চট্টগ্রাম : কাউন্সিলর লিস্ট নিয়ে শুরু থেকেই ছিল নেতাকর্মীদের আপত্তি। এই আপত্তি কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে জানিয়েছিলেন ভুক্তভোগীরা। তাদের অভিযোগ, সভাপতি বখতেয়ার সাঈদ ইরান ও সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়বের পছন্দের কাউন্সিলর লিস্ট সামনে রেখে সম্মেলনের চেষ্টা চলছে।
অভিযোগকারীদের কাছে তথ্য ছিল, সম্মেলন সামনে রেখে ছাত্রলীগের দুই শীর্ষ নেতার করা কাউন্সিলর তালিকায় গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।
দ্বিতীয়ত, সম্মেলনের কয়েকদিন আগে থেকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন মিরসরাইয়ের সন্তান তানভীর হোসেন তপুকে সভাপতি পদে একক প্রার্থী ঘোষণা করেন। এছাড়া সাধারণ সম্পাদক পদে সন্দ্বীপের জিকুর পক্ষে মন্ত্রী মোশাররফের অবস্থানও বিক্ষুব্ধ করে তোলে নেতাকর্মীদের।
বিশেষত অপেক্ষাকৃত সিনিয়র নেতাদের ডিঙিয়ে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের বর্তমান সদস্য তপুকে সভাপতি বানাতে মোশাররফ হোসেনের একক, একগুয়েমি সিদ্ধান্তে তৃণমূল নেতকর্মীদের মাঝে তৈরি হওয়া ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিস্ফোরণে পরিণত হয় সম্মেলনে।
এছাড়া সম্মেলন শুরু হতে না হতে তড়িঘড়ি করে কাউন্সিলরের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ইচ্ছা আরেকদফা ক্ষোভ তৈরি করে দলের অভ্যন্তরে।
মঙ্গলবার সকালে উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে নজিরবিহীন বিশৃঙ্খলার নেপথ্যে এগুলোকেই অন্যতম ‘কারণ’ মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র।
সূত্র জানায়, সম্মেলন শুরু হওয়ার আগেভাগেই ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সম্মেলনস্থলে গিয়ে হাজির হন। সাড়ে ১১টার দিকে পতাকা উত্তোলন করে সম্মেলন উদ্বোধনের পর মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের উদ্দেশ্যে বলেন, সোয়া একটার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করে কাউন্সিলরের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এখনো কারো বক্তব্যই দেয়া হয়নি, একঘণ্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করা কীভাবে সম্ভব? অতিথিদের এমন প্রশ্নে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, হাছান মাহমুদ বক্তব্য দিবে, আমি একটুখানি দেব। আর কারো বক্তব্য দেয়ার দরকার নেই।
ইত্যবসরে পৌনে ১২ টার দিকে স্বাগত বক্তব্য দিতে উঠেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। মূলত তখনই পাল্টাপাল্টি স্লোগান নিয়ে হলজুড়ে উত্তেজনা শুরু হয়। নরম-গরমে বিক্ষোভকারীদের থামাতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে বক্তৃাই সংক্ষেপ করে নেমে পড়েন জাকির হোসাইন।
এরপর বক্তব্য দিতে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি সাকিব হোসেন সুইম। সাথে সাথে সম্মেলন কক্ষের পেছন থেকে শুরু হয় চেয়ার মারামারি আর ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এর মাঝে অনুষ্ঠানস্থলের বাঁ পাশে একটি হাতবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
এসময় মঞ্চে উপবিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন অডিয়েন্সে নেমে মারামারিতে লিপ্ত কর্মীদের থামানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা মন্ত্রী মোশাররফ হোসেনকে মঞ্চের পেছনের দিকে নিয়ে যান। পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়েছে মনে করে মন্ত্রী মোশাররফ মঞ্চে এসে বসার সঙ্গে ফের শুরু হয় চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। মঞ্চে উপস্থিত ড. হাছান মাহমুদসহ কয়েক নেতা মাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানালেও তা নেতাকর্মীদের কানে পৌঁছে না। কারণ এরই মধ্যে মাইকের ক্যাবল ছিড়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
এসময় পরিস্থিতির আরও অবনতি হলে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনকে উদ্দেশ্য করে উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম বলেন, ‘আপনার একগুয়েমি সিদ্ধান্ত ও বাড়াবাড়ির কারণে আজকে এই অবস্থা। তখন উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে হল ছেড়ে বাইরে লালখানবাজার, চট্টগ্রাম ক্লাবের মোড় পর্যন্ত।
এসময় একে একে রাউজানের এমপি ফজলে করিম চৌধুরী, মাহফুজুর রহমান মিতা, উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক এম এ সালাম বেরিয়ে যান। পরপর বেরিয়ে যান ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনও। কিন্তু মঞ্চে ঠাঁই বসে থাকেন ড. হাছান মাহমুদ। মাইকবিহীন আহ্ববান, অনুরোধে উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের থামানোর চেষ্টা করেন হাছান মাহমুদ। কিন্তু থামাতে পারেন না। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে নিজেই স্লোগান ধরে হাছান মাহমুদ সম্মেলনকক্ষের বাইরে গিয়ে আধঘণ্টার মতো অবস্থান করেন। তখনো থেমে থেমে বিক্ষোভ ও বিশৃঙ্খলা চলছিল। এর মাঝেই অতিথিবিহীন, বিশৃঙ্খল অনুষ্ঠানকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, আজকের ঘটনায় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সিনিয়র নেতৃবৃন্দ চাইলে এই ঘটনা এড়াতে পারতেন। আগে থেকে প্রচারণা না চালিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে কাউন্সিল অধিবেশন শেষ করতে পারতেন। উত্তর জেলা সাংগঠনিক ইউনিটের সব প্রার্থী, নেতাকর্মী আমাদের পরিচিত, স্নেহভাজন, আস্থাভাজন। কাজেই আমরা সেরকমভাবে কারো পক্ষে ব্লাইন্ডলি অবস্থান নিতে পারি না। যাই হোক, ভবিষ্যতে এখান থেকে শিক্ষা নিতে হবে। বলেন হাছান মাহমুদ।
একাধিকবার চেষ্টা করার পর মঙ্গলবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে টেলিফোনে পাওয়া যায় উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল আলম চৌধুরীকে। কুশলাদি বিনিময় ও একুশে পত্রিকার প্রশ্ন শুনে নুরুল আলম চৌধুরী বলেন তিনি গোসল করছেন। ২০ মিনিট পরে ফোন দিতে। এরপর তাকে আর পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গেও মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে পাওয়া যায়নি।
কাউন্সিলর তালিকা নিয়ে অসন্তোষ তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবু তৈয়ব বলেন, ‘কাউন্সিলর তালিকা করা হয়েছে গত শুক্রবার। তিনদিন চলে গেল, কোথাও অসন্তোষ দেখা গেলো না। তবে আজ কেন?’
তাহলে কী কারণে পণ্ড হলো সম্মেলন- একুশে পত্রিকার এমন প্রশ্নের জবাবে আবু তৈয়ব বলেন, ‘সবাই দেখেছে কারা করেছে। আপনারা দেখেছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও দেখেছে।’
এসময় কমিটি গঠনের ব্যাপারে ‘একটি শর্টলিস্ট ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে জানান আবু তৈয়ব।
>>চেয়ার ছোড়াছুড়ি, ককটেল বিস্ফোরণে ছাত্রলীগের সম্মেলন পণ্ড
>> মন্ত্রী মোশাররফ নিজেই মারলেন লাথি!
>>জাকিরের অসহায়ত্ব!
একুশে/এএ/এটি