বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

চট্টগ্রামে নিরাপদ প্রসব নিয়ে শঙ্কা: সরকারি কিট কোথায়?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২৮ মে ২০২৫ | ১০:২৩ পূর্বাহ্ন


আজ ২৮ মে, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ‘জন্ম হোক সুরক্ষিত, ভবিষ্যৎ হোক আলোকিত’ সামনে রেখে আমরা এই দিনটি পালন করছি। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিনে মায়েদের সুরক্ষিত জন্ম নিশ্চিত করার বদলে আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে জানাচ্ছি এক সংকটজনক পরিস্থিতির কথা। বিশেষত আমাদের চট্টগ্রাম অঞ্চলের গরিব ও সাধারণ পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা মায়েদের জন্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবার একটি জরুরি দিক মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হাসপাতাল ও কেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিক প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ ও সরঞ্জামের প্যাকেট, যা ‘নরমাল ডেলিভারি কিট’ নামে পরিচিত, তার সরবরাহ এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য জরুরি ওষুধের প্যাকেট ‘ড্রাগ অ্যান্ড ডায়েটারি সাপ্লিমেন্ট (ডিডিএস) কিট’ এর সরবরাহও বন্ধ আছে বিগত ছয় মাস ধরে। এই সংকট দেশব্যাপী, এবং আমাদের চট্টগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়। দুঃখজনকভাবে, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পণ্যাগারেও এই জরুরি কিটগুলোর মজুদ বর্তমানে শূন্য।

এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রগুলোতে। এই কেন্দ্রগুলো থেকে অত্যাবশ্যকীয় কিটগুলো সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামসহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের হাজারো গর্ভবতী মা, যারা বিনামূল্যে সরকারি সেবার আশায় এই কেন্দ্রগুলোতে আসেন, তারা চরম ভোগান্তি ও অনিশ্চয়তার শিকার হচ্ছেন।

সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে মূলত সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষেরাই বেশি আসেন, একথা আমরা সবাই জানি। চট্টগ্রামে বসবাসরত বিশাল সংখ্যক পোশাক শ্রমিক, দিনমজুর এবং অন্যান্য স্বল্প আয়ের মানুষের পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারীরা স্বাভাবিকভাবেই এই সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। যখন একজন মা প্রসবব্যথা নিয়ে হাসপাতালে আসেন, তখন তিনি ও তার পরিবার আশা করেন যে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতা তারা রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাবেন।

স্বাভাবিক প্রসবের জন্য স্যালাইন, বিভিন্ন জরুরি ওষুধপত্র, জীবাণুমুক্ত গ্লাভস, তুলা, গজ, স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ প্রায় সতেরো ধরনের উপকরণ ‘নরমাল ডেলিভারি কিট’-এ থাকার কথা। অন্যদিকে, ‘ডিডিএস কিট’-এ থাকে আয়রন, ফলিক অ্যাসিড, ক্যালসিয়াম, ভিটামিনসহ প্রায় পঁচিশ ধরনের ওষুধ। এই ওষুধগুলো গর্ভকালীন এবং প্রসব পরবর্তী সময়ে মা ও শিশুর পুষ্টি জোগায় ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা রাখে।

কিন্তু বাস্তবতা হলো, যখন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায় যে এই অত্যাবশ্যকীয় উপকরণগুলো তাদের কাছে নেই এবং বাইরে থেকে কিনে আনতে হবে, তখন সেই গরিব পরিবারটির ওপর এক আকস্মিক ও বিরাট আর্থিক চাপ নেমে আসে। অনেক ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিকভাবে এই অতিরিক্ত অর্থ জোগাড় করা তাদের পক্ষে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। এর ফলে, অনেক পরিবারকে ধারদেনা করতে হয়, আবার কেউ কেউ হয়তো প্রয়োজনীয় কিছু উপকরণ ছাড়াই ঝুঁকিপূর্ণ প্রসবের মতো কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেন নিজেদের।

আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, এই পরিস্থিতির কারণে অনেক মা হয়তো হাসপাতালেই আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এটি বাড়িতে অদক্ষ হাতে প্রসবের ঝুঁকি অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাড়িয়ে দেয় এবং ফলস্বরূপ মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার বৃদ্ধির কারণ হতে পারে। এমনকি হাসপাতালের পরিচালকেরাও স্বীকার করছেন যে, এই কিট সরবরাহ বন্ধ থাকার কারণে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যাও আগের চেয়ে কমে গেছে। মায়েরা মূলত বিনামূল্যে ওষুধ ও সেবার জন্যই আসেন, সেটি না পেলে তাদের আসার আগ্রহ কমে যাওয়াই স্বাভাবিক।

চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপটে বিষয়টি আমাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। আমাদের শহরের বিভিন্ন মাতৃসদন এবং জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ের কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মা আসেন নিরাপদে তাদের সন্তান জন্মদানের বুকভরা আশা নিয়ে। যখন এই কেন্দ্রগুলোতেই বিনামূল্যে প্রাপ্য সরকারি ওষুধ ও সরঞ্জাম অনুপস্থিত থাকে, তখন ‘সুরক্ষিত জন্ম’ এবং ‘আলোকিত ভবিষ্যৎ’ এর মতো গুরুত্বপূর্ণ স্লোগানগুলো তাদের কাছে অর্থহীন মনে হতে পারে।

এই দেশব্যাপী সংকটের মূল কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচির (চতুর্থ এইচপিএনএসপি) মেয়াদ শেষ হওয়ার পর নতুন প্রকল্প অনুমোদনে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব ঘটেছে। একইসাথে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণেও এই জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানা যায়। পূর্ববর্তী কর্মসূচির অপারেশন প্ল্যান (ওপি) স্থগিত করে নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরির যে প্রক্রিয়া, তাতে প্রায় নয় মাস সময় কেনাকাটা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। এই দীর্ঘ প্রশাসনিক জটিলতা ও সমন্বয়হীনতার ফলে ধীরে ধীরে মজুত শেষ হয়ে বর্তমানে তা শূন্যের কোঠায় এসে ঠেকেছে।

এটি অত্যন্ত দুঃখজনক একটি বাস্তবতা যে, একটি চলমান এবং মা ও শিশুর স্বাস্থ্যের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি শেষ হওয়ার আগেই তার ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা কেন গ্রহণ করা হলো না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দূরদর্শিতার অভাব এবং আন্তঃবিভাগীয় সমন্বয়হীনতার কারণেই আজ দেশের লক্ষ লক্ষ মায়ের মতো চট্টগ্রামের মায়েরাও এই চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলেছেন যে, সরকারি কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাব ছিল এবং এই অবহেলাজনিত সংকটের জন্য তাদের অবশ্যই জবাবদিহি করা উচিত।

চট্টগ্রামের একজন দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি, এই গভীর সংকট থেকে দ্রুত উত্তরণের জন্য অবিলম্বে কিছু বাস্তবসম্মত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।

প্রথমেই, কোনো প্রকার বিলম্ব না করে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় তহবিল বরাদ্দ করতে হবে। রাজস্ব খাত থেকে হোক বা অন্য কোনো জরুরি তহবিল থেকে হোক, অবিলম্বে নরমাল ডেলিভারি কিট ও ডিডিএস কিট সংগ্রহ করে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পণ্যাগারসহ সারাদেশের সকল কেন্দ্রে এগুলো পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর জুন মাসের মধ্যে সরবরাহ পুনরায় শুরু করার যে আশ্বাস দিয়েছে, তার দ্রুত ও সফল বাস্তবায়ন আমরা দেখতে চাই।

এর পাশাপাশি, প্রস্তাবিত নতুন উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব বা ডিপিপি যত দ্রুত সম্ভব অনুমোদন করে একটি দীর্ঘমেয়াদী ও টেকসই সমাধানের পথে এগোতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়ায় যেন আর কোনো প্রকার আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা বা জটিলতা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেদিকে সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে।

ভবিষ্যতে যেন মা ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি আর কখনো তৈরি না হয়, সেজন্য এক প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী প্রকল্পের যাবতীয় কার্যাবলী ও প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রাখতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মধ্যে আরও কার্যকর ও নিবিড় সমন্বয় স্থাপন এখন সময়ের দাবি।

চট্টগ্রামের স্থানীয় পর্যায়েও তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন এবং সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত তাদের নিজ নিজ আওতাধীন কেন্দ্রগুলোতে এই জরুরি কিটগুলোর প্রাপ্যতা নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করা। কোনো প্রকার সংকট দেখা দিলে বা মজুত কমে আসার আভাস পেলে দ্রুততার সাথে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিতে হবে। স্থানীয়ভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাও এ বিষয়ে অত্যন্ত সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।

সবশেষে, এই যে সংকট তৈরি হলো, যার কারণে অসংখ্য মা ও শিশু ঝুঁকিতে পড়লো, এই অবহেলার দায় অবশ্যই কাউকে না কাউকে নিতে হবে। একটি স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি নিশ্চিত করা গেলে ভবিষ্যতে এমন সংবেদনশীল বিষয়ে গাফিলতি করার প্রবণতা হ্রাস পাবে।

মাতৃমৃত্যু এবং শিশুমৃত্যুর হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যে উল্লেখযোগ্য সাফল্য গত কয়েক দশকে অর্জন করেছে, তা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। কিন্তু এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সংকট সেইসব সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে এবং আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে পারে। চট্টগ্রামে আমরা কোনো মা’কে তার সন্তান জন্মদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ ও আবেগঘন মুহূর্তে অসহায় বোধ করতে দিতে পারি না। রাষ্ট্রের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, প্রতিটি মায়ের জন্য নিরাপদ ও সম্মানজনক প্রসবের পরিবেশ নিশ্চিত করা আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব।

আসুন, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, মায়েদের প্রকৃত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য যার যার অবস্থান থেকে সম্মিলিতভাবে কাজ করি। চট্টগ্রামের প্রতিটি মায়ের মুখে যেন ফুটে ওঠে আত্মবিশ্বাসের হাসি, প্রতিটি নবজাতক যেন সুস্থ ও নিরাপদে এই পৃথিবীর আলো দেখতে পায় – আজকের দিনে এটাই আমাদের আন্তরিক প্রত্যাশা ও অঙ্গীকার।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।