শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মুকুটের নীলা

প্রকাশিতঃ ৮ মে ২০২০ | ১২:১৬ অপরাহ্ন

সাজেদা আকতার : অচিনতলা রেল স্টেশন। প্রতিনিয়ত ট্রেন আসছে আর যাচ্ছে। কোনো বিরাম নেই। কখনো লাল পতাকা উড়ছে, আবার কখনো সবুজ পতাকা। ঝালমুড়ি, আমড়াওয়ালা, শশাওয়ালা, চকলেট, পেয়ারা, কমলা কোনো কিছুরই যেন অভাব নেই। অভাব নেই দুই-একটা ছ্যাঁচড়া চোরেরও। কালোবাজারি, কুলি, মুচি, তারাও আছে। আর আছে একটু পর পর ঝিক্ ঝিক্ ঝিকাঝিক্ শব্দ।

আমার বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয় অচিনতলা স্টেশন। ট্রেনের হর্ণ ঘরে বসেই শোনা যায়। চাকরির সুবাদে সব সময়ই আমার এই স্টেশনে আসতে হতো। প্রায়ই দেখতাম, তিন নম্বর লাইনের কোল ঘেঁষে, প্লাটফর্মের এক কোণে বসে থাকতে, মাঝবয়সী এক মহিলাকে। মাথায় রুক্ষ জটা চুল, পরনে ছেঁড়া ময়লা কাপড়। দেখে মনে হয় ছয় মাসেও গোসল করেনি। নাম কী তা জানি না। কখনো জিজ্ঞেসও করিনি। তবে সবাই পাগলী বলে। দোকান থেকে খুঁজে খুঁজে খায়। কেউ দেয়, কেউ বলে, ’দূর হও পাগলী’. এভাবে তার দিন যায়।

আসলে পাগলী তো তার নাম নয়। এটা তার রোগও নয়। সে একজন রোগী। মানসিক বিকারগ্রস্ত। কিন্তু আমাদের সুস্থ সমাজের বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষগুলো যখন বিকারগ্রস্তের মতো আচরণ করে, তখন বলতে ইচ্ছে করে, ’ধরনী দ্বিধা হও আমি লুকিয়ে পড়ি।’ প্রায় দুমাস আমার সাথে রেল স্টেশনের কোনো যোগাযোগ ছিল না। ছিল না তথাকথিত পাগলীর সাথেও। কারণ, এই দুমাস আমি রেলপথে যাতায়াত না করে, সড়ক পথে করেছিলাম।

একদিন দেখলাম, এক কোণে বসে সে কোঁকাচ্ছে। যদিও গায়ে হাত দিতে কেমন যেন লেগেছে, তারপরও দেখলাম। তার কোঁকানোর কারণ বুঝতে আমার অসুবিধা হলো না। গায়ে ভীষণ জ্বর। পুড়ে যাচ্ছে যেন। একশত দুই-তিন ডিগ্রি হবে। কী করবো আমি নিজেই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর পাশের ওষুধের দোকান থেকে একপাতা প্যারাসিটামল কিনে একটি খাইয়ে দিয়ে বাকিগুলো পরে খেতে হবে বলে চলে এলাম।

আমার দিকে কিছু কৌতুহলী নেত্র তাকিয়েছিল। কিছু বলার সাহস পায়নি। আমাদের সমাজ এ ধরনের লোকে পরিপূর্ণ, যারা জবরদস্তিপ্রিয়, মোটা বুদ্ধিসম্পন্ন। তাদের কাজ সহযোগিতা নয়, দূরে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখা মাত্র। তারপর অনেকদিন পাগলীর কোনো খবর রাখিনি।আনুমানিক ছয় মাস হবে। একদিন বিবেকের তাড়নায় তাকে দেখতে গেলাম। সেই যে অসুস্থ মানুষটিকে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে রেখে এসেছিলাম। তারপর আর খবর রাখিনি। এটাই বাস্তবতা। আমরা তো সবাই এ সমাজেরই কীট। আমাকে দেখে পাগলী পরম মমতায় এগিয়ে এল। কিন্তু তাকে দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। মনে হলো সে ছয় সাত মাসের অন্তঃসত্তা। তার মানে আমি যখন জ্বর দেখে গিয়েছিলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। পাগলীকে জিজ্ঞেস করলাম, ’কে সেই শয়তান পাষণ্ড?’

পাগলী বললো, ’আমি চিনি না, একদিন রাতে স্টেশনেই ঘুমাচ্ছিলাম। ঘুমের ঘোরে কয়েকজন…’ আর বলতে পারলো না। কেঁদে ফেললো। আমি সান্ত্বনা দিলাম। বললাম, ’এই নরপিশাচরা যতদিন সমাজে থাকবে, ততদিন সমাজের মঙ্গল হবে না। সমাজ এভাবেই গুমরে কাঁদবে।’ তারপর থেকেই কেমন যেন মনের অজান্তেই পাগলীকে দেখে রাখতে শুরু করলাম। এখন আবার ট্রেনে করেই যাতায়াত করি।

আমাদের দেশে সুযোগ সন্ধানী লোকের অভাব নেই। কারো পৌষ মাস,কারো সর্বনাশ। এই সুযোগে দালালচক্র চাঙ্গা হয়ে উঠলো। কোথা থেকে খুঁজে নিয়ে আসলো এক জোড়া নিঃসন্তান দম্পতিকে। সারাক্ষণ সন্তানের জন্য হাহাকার তাদেরকেও তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। এ যেন মেঘ না চাইতেই জলের মতো। নিজের কোল পরিপূর্ণ করতে গিয়ে আরেক অসহায় মায়ের কোল খালি করলো। কেউ কোনো প্রতিবাদটুকু করলো না।

একজন বলল, ’পাগলী কিভাবে এই বাচ্চা পালবে? সে মেরেই ফেলবে।’ আরেকজন বললো, ’বরঞ্চ যেখানে যাচ্ছে, সেখানেই ভালো থাকবে।’ তারপর থেকে পাগলীকে আর স্টেশনে দেখিনি। হয়ত সন্তান শোকে স্টেশন ছেড়ে দিয়েছে। নয়ত পাওয়া যাবে অন্য কোনো স্টেশনে, অন্য কোনো প্লাটফর্মে। নিঃসন্তান মা বাচ্চাটিকে নিজের নাড়িছেঁড়া ধনের মতই বড় করতে লাগলেন। কে তার বাবা, কী তার পরিচয়, কী তার জাতবংশ, সব কিছু অগ্রাহ্য হয়ে গেল মাতৃস্নেহের কাছে।

নাম রেখেছেন নীলা। দামী নীলার মতই মাথায় তুলে রেখেছেন। কোথাও একা যেতে দিতেন না। সর্বক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। এভাবে চার বছর কেটে গেল। নীলা স্কুলে ভর্তি হলো। লেখাপড়া শিখছে। মা তাকে প্রতিদিন নিয়ে যায়, আবার নিয়ে আসে। পরীক্ষার সময় বাবা নিয়ে যায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে নীলা এগিয়ে চলছে। সময়ও দ্রুত বয়ে যাচ্ছে।এক সময় নীলা এইচএসসি পাস করে সহকারী স্টেশন মাস্টারের চাকরি পেল। নিষ্ঠুর নিয়তির কী নির্মম পরিহাস। হয়ত সেই স্টেশনেই তার সেই পাগলী মাকে দেখলো। হয়ত কিছু চাইতে গেলে বলে উঠলো, ’দূর হও পাগলী।’ আমরা এমনই। এটাই আমাদের সমাজ ব্যবস্থা। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করার মতো মন সকলের থাকে না। যেমন আছে সাংবাদিক মুকুটের। হঠাৎ করেই নীলার জীবনে মুকুটের আবির্ভাব। নীলা সব কিছু খুলে বললো, তার জীবনের ইতিহাস। সব শুনে মুকুট রাজী হলো। নীলাকেই জীবনসঙ্গী করবে। নীলার স্থান মুকুটেই…মানবতার ধ্বজা উড়িয়ে মুকুট নীলাকে নিয়ে সুখী সুন্দর দাম্পত্য জীবনের স্বপ্নে বিভোর হলো।