বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সীমান্তের ওপারে নিষিদ্ধ জগৎ: ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’-এর পাতায় পাতায়

শরীফুল রুকন | প্রকাশিতঃ ৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ | ৩:১৬ অপরাহ্ন

ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল
জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মুহাম্মদ সেলিমের ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ শুধু একটি বই নয়, যেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক অন্ধকার জগতের অতলে ডুব দিয়ে, সেখানকার লুকানো সত্যকে সাহসের সঙ্গে তুলে আনার এক রুদ্ধশ্বাস অভিযান। দশটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত এই বইটি বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের ত্রিদেশীয় সীমান্ত অঞ্চলের জটিল ভূ-রাজনীতি, অপরাধ আর মানবিক সংকটের এক পুঙ্খানুপুঙ্খ দলিল। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন, যা এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতার পেছনের কারণগুলো বুঝতে সাহায্য করে।

বইটির শুরুতেই ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ অধ্যায়ে লেখক যেন আমাদের সরাসরি নিয়ে যান সেই অপরাধজগতের কেন্দ্রবিন্দুতে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর নিরাপদ আশ্রয়স্থল আর মাদক ব্যবসার স্বর্গরাজ্য হিসেবে গড়ে ওঠা এই অঞ্চলের চিত্র জীবন্ত হয়ে ওঠে লেখকের বর্ণনায়। দুর্গম এলাকা, দারিদ্র্য আর অর্থনৈতিক সংকট কীভাবে এই অস্থিতিশীলতাকে আরও উস্কে দিচ্ছে, তা-ও উঠে আসে।

‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের বাংলাদেশ অংশ’ অনুচ্ছেদে লেখক বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ওপর ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের প্রভাব, পপি চাষ, মাদক উৎপাদন আর অস্ত্র ব্যবসার বিস্তার নিয়ে আলোকপাত করেছেন। এই অঞ্চলটি কীভাবে মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে, যা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট নিরাপত্তা ঝুঁকি—তা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।

‘রাখাইন রাজ্যে নতুন সমীকরণ’ অধ্যায়টি যেন এই অঞ্চলের সাম্প্রতিক ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। আরাকান আর্মির উত্থান, রাখাইনের ওপর তাদের ক্রমবর্ধমান নিয়ন্ত্রণ আর এর ফলে সৃষ্ট মানবিক সংকট—এই অধ্যায়ের মূল বিষয়। লেখক দক্ষতার সঙ্গে দেখিয়েছেন, এই নতুন সমীকরণ কীভাবে এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।

‘রোহিঙ্গা কারা’ অধ্যায়ে রোহিঙ্গাদের ঐতিহাসিক পরিচয়, তাদের ওপর চলমান নির্যাতন আর রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠী হিসেবে তাদের মানবেতর জীবনযাপনের এক মর্মস্পর্শী চিত্র আঁকা হয়েছে। এই অধ্যায়টি পাঠকের মনে রোহিঙ্গাদের প্রতি গভীর সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।

‘রাখাইনে যত সংগঠন’ অধ্যায়ে লেখক এই অঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের ইতিহাস, তাদের উদ্দেশ্য আর কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছেন। এই অধ্যায়টি পড়লে বোঝা যায়, কেন রাখাইন অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে অস্থিতিশীলতার কেন্দ্রবিন্দু।

‘আরাকান আর্মি’ অনুচ্ছেদে লেখক এই অঞ্চলের অন্যতম শক্তিশালী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির উত্থান, তাদের অর্থায়নের উৎস, সামরিক শক্তি আর নারী সদস্যদের অংশগ্রহণ সম্পর্কে তথ্যবহুল আলোচনা করেছেন। আরাকান আর্মির সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম্পর্কের জটিল দিকগুলোও লেখক তুলে ধরেছেন।

‘স্যাম গোরর’-‘দ্যা কোম্পানি’ অনুচ্ছেদে লেখক এশিয়ার কুখ্যাত মাদকসম্রাট সে চি লপ এবং তার মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম উন্মোচন করেছেন। এই অধ্যায়টি যেন ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের মাদক ব্যবসার বৈশ্বিক নেটওয়ার্কের এক ঝলক দেখায়।

‘হরকাতুল ইয়াকিন থেকে আরসা’ এবং ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন’ অনুচ্ছেদ দুটিতে লেখক যথাক্রমে আরসা এবং আরএসও-র মতো রোহিঙ্গা সশস্ত্র সংগঠনগুলোর উত্থান, তাদের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই সংগঠনগুলোর উত্থানের পেছনের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণগুলোও লেখক বিশ্লেষণ করেছেন।

বইটির অন্যতম শক্তিশালী দিক হলো বিশেষজ্ঞ সাক্ষাৎকার। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির খন্দকারের সাক্ষাৎকার ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের মাদক সমস্যা এবং এর সমাধানে করণীয় সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্দৃষ্টি দেয়।

বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদনের সংকলন বইটির বিষয়বস্তুকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। এই প্রতিবেদনগুলো বাংলাদেশের মাদক বাজারের ভয়াবহ চিত্র আর ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল থেকে আসা মাদকের প্রভাব সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেয়।

‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ বইটির বৈশিষ্ট্যগুলো হলো: গভীর অনুসন্ধান, বস্তুনিষ্ঠ উপস্থাপনা, সাবলীল ভাষা, মানবিক আবেদন এবং সময়োপযোগীতা। দীর্ঘ গবেষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য লেখক নিপুণভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। পক্ষপাতহীনভাবে তথ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি বিভিন্ন পক্ষের বক্তব্যও তুলে ধরা হয়েছে। বইটির ভাষা সহজবোধ্য ও প্রাঞ্জল, ফলে যে-কোনো পাঠকের জন্যই এটি সুখপাঠ্য। লেখক ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের মানবিক সংকটের দিকটি অত্যন্ত সংবেদনশীলতার সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। আর বইটি বর্তমান সময়ের এক জ্বলন্ত সমস্যাকে কেন্দ্র করে লেখা, তাই এর প্রাসঙ্গিকতাও অনেক বেশি।

‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ বইটি পড়লে আপনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতি, অপরাধ আর মানবিক সংকট সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেলের অস্থিতিশীলতার কারণ ও এর প্রভাব, রোহিঙ্গা সমস্যার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বর্তমান অবস্থা, মাদক এবং অস্ত্র ব্যবসার ভয়াবহ বিস্তার এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন সশস্ত্র সংগঠন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন। এক কথায়, বইটি এই অঞ্চলের জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

মুহাম্মদ সেলিমের ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ একটি তথ্যবহুল, বিশ্লেষণধর্মী এবং সময়োপযোগী গ্রন্থ। এই বইটি শুধু গবেষক, সাংবাদিক, বা নীতিনির্ধারকদের জন্য নয়, সাধারণ পাঠকদের জন্যও অবশ্যপাঠ্য। যারা এই অঞ্চলের জটিল বাস্তবতা সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাদের জন্য ‘ব্ল্যাক ট্রায়াঙ্গেল’ পড়াটা জরুরি। এই বই আমাদের চোখ খুলে দেবে এক অন্ধকার জগতের দিকে, আর ভাবিয়ে তুলবে এই অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নিয়ে।

বইমেলায় আবির প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ১২৮ পৃষ্ঠার এই বইটির দাম রাখা হয়েছে ৪০০ টাকা। ঢাকার অমর একুশে বইমেলার ৭২৯ নং স্টল এবং চট্টগ্রামের অমর একুশে বইমেলার ৯২-৯৩ নং স্টলে বইটি পাওয়া যাচ্ছে।

লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা।