বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

চাকসুর নতুন অধ্যায়: উত্তেজনার পর ঐক্যের বার্তা কতটা কার্যকর হবে?

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৬ অক্টোবর ২০২৫ | ২:০২ অপরাহ্ন


ভোরের আলো ফোটার ঠিক আগে, যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস রাতের নিস্তব্ধতা আর সারাদিনের নির্বাচনী উত্তেজনার ক্লান্তি নিয়ে ঝিমিয়ে ছিল, ঠিক তখনই ঘোষিত হলো এক ঐতিহাসিক ফলাফল। দীর্ঘ ৪৪ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) নেতৃত্বে ফিরে এলো ইসলামী ছাত্রশিবির। তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এক নির্বাচনে সংগঠনটির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ ভিপি-জিএসসহ ২৪টি পদে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে ক্যাম্পাসের রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল। এই প্রত্যাবর্তন শুধু একটি সংগঠনের বিজয় নয়, বরং দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত একটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের রায়, যা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে নিয়ামক হয়ে থাকবে।

বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টার দিকে যখন ক্যাম্পাসে দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়ছে, তখন নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) মো. ইব্রাহিম হোসেন গণমাধ্যমের সামনে এসে যে বার্তা দিলেন, তাতে ছিল ঐক্যের সুর। তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনে কেউ পরাজিত হননি। সবাই বিজয়ী হয়েছেন। আমরা এখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা নির্বাচনে বিভিন্ন প্রার্থীকে সৃজনশীল চিন্তা প্রকাশ করতে দেখেছি। সবার ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় চাকসু সারা দেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’

শিক্ষার্থীদের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ইব্রাহিম হোসেন আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৩৫ বছর পর এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আমাদের শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের প্রতি। তাঁরা আমাদের ওপর আস্থা রেখেছেন। আমরা তাঁদের কাছে গিয়েছি, তাঁদের কথাগুলো জানার চেষ্টা করেছি। যে দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা আমাদের ওপর দিয়েছেন, তা সম্পূর্ণ আমাদের জন্য আমানত। আমরা চাই, যে আমানত তাঁরা আমাদের ওপর দিয়েছেন, তা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে যেন পালন করতে পারি।’ তিনি খোলা মনে সবার পরামর্শ ও সমালোচনা আহ্বান করে স্বচ্ছতার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের অঙ্গীকার করেন।

এর আগে, নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (জিএস) সাঈদ বিন হাবিব তার প্রথম প্রতিক্রিয়াতে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ হলো ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া।’

এই নির্বাচনের ফলাফল ছিল এককথায় চমকপ্রদ। ভোর সাড়ে চারটায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার যখন ফল ঘোষণা করেন, তখন স্পষ্ট হয় শিবিরের নিরঙ্কুশ আধিপত্য। ভিপি পদে মো. ইব্রাহিম হোসেন ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন। তিনি ছাত্রশিবিরের চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের একজন এমফিল গবেষক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের প্যানেলের সাজ্জাদ হোসেন পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট। জিএস পদে সাঈদ বিন হাবিব ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মো. শাফায়াত পেয়েছেন ২ হাজার ৭৩৪ ভোট।

চাকসুর ২৬টি পদের মধ্যে ছাত্রদল প্যানেল থেকে একমাত্র জয় পেয়েছেন আইয়ুবুর রহমান। তিনি সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে ৭ হাজার ১৪ ভোট পান, যেখানে ছাত্রশিবিরের সাজ্জাত হোছেন পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট। এ ছাড়া সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে ‘বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেলের প্রার্থী তামান্না মাহবুব জয়ী হয়েছেন।

চাকসুর ইতিহাসে শিবিরের এই প্রত্যাবর্তন এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর আগে সংগঠনটি সর্বশেষ জয় পেয়েছিল ১৯৮১ সালের নির্বাচনে। সেবার ভিপি হয়েছিলেন জসিম উদ্দিন সরকার এবং জিএস হয়েছিলেন আবদুল গাফফার। এরপর কেটে গেছে ৪৪টি বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে আশির দশক থেকে ছাত্রশিবিরের শক্তিশালী অবস্থান থাকলেও ২০১৪ সালের পর থেকে ক্যাম্পাসে তাদের প্রকাশ্য কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এক দশকের নীরবতা ভেঙে গত বছরের আগস্টে তারা যখন প্রকাশ্যে রাজনীতিতে ফেরে, তখন অনেকেই একে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে দেখলেও মাত্র এক বছরের মাথায় চাকসু নির্বাচনে এমন অভাবনীয় সাফল্য প্রায় সকলের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত।

১৯৭০ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে মাত্র সাতবার। ১৯৮১ সালের জয়ের পর ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ‘সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য’-এর কাছে পরাজিত হয়েছিল ছাত্রশিবির। এরপর দীর্ঘ তিন দশক আর কোনো নির্বাচনই হয়নি। ফলে একটি পুরো প্রজন্ম ছাত্র সংসদের গণতান্ত্রিক চর্চা থেকে বঞ্চিত ছিল। এবারের নির্বাচন সেই খরা কাটিয়েছে। ২৭ হাজার ৫১৬ জন ভোটারের মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিক্ষার্থী তাদের রায় দিয়েছেন। পাঁচটি অনুষদ ভবনের ৭০০টি বুথে ভোট দিয়েছেন তারা। জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার সুযোগ না পাওয়া অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর কাছে এই নির্বাচনই ছিল জীবনের প্রথম গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা, যা তাদের কাছে ছিল এক বিরাট উৎসব। এই নতুন প্রজন্মের ভোটেই নির্ধারিত হয়েছে চাকসুর নতুন নেতৃত্ব, যা আগামী দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে কতটা সফল হবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।