বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

বায়োগ্যাসের সহজ বিপ্লব: গ্রামের উনুনে জ্বলবে গ্যাস, আবর্জনা হবে সার

এ কে এম ফজলুল করিম | প্রকাশিতঃ ৩ জুলাই ২০২৫ | ১০:৩৯ পূর্বাহ্ন


বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদের রান্নাঘর থেকে যুগ যুগ ধরে ভেসে আসে কাঠ পোড়ানোর ধোঁয়া। চুলা জ্বালানোর জন্য প্রতিদিনকার সঙ্গী হলো খড়-কুটা, নাড়া আর শুকনা গোবর। পরিসংখ্যান বলছে, দেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন এ ধরনের সনাতনী জ্বালানির প্রয়োজন হয়। এর যোগান দিতে গিয়ে উজাড় হচ্ছে আমাদের বনজ সম্পদ, যা পরিবেশকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অন্যদিকে, গোবর বা অন্যান্য পচনশীল বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে আবাদি জমি তার জন্য অতি প্রয়োজনীয় জৈব সার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই জ্বালানি সংকট আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।

এই জটিল সংকটের এক সহজ, টেকসই এবং যুগান্তকারী সমাধান হতে পারে বায়োগ্যাস। এটি শুধু একটি বিকল্প জ্বালানি নয়, এটি গ্রামীণ জীবনযাত্রাকে বদলে দেওয়ার এক দারুণ সুযোগ, যা নিশ্চিত করতে পারে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, উন্নত মানের জৈব সার, পরিচ্ছন্ন জ্বালানি এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি।

বায়োগ্যাস কী এবং কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?

বায়োগ্যাস হলো এক বিশেষ ধরনের জ্বালানি গ্যাস, যা যেকোনো পচনশীল জৈব পদার্থ থেকে তৈরি হয়। যেমন—গরুর গোবর, মুরগির বিষ্ঠা, মানুষের মল কিংবা বাড়ির পচনশীল আবর্জনা। এই বর্জ্যগুলোকে যখন একটি আবদ্ধ ও বায়ুশূন্য পাত্রে রাখা হয়, তখন ব্যাকটেরিয়ার প্রভাবে পচে গিয়ে এক ধরনের গ্যাস তৈরি হয়। এই গ্যাসই হলো বায়োগ্যাস, যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই হলো মিথেন—একটি অত্যন্ত দাহ্য গ্যাস।

জ্বালানি হিসেবে বায়োগ্যাসের ক্ষমতা বিপুল। উৎপন্ন তাপের হিসাবে মাত্র ১ ঘনমিটার বায়োগ্যাস প্রায় ০.৭৬ লিটার কেরোসিন, ৫.২ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ বা ৪.৮ কেজি জ্বালানি কাঠের সমান শক্তি উৎপন্ন করতে পারে। এই তথ্যই প্রমাণ করে, বায়োগ্যাস কতটা কার্যকর একটি জ্বালানি। যদিও প্রাকৃতিক গ্যাসের তুলনায় এতে মিথেনের পরিমাণ কিছুটা কম, তবুও এটি একটি অত্যন্ত কার্যকর বিকল্প।

শুধু জ্বালানি নয়, বদলে যাবে জীবনযাত্রা

বায়োগ্যাসের সুবিধা শুধু জ্বালানি সংকট মোকাবিলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি গ্রামীণ জীবনযাত্রায় এক স্বাস্থ্যকর ও অর্থনৈতিক বিপ্লব নিয়ে আসতে পারে। বায়োগ্যাস ব্যবহারে কোনো ধোঁয়া হয় না, ফলে রান্নার পাতিল বা রান্নাঘর কালো হওয়ার ঝামেলা থাকে না। এটি যেমন স্বাস্থ্যসম্মত, তেমনি নিরাপদ। লাকড়ির চুলায় রান্না করলে যে ধোঁয়া তৈরি হয়, তা নারীদের চোখ জ্বালা করা, শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের নানা জটিল রোগের কারণ হতে পারে। বায়োগ্যাস ব্যবহারে এই স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে না।

সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি নারীদের সময় বাঁচায়। জ্বালানি কাঠ বা খড়কুটো সংগ্রহের জন্য প্রতিদিন যে মূল্যবান সময় ব্যয় হতো, সেই সময়ে তারা অন্য কাজ করতে পারেন। অন্যদিকে, খামারের বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলে রাখলে পরিবেশ নোংরা ও দুর্গন্ধময় হয়, মশা-মাছির উপদ্রব বাড়ে। বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এই বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করে পরিবেশ দূষণও রোধ করে।

বর্জ্য থেকে সম্পদ: বায়ো-স্লারি এক জাদুকরী সার

বায়োগ্যাস প্ল্যান্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপজাত হলো ‘বায়ো-স্লারি’। প্ল্যান্টের ভেতর গোবর বা অন্যান্য বর্জ্য পচে যাওয়ার পর গ্যাস উৎপাদনের শেষে যে অর্ধতরল বর্জ্য অবশিষ্ট থাকে, তাই হলো বায়ো-স্লারি। এটি এক কথায় এক জাদুকরী জৈব সার। সাধারণ গোবরের চেয়ে এই সারে উদ্ভিদের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদানের গুণগত মান অনেক বেশি থাকে।

জমিতে এই সার ব্যবহার করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে, অধিক ফসল উৎপাদিত হয় এবং রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমে আসে। শুধু তাই নয়, পুকুরে বা মৎস্য খামারে ব্যবহার করলে এটি মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি করে। এমনকি ভার্মি-কম্পোস্ট তৈরি এবং মাশরুম চাষেও এটি ব্যবহার করা সম্ভব। অর্থাৎ, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট শুধু গ্যাসই দেয় না, একটি খামারের বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার মূল চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।

কীভাবে তৈরি করবেন বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট?

বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট স্থাপন করা এখন আর কোনো কঠিন কাজ নয়। এর জন্য প্রয়োজন সামান্য কিছু পূর্বশর্ত। রান্নাঘর বা গোয়ালঘরের আশেপাশে প্রায় ২০০ বর্গফুটের মতো খোলামেলা জায়গা এবং কমপক্ষে ৩টি গরু বা ২০০টি মুরগি থাকলেই একটি ছোট আকারের প্ল্যান্ট স্থাপন করা সম্ভব।

প্ল্যান্টের আকার এবং খরচ নির্ভর করে পরিবারের সদস্য সংখ্যা এবং গরুর সংখ্যার ওপর। যেমন, ৭-৮ সদস্যের একটি পরিবারের জন্য ৫-৬টি গরুর দৈনিক গোবর থেকে যে গ্যাস উৎপাদন সম্ভব, তা দিয়ে তিন বেলার রান্না-বান্না সহজেই সেরে ফেলা যায়। বর্তমানে ইট-সিমেন্টের সনাতনী প্ল্যান্টের পাশাপাশি সহজে স্থাপনযোগ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী ফাইবার বায়োগ্যাস প্ল্যান্টও দেশে তৈরি হচ্ছে, যা এই প্রযুক্তিকে আরও সহজলভ্য করে তুলেছে।

এক নতুন বিপ্লবের হাতছানি

বর্তমানে বাংলাদেশে গরু-মহিষের সংখ্যা আনুমানিক ২ কোটি ২০ লাখ। এই বিপুল পরিমাণ গবাদিপশুর গোবর থেকে বছরে যে পরিমাণ বায়োগ্যাস পাওয়া সম্ভব, তা দিয়ে দেশের গ্রামীণ জ্বালানি সংকট অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব। গ্যাস হিসেবে ব্যবহারের পর অবশিষ্ট গোবর জমির জন্য উৎকৃষ্ট মানের জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।

জ্বালানি সংকটের এই যুগে এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, আমাদের দেশে বায়োগ্যাসের প্রসার ততটা ঘটেনি, যতটা হওয়া উচিত ছিল। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও গবেষণা পরিষদের জ্বালানি গবেষণা ইনস্টিটিউট এই বিষয়টি নিয়ে বহু বছর ধরে কাজ করছে। এখন প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে এই প্রযুক্তিকে প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে দেওয়া।
এটি কেবল একটি প্রযুক্তি নয়, এটি বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরি এবং আত্মনির্ভরশীল গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে তোলার এক দারুণ সুযোগ। আশা করা যায়, এই বায়োগ্যাস বিপ্লব বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে এক নতুন আলোর দিশারী হয়ে উঠবে।