বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

তুমিবিহীন এই পথ, এই জীবন বয়ে চলা কঠিন

| প্রকাশিতঃ ৮ নভেম্বর ২০১৭ | ৩:৫৫ অপরাহ্ন

নিয়াজ মোরশেদ নিরু : অন্ধকার কবরে কেমন আছ বাবা? চোখের সামনে প্রতিক্ষণ কেবল ভেসে উঠছে তোমার শিশু-মুখখানি। আমাদের এতিম-অসহায় করে এত তাড়াতাড়ি তুমি যেতে চাওনি। মারা যাবার ৩০ মিনিট আগেও বলেছিলে বাঁচতে চাও তুমি।

তোমার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট তখন। ইউনাইটেড হাসপাতালের সিসিইউতে তোমাকে ঘিরে অক্সিজেন, ভেন্টিলেটরের পাহারা, তবুও শ্বাস নিতে পারছ না তুমি। তোমার কষ্ট দেখে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। কিন্তু কিছুই করতে পারছি না আমি। অসহায়ত্ব কাকে বলে সেদিন জেনেছি নতুন করে।

চোখে না দেখলে কেউ অনুমান করতে পারবে না, শ্বাস নিতে না পারার কী কষ্ট! এই শ্বাস-যুদ্ধের মাঝেও তুমি কী যেন বলতে চাইছ আমাকে। পারছিলে না। আমার দুই চোখে তখন অশ্রুধারা। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমানে। তখনই অতি কষ্টে সেই আপ্তবাক্য ছুঁড়ে দিলে আমাকে। বললে, ‘কাঁদিস না, মিলেমিশে থাকিস সবাই।’

এরপর মুহূর্তেই সব থেমে গেলো। তুমি চলে গেলে আমাকে অনাথ-অসহায় করে। কী নিয়ে থাকব আমি? কার কাছে আমার সব কথা শেয়ার হবে? পরামর্শে-মমতায় কে আমায় পথ বাতলে দেবে? কে শোনাবে আমাকে অভয়বাণী? আমি জানি এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। তবে এটুকু বুঝি, বুঝতে পারি- তুমিবিহীন এই পথ, এই জীবন বয়ে চলা কত কঠিন আমার জন্য!

সব বাবাই সন্তানের জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। কিন্তু তুমি ছিলে শ্রেষ্ঠ’র শ্রেষ্ঠ। তোমার মত বাবা হয় না। আমার কাছে তুমি ‘কমন’ কোনো বাবা নও। বাবা হিসেবে তোমার তুলনা শুধু তুমি। মানুষকে ভালোবাসার, কাছে টানার কী এক সম্মোনহী ক্ষমতা তোমার! যারা একবার মিশেছে, নির্ঘাত তোমার ভক্ত-অনুরক্ত হয়েছে।

তুমি ছিলে জ্ঞানের আধার, মেধার চূড়ান্ত। প্রায়সব বিষয়ে তোমার অসাধারণ জ্ঞান ছিল, ছিল পাণ্ডিত্য। রুচিবোধেও অত্যুজ্জ্বল তুমি। তোমার পোশাক-আশাক, খাওয়া-দাওয়া, চলন-বলন অনন্য, আলাদা। তুমি ব্র্যান্ডের কোর্ট, শার্ট, প্যান্ট পরতে। পছন্দ করতে রাডো ঘড়ি। জুতো পরতে চামড়ার-সবমিলিয়ে পরিপাটি একজন মানুষ।

তুমি ছিলে গরীবের বন্ধু। নির্যাতিত মানুষের প্রতিধ্বনি। গোপনে গরীবদের সাহায্য করে, নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তুমি আনন্দ খুঁজতে। এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে তোমার সংযোগ, উৎসর্গীত হওয়ার কথা সবারই জানা।

সত্যভাষি, স্পষ্টভাষির বড় উপমা তুমি। তুমি অন্তপ্রাণ, প্রচারবিমুখ, সাহসী মানুষের প্রতিচ্ছবি। সাদাকে সাদা কিংবা কালোকে কালো বলার অসীম সাহসের মানুষ। মন্দ কাজের নিন্দা করতে প্রকাশ্যে, কোনো কিছু পরোয়া না করে। তোমার বাবার (আমার দাদা) পেশা, ব্যক্তিত্ব তোমার দুর্বিনীত সাহসের ঠিকানা। গৌরবের সঙ্গে প্রায়শ বলতে ‘আমি শিক্ষক পিতার সন্তান, আমি মাথা ঊঁচু করে কথা বলব।’

খেলাধূলায় তোমার তোমার কী উৎসাহ! বিশ্বকাপ ফুটবল, ক্রিকেট, রেসলিং দেখতে রাতজেগে। বিশ্বকাপ ফুটবলে তুমি আর্জেন্টিনা। আর ক্রিকেটে বাংলাদেশের পর ভারত; ইংলিশ প্রিমিয়ার লীগে ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেড, উয়েফা চ্যাম্পিয়নলীগে বার্সেলোনা’র কড়া সমর্থক তুমি। তুমি ছিলে সংগীত-সমঝদার। রবীন্দ্রসংগীত শুনতে গুন গুন করে। খুবই পছন্দ রবীন্দ্রসংগীত তোমার।

বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়েও ছিল তোমার গভীর জ্ঞান। উপমহাদেশের ক্ষমতা পটপরিবর্তনের ইতিহাস- সে তো তোমার কাছেই শোনা আমাদের। কী নিখুঁতভাবে শোনাতে রাজনীতি ও ক্ষমতার পটপরিবর্তনের গল্পগুলো। আমরা মনমুগ্ধ হয়ে শুনতাম। বিভিন্ন মনীষীর গল্প শোনাতে আমাদের। তোমার স্মৃতিশক্তি প্রবল।

মুক্তিযুদ্ধ, প্রগতিশীলতা তোমার নিত্যচর্চা। ছিলে আওয়ামী লীগের কড়া সমর্থক। রাউজান কলেজ, সরকারী সিটি কলেজ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা ও নানা আন্দোলন সংগ্রামে তোমার ওতপ্রোততা আমাদের নিয়ত আন্দোলিত করে। মুক্তিযুদ্ধের পর রাজনৈতিকভাবে তোমার তেমন করে মূল্যায়ন হয়নি। এ নিয়ে তোমার আক্ষেপও কম ছিল না।

আমাদের প্রতি তোমার নিত্য সদুপদেশ- ‘কোনো কিছুতে অতিরিক্ত বা লোকদেখানো কিছু করো না, মধ্যপন্থা নীতি অনুসরণ করো, অহংকার রেখো না, দেখবে জীবনে কষ্ট পাবে না।’

বাবা তুমি নেই। জানি আসবেও না কোনোদিন। তোমার আদর্শ, তোমার স্মৃতিগুলোই এখন আমাদের জীবনচলার প্রেরণা, বড় শক্তি। তোমাকে আশ্বস্ত করতে চাই- তোমার দেখানো, বলে দেওয়া পথেই চলছি আমরা বাড়বাড়ন্ত লোকসংখ্যার ভিড়ে ‘মানুষ’ হওয়ার ব্রত নিয়ে। যেখানে থাকো, অনেক ভালো থেকো বাবা।

সংক্ষিপ্ত জীবনী : ১৯৪৮ সালে এ. কে. জাফর খান চট্টগ্রাম রাউজান উপজেলার কাগতিয়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম সিরাজুল হক মাস্টার ছিলেন একজন স্বনামধন্য শিক্ষক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। তার মা মরহুম আমেনা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। চার সন্তানের সংসারে তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় ভাইয়ের নাম মরহুম এ. কে. আহমেদ ছগির (সাবেক উপ পরিচালক, পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর)।

তার শৈশব কেটেছে কাগতিয়া গ্রামে। প্রাইমারী স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। বিনাজুরী নবীন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এস.এস.সি পাশ করেন। রাউজান কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং সরকারী সিটি কলেজ থেকে বি.কম পাশ করেন ১৯৭২ সালে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন।

১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেন। চাকরিতে যোগদানের পর একই গ্রামের মরহুম তৈয়মুল হক ও মাহফুজা খাতুনের বড় কন্যা সেলিনা আক্তারের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। সংসার জীবনে তিনি ২ সন্তান ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। চাকারিজীবনে তিনি সৎ, দক্ষ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটিসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরি করেছেন। সর্বশেষ ২০০৮ সালে রাঙ্গামাটি বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

অবসর গ্রহণের পর তিনি এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নেন। উত্তাল সময়ে স্বাধীনতার মহান আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। তিনি একজন সদালাপী ও অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে সমাজে পরিচিতি লাভ করেন। ২০১৬ সালে বিনাজুরী নবীন উচ্চ বিদ্যালয়-এর গভর্নিং বডির সভাপতি নির্বাচিত হন। তার বড় ছেলে আরিফ মোরশেদ কর্ণফুলি গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির কর্মকর্তা। মেঝ ছেলে নিয়াজ মোরশেদ নিরু প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি’র সহকারী একান্ত সচিব। তার কন্যা নাজমা বানু গৃহিণী।

মরহুম এ. কে. জাফর খান গত ৫ অক্টোবর ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁকে রাউজানের নিজ বাড়ি মাতব্বর জামে মসজিদ কবরস্থানে দাফন করা হয়।