবচেয়ে বড় বিপদে পড়েছে।

সিপিডির আরেক সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সরকারি পর্যায়ে এমন আত্মবিশ্বাস ও অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। এতদিন শুধু ইউএসটিআরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলাপ হয়েছে। এখন ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টও আলোচনায় বড় অংশীদার। সেখানে আলোচনা করতে হবে, লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে।”

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, “সরকার যদি মনে করে, ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত না করে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার চেয়ে ভালো সুবিধা আনতে পারবে, তাহলে তা হবে নিজেরাই নিজেদের বিপদ ডেকে আনা।”

অ্যাপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, “অনেক ক্রেতা ক্রয়াদেশ স্থগিত করেছে। তারা জিজ্ঞেস করছে, বাড়তি শুল্কের কত ভাগের দায় আমরা নিতে পারব। কিন্তু আমাদের পক্ষে এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়।”

বৈঠকে সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান এবং অনন্ত গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শরীফ জহিরও সরকারের দরকষাকষির কৌশলকে ‘হতাশাজনক’ এবং ‘কূটনৈতিক পরাজয়’ বলে অভিহিত করেন।

প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন শওকত হোসেন মাসুমের সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক বাণিজ্য সচিব মাহবুব আহমেদ এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক লে. জে (অব.) মোহম্মদ মাহফুজুর রহমানসহ অনেকে।