মোহসীন-উল-হাকিম : একটা সময় ছিলো, তখন বন থেকে লোকালয়ে আসা বেঙ্গল টাইগারের আর ফিরে যাওয়া হতো না। টের পেলেই বনসংলগ্ন লোকালয়ের মানুষ দল বেঁধে আক্রমণ করতো, হত্যা করতো সুন্দরবনের ভয়ঙ্কর সুন্দর প্রাণিটিকে।
বাঘ হত্যা বা শিকার তখন প্রায়ই ঘটতো। ফলে বিপন্ন হয়ে পড়ে বেঙ্গল টাইগারের অস্তিত্ব। একটু দেরিতে হলেও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নেয় বনবিভাগ। একদিকে শিকারী চক্রের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান, অন্যদিকে বাঘের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের মনস্তাত্বিক অবস্থান থেকে সরিয়ে আনা। দূরূহ কাজ। তারপরও কাজ শুরু হয়। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে কাজ শুরু করে বনবিভাগের টাইগার রেসপন্স। বাঘরক্ষায় নেওয়া সেই উদ্যোগের সফলতা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই।
টাইগার রেসপন্স টিমের একজন টিমলিডার ছিলেন আমাদের গনি ভাই। ওদিকে পরিচিতি ‘টাইগার গনি’ নামে। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন কালিঞ্চি গ্রামের এই তরুণ নিবিড়ভাবে কাজ করেছেন। বাঁচিয়েছেন বেশ কয়েকটি বাঘের প্রাণ।
শুরুর দিকে লোকালয়ে চলে আসা বাঘ বাঁচাতে গিয়ে প্রতিবেশীদের তোপের মুখে পড়া হতো। কয়েকবার মানুষের আক্রমণেরও শিকার হয়েছেন। তখনও বাঘ নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা ছিলো না বললেই চলে। বরং গ্রামে এসে মানুষের ওপর আক্রমণ, গরু ছাগল নিয়ে যাওয়ার মতো অপরাধের কারণে বাঘকে মেরে ফেলাই ছিলো প্রচলিত। বনের ভেতরে অনেক স্বজনকে বাঘে খেয়েছে, সেই আক্রোশ থেকেও সুযোগ পেলেই বাঘের উপর হামলে পড়তো বনঘেঁষা জনপদের মানুষ।
এমন বাঘবিরোধী মনোভাব থেকে স্থানীয়দের ধীরে ধীরে সচেতন করেছেন টাইগার গনি ও তাঁরা সহযোগিরা। বছর দশেকের চেষ্টায় এখন মানুষ বুঝতে পেরেছে বাঘ বাঁচাতে হবে নিজেদের জন্যই।
গনি ভাই-এর সঙ্গে গল্পে গল্পে জানলাম, লোকালয়ে চলে আসা অন্তত ২০টি বাঘকে বনে ফেরত পাঠাতে পেরেছেন তাঁরা। মিরগাং, মরগাং, টেংড়াখালী, কালিঞ্চি, গোলাখালী থেকে জীবিত বাঘ জঙ্গলে ফিরিয়েছেন তাঁরা। তবে ৫/৬ বার ব্যর্থও হয়েছেন। এখন নানা লোকালয়ে বাঘ আসে না বললেই চলে। আসলেও সচেতন এলাকাবাসী তাকে জঙ্গলে ফিরিয়ে দেয়। এটি বনবিভাগ ও টাইগার রেসপন্স টিমের সফলতা।
এবার আসি একেবারে বিপরীত প্রসঙ্গে। বনের ভেতরে বাঘের আক্রমণে মানুষের মৃত্যু তখন ছিলো নৈমত্তিক ঘটনা। মাছ-কাঁকড়া ধরতে যাওয়া জেলে বাওয়ালীরা জঙ্গলে নামার সময় পরিবার থেকে বিদায় নিয়েই ফিরতো, এখনও পরিস্থিতি তেমনই আছে। বাঘে ধরে নেওয়ার খবর এলেই ঝাঁপিয়ে পড়তো বনবিভাগের টাইগার রেসপন্স টিম। সেই টিমের দুর্দান্ত দলনেতা ছিলেন গনি।
একবুক সাহস নিয়ে তিনি বাঘের মুখ থেকে কেড়ে এনেছেন অন্তত ৮০ জনের মৃতদেহ, দেহাবশেষ। ক্ষতবিক্ষত লাশগুলো নিজের কাঁধে করে নিয়ে আসতেন। অনেক সময় দেখা গেছে, পঁচা-গলা লাশের অংশ নিয়ে আসলেও পরিবার সেই লাশ নিতে চায়নি। অবশেষে নিজেরাই দাফনের ব্যবস্থা করতেন তাঁরা। বাঘের মুখ থেকে জীবিত মানুষও উদ্ধার করেছে টাইগার রেসপন্স টিম। স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে শুধু গনি ভাই অন্তত ২০/২৫ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। তাঁদের অনেকে এখনও বেঁচে আছেন।
বনবিভাগের সঙ্গে টাইগার রেসপন্স টিমে দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে কাজ করেছেন গনি ভাই। সেই কাজ করতে গিয়ে নিজের জীবনও চূড়ান্ত ঝুঁকিতে পড়েছে অন্তত তিনবার। বিশেষ করে সুন্দরবনের ডিঙ্গিমারিতে বাঘের আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরেছেন ভাগ্যক্রমে।
সুন্দরবনঘেঁষা জনপদ কালিঞ্চির হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান গনি ভাই। ছোটবেলা থেকে বখে যাওয়ার সব পরিবেশই ছিলো। গল্পে গল্পে বলছিলেন, ছোটবেলার বন্ধুরা প্রায় সবাই বিপথে গেছে। বনের নেশায়, মানুষের হাত থেকে বাঘ বাঁচাতে, আর বাঘের হাত থেকে মানুষ বাঁচাতে গনি ভাই লড়েছেন নিজের জীবনটাকে বাজি রেখে। গনি ভাই তাই আমার চোখে সুপার হিরো…
[ফেসবুক থেকে]