আবু আজাদ : ‘বিষয়টা যত সহজ ভাবছেন তত সহজ নয়। অনেক চালাক এই সুমিত আর তার সহযোগীরা। পুলিশকে ফাঁকি দিতে প্রযুক্তিকে এড়িয়ে তো গেছেই; কীভাবে যেন পুলিশের পদক্ষেপগুলো বার বার জেনে যাচ্ছিলো তারা! আমার মনে হয় না বিষয়টা এখানেই শেষ।’
চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র তমালের ওপর এসিড হামলার আসামি সুমিত ধর (৩০) ও মমিতা দত্ত অ্যানি (২৬) কে গ্রেফতারের বিষয়ে জানাতে গিয়ে একুশে পত্রিকাকে এসব কথা বলেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি মো. কামরুজ্জামান।
গোয়েন্দা পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশকে এড়িয়ে যেতে যা যা করা প্রয়োজন, সবই করেছে এই দম্পতি। ঘটনার পরই তারা রাজধানী ঢাকায় পালিয়ে যায়। ভাটারা এলাকায় যে বাড়িটিতে থাকতো, সেটি ছিলো একেবারেই ধারণার বাইরের একটি প্লেস। দুইতলা ভবনের দ্বিতীয় তলায় তারা থাকতো। উপরে উঠার জন্য স্বাভাবিক কোনো সিঁড়ি ছিলো না। একটি ছোট্ট লোহার সিঁড়ি দিয়ে তারা চলাচল করতো।’
পুলিশের এডিসি মো. কামরুজ্জামান আরো বলেন, ‘তারা নিজেরা কখনো ফোন ব্যবহার করতো না। অন্য নামে রেজিস্ট্রেশন করা দুটো সিম শুধু তারা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করছিলো। মাঝে মাঝে তাদের স্বজনরা ওখানে গেলেই, তাদের মোবাইল থেকে অপর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতো।’
শনিবার দুপুরে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে কথা হচ্ছিল তমালের সঙ্গে। তিনি একুশে পত্রিকাকে জানান, তার সঙ্গে নয়মাস প্রেম করার পর অ্যানি জানায় কয়েকমাস আগেই বিয়ে হয়েছে তার। প্রেমিকার এমন জবাবে উত্তেজিত তমাল থাপ্পড় দেয় অ্যানিকে। আর ওই থাপ্পড়ের প্রতিশোধ নিতে তমালের মুখে এসিড ছুঁড়ে মারে অ্যানির স্বামী সুমিত ও তার সহযোগীরা!
অভিযুক্ত মমিতা দত্ত অ্যানি ও তার স্বামী সুমিত দত্ত উভয়ই চট্টগ্রামের বেসরকারি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তমালের দূরসম্পর্কের আত্মীয় অ্যানি। নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ কমিশনার হাসান মো. শওকত আলী বলেন, ‘এ মামলাটি আমাদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের ছিলো। বেশ চালাক এই সুমিত ও তার সহযোগীরা। প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে তাদের গ্রেফতার করা গেছে রাজধানীর ভাটারা এলাকা থেকে।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা নগর গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া বলেন, ‘ঘটনার পর সুমিত ও অ্যানি গ্রেফতার এড়াতে ঢাকায় চলে যান। সেখানে মমিতা একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। সুমিত কয়েকটি টিউশন নেন। এভাবেই তাদের সংসার চলছিল। এদিকে পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজেও বের করতে পারছিলো না তাদের। কেন পারছিলো না এটি একটি রহস্য।’
আরো জানতে : প্রেমের নামে প্রতারণা, থাপ্পড়ের জবাবে এসিড!
তিনি আরো বলেন, ‘গত বছরের এপ্রিলে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আসে মামলাটি। কিন্তু কোনোভাবেই এই দুজনকে ট্রেস করা যাচ্ছিল না। শেষে গিয়ে খুব দুর্বল একটি সূত্র ধরে বেরিয়ে আসে সুমিত ও অ্যানির ঠিকানা। এখানে প্রযুক্তির সহায়তা যেমন নিয়েছি, তেমনি সুমিত ও অ্যানির পরিবারের সদস্যদের উপর আমাদের নজর ছিলো সার্বক্ষণিক।’
২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারী নগরীর কোতয়ালী থানার গুডস হিলের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তমাল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘২০১৬ সালের শেষের দিকে ‘প্রজাপতির ডানা’ নামে একটি ফেসবুক আইডি থেকে আমার কাছে রিকোয়েস্ট আসে। আমি রিকোয়েস্টটি একসেপ্ট করি। পরে তার সঙ্গে চ্যাটিংয়ে কথা হয়। জানায় সে কলকাতা থেকে বলছে। এভাবেই দু’মাস যাওয়ার পর ওই আইডি থেকে জানানো হয়, তার কাকার সঙ্গে বাংলাদেশে এসেছে সে। দেখা করবে।’
তমাল বলেন, ‘ফেসবুকেই নির্ধারিত হয় আমরা গুডসহিলের সামনে দেখা করবো। আমি সন্ধ্যার দিকে ওই এলাকায় পৌঁছাই। তখন দেখি দুই যুবক বেশ বড়বড় চোখ করে আমাকে লক্ষ করছে। এদিকে আমি অপেক্ষা করছিলাম ‘প্রজাপতির ডানার’। এরই মধ্যে তিন-চার মিনিট পর হঠাৎ ওই যুবকরা আমার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারে। তখন আমি কিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। সারা মুখ খুব বেশি জ্বলছিলো। এর মাঝে একজনকে একটু আবছা আবছা চিনতে পারি। সে সুমিত। অ্যানির স্বামী।’
তমাল বলেন, ‘আমি অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে যখন পানি পানি চিৎকার করছিলাম তখন একজন যুবক বলছিল, “অ্যানির সাথে প্রেম করার মজা দেখ।”
এসিডে আক্রান্ত হয়ে তমালের এক চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। আরেকটি চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া তার মুখম-লও বিকৃত হয়ে গেছে।
তমালের বাবা বাবুল চন্দ্র দে কান্নাজড়িত কণ্ঠে একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘ তমাল রাগের মাথায় তাকে থাপ্পড়ও মেরেছিল। সেই থাপ্পড়ের জবাব তারা দিয়েছে এসিড! আমি ওই দুই জনের ফাঁসি চাই। যাতে আর কারো সাথে কেও এমনটা করার সাহস না পায়।’
আরো : প্রেমের কারণে এসিড নিক্ষেপ : রাজধানী থেকে স্বামী-স্ত্রী গ্রেফতার
একুশে/এএ