এম কে মনির : পুলিশ কনস্টেবল মো. ইব্রাহিম (২৫); তার বিরুদ্ধে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ১০ লক্ষ টাকা যৌতুক দাবি ও গর্ভের সন্তান নষ্ট করার অভিযোগ তুলেছেন স্ত্রী।
এরপর ২০২১ সালের ২০ জুন এসব অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন খাগড়াছড়ি জেলার পুলিশ সুপার; অনুসন্ধানের দায়িত্ব দেয়া হয় জেলা পুলিশের কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ পরিদর্শক উত্তম চন্দ্র দেবকে।
অনুসন্ধান শেষে ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর ‘অনুসন্ধান প্রতিবেদন’ দাখিল করেন পরিদর্শক উত্তম; যাতে কনস্টেবল ইব্রাহিমের স্ত্রীর অভিযোগ সত্য বলে উল্লেখ করা হয়।
সেই প্রতিবেদনে কনস্টেবল ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে পিআরবি ৮৫৭ বিধি অনুযায়ী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়।
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা ওই ‘অনুসন্ধান প্রতিবেদনের’ সত্যতা নিশ্চিত করেছেন; এবং এটির একটি কপি একুশে পত্রিকার হাতে রয়েছে।
অন্যদিকে ২০২১ সালের ৭ নভেম্বর ইব্রাহিম ও তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ তুলে চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এ মামলা করেন তার স্ত্রী। সেদিন অভিযোগগুলো তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন আদালত।
এরপর উক্ত মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পান পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার এসআই মো. হুমায়ুন কবির। তদন্ত শেষে গত ৬ ফেব্রুয়ারি এই মামলার ‘অনুসন্ধান প্রতিবেদন’ দাখিল করেন তিনি; যাতে উল্লেখ করা হয়, বাদীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি।
অর্থ্যাৎ পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে কনস্টেবল ইব্রাহিম দোষী হলেও আদালতে পুলিশেরই আরেকটি ইউনিটের দেয়া প্রতিবেদনে নির্দোষ।
ঘটনার সময় অভিযুক্ত কনস্টেবল ইব্রাহিম খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশে কর্মরত ছিলেন; ২০২১ সালের ২০ জুলাই খাগড়াছড়ি থেকে তিনি চাঁদপুর বদলি হন।
আদালতে পিবিআইয়ের দেয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে কনস্টেবল ইব্রাহিমের স্ত্রী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যেহেতু আমার স্বামী পুলিশ, তিনি পিবিআইকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছেন। যার কারণে পিবিআইয়ের তদন্তে অসত্য তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।’ পিবিআইয়ের অনুসন্ধান প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে ‘নারাজি’ দেবেন বলেও জানান তিনি।
সন্দ্বীপের বাসিন্দা মো. ইব্রাহিম ২০১৬ সালে পুলিশ বাহিনীতে কনস্টেবল পদে যোগদান করেন। এরপর ২০১৮ সালের নভেম্বরে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশে বদলি হন তিনি। ২০১৯ সালের অক্টোবরে সন্দ্বীপ উপজেলার বাউরিয়া ইউনিয়নের এক নারীকে বিবাহ করেন তিনি।
পরবর্তীতে ২০২১ সালের ২০ অক্টোবর কনস্টেবল মো. ইব্রাহিমের স্ত্রী শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, ১০ লক্ষ যৌতুক দাবি ও গর্ভের সন্তান নষ্ট করার অভিযোগ তুলে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার বরাবর দরখাস্ত করেন। ওই অভিযোগের ভিত্তিতে অভ্যন্তরীণ তদন্ত শুরু করে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ।
সেই তদন্তে স্ত্রীকে মারধর করা, ভয়ভীতি দেখানো, খাগড়াছড়িতে বসবাসকালে রাতের বেলায় তার স্ত্রীর কান্নাকাটি, শরীরের জখমের চিহ্নসহ নানা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগে সত্যতা পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কনস্টেবল মো. ইব্রাহিম দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন; তার বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ সত্য।
ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, “কনস্টেবল মো. ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে তার স্ত্রীকে শারীরিক নির্যাতন ও জখম করার সত্যতা মিলেছে। পুলিশ বাহিনীতে থেকে তার এমন কাণ্ড অসদাচরণ ও নৈতিক স্খলনের পরিচায়ক। কনস্টেবল মো. ইব্রাহিমের কর্মকাণ্ড খাগড়াছড়ি বিভাগীয় পুলিশের নিয়ম শৃঙ্খলা পরিপন্থী ও পুলিশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার জন্য দায়ী এবং চাকরির অযোগ্যতার শামিল।” এতে আরও বলা হয়, “এমন কর্মকাণ্ড গৌরবময় পুলিশের চাকরির প্রতি মো. ইব্রাহিমের অবহেলা, অবজ্ঞা ও অসদাচরণের নামান্তর। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।” পুলিশের সেই অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে কনস্টেবল মো. ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে পিআরবি ৮৫৭ বিধি মতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তে কনস্টেবল ইব্রাহিম দোষী হলেও পিবিআইয়ের তদন্তে তাকে নির্দোষ বলা হয়েছে। পিবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, “পারিপার্শ্বিকতার ভিত্তিতে বাদীদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন ১১(গ) ৩০/ তৎসহ পেনাল কোডের ৩১৩ ধারার অভিযোগ প্রমাণের স্বপক্ষে কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই এবং বাদী নিজেও স্বাক্ষ্য প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছেন।” প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “চিকিৎসা নেয়ার বিষয়ে বাদীর উপস্থাপিত দলিলাদি অসঙ্গতিপূর্ণ। একইসাথে ১০ লক্ষ টাকা যৌতুক দাবির বিষয়টিরও কোন প্রমাণ মেলেনি। বাদীও কোন প্রমাণ দেখাতে পারেনি।”
বাদীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই চট্টগ্রাম জেলার এসআই হুমায়ুন কবির একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আসামি পুলিশ হওয়ায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ার বিষয়টি সত্য নয়। সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে বাদী ও তার পিতাকে নিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে মামলার তদন্ত পরিচালনা করা হয়েছে। তদন্তে যৌতুক দাবি ও বাদীকে নির্যাতনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তদন্তে অভিযোগের বিষয়ে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং বাদী নিজেও প্রমাণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
তবে পিবিআই কর্মকর্তার বক্তব্য সত্য নয় উল্লেখ করে মামলার বাদী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার স্বামী বিয়ের পর থেকেই সংসারে অশান্তি শুরু করেন। পুলিশের চাকরি নিতে তার ১০ লক্ষ টাকা ঋণ হয়। যা তিনি আমার পরিবারের উপর চাপিয়ে দিতে চান। বিয়ের পর থেকেই তিনি আমাকে নানাভাবে নির্যাতন করতেন। এমনকি চাপ দিয়ে গর্ভের সন্তান নষ্ট করেছেন। মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে স্বজনপ্রীতি করা হয়েছে। আমার স্বামী পুলিশ হওয়ায় তাকে নির্দোষ দেখানো হয়েছে।’