বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সীমান্তে মাইনের ফাঁদে বিপন্ন জীবন, দায় কার?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ৪ জুলাই ২০২৫ | ১২:৪৭ অপরাহ্ন

নজরুল কবির দীপু
বাংলাদেশের পার্বত্য সীমান্ত অঞ্চল নাইক্ষ্যংছড়িতে বসবাস করা এখন এক বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার নাম। সেখানকার মানুষের জন্য প্রতিটি পদক্ষেপেই ওঁৎ পেতে থাকে এক নীরব ঘাতক—স্থলমাইন। একটি ভুল পদক্ষেপেই ঝরে যাচ্ছে প্রাণ, কিংবা আজীবনের জন্য বরণ করতে হচ্ছে পঙ্গুত্ব। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এক চলমান মানবিক সংকট, যা নিয়ে আমাদের গুরুত্ব সহকারে ভাবার সময় এসেছে।

বিগত সাড়ে আট বছরে নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, দোছড়ি, সদর এবং রুমার রেমাক্রীপ্রাংসা ইউনিয়নে অন্তত ৫৭ জন মাইন বিস্ফোরণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে পাঁচজন প্রাণ হারিয়েছেন এবং ৪৪ জন হারিয়েছেন তাদের পা। এই পরিসংখ্যান শুধু কিছু সংখ্যা নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে ৪৪টি পরিবারের ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন আর উপার্জনক্ষম মানুষটির অসহায়ত্ব। যে মানুষটি একদিন পরিবারের অবলম্বন ছিলেন, তিনিই আজ পরিবারের বোঝা হয়ে দিন কাটাচ্ছেন।

এক মুহূর্তের একটি বিস্ফোরণ শুধু একজন ব্যক্তিকে পঙ্গু করে না, এটি একটি পুরো পরিবারকে দারিদ্র্য ও হতাশার এক অন্তহীন চক্রে ফেলে দেয়। সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে শেষ সম্বলটুকুও বিক্রি করে দিতে হয়। এই শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই তাদের বাকি জীবন কাটাতে হয়, যা এক জীবন্মৃত অবস্থারই নামান্তর।

এই সংকটের শুরু মূলত ২০১৭ সালে, যখন মিয়ানমারের সেনাবাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। তখন থেকেই সীমান্তে মাইন স্থাপনের ঘটনা বাড়তে থাকে। পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ রূপ নেয় ২০২৩ সাল থেকে, যখন মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির হাত থেকে সীমান্ত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) হাতে চলে যায়। এরপর থেকে মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা আরও বেড়েছে। আরাকান আর্মি একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী হওয়ায় আন্তর্জাতিক আইন বা রীতিনীতির প্রতি তাদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে তাদের সঙ্গে আলোচনার কোনো আনুষ্ঠানিক পথ খোলা না থাকায় কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করাও অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই পরিস্থিতিতে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিশেষ করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, মাইন বিস্ফোরণের ঘটনাগুলো ঘটছে সীমান্তের শূন্যরেখার ওপারে, অর্থাৎ মিয়ানমারের ভূখণ্ডে। তাদের টহল ফাঁকি দিয়ে যারা অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করছেন, তারাই দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। সীমান্ত এলাকার মানুষকে বারবার সতর্কও করা হচ্ছে বলে জানানো হয়।

এই বক্তব্য হয়তো আংশিকভাবে সত্য, কিন্তু এটি কি সংকটের মূল চিত্রকে তুলে ধরে? শুধু মানুষকে দায়ী করে আর সতর্কবার্তাই প্রচার করে এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধান কীভাবে সম্ভব? আমাদের গভীরে গিয়ে ভাবতে হবে, কেন এই নিরীহ ও দরিদ্র মানুষগুলো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ওই বিপজ্জনক এলাকায় যাচ্ছেন?

এর সহজ উত্তর হলো—পেটের দায়। সীমান্ত এলাকার এই মানুষগুলো অত্যন্ত দরিদ্র। ঝাড়ুফুল সংগ্রহ করা বা পাহাড় থেকে বনজ সম্পদ আহরণ করাই তাদের অনেকের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। যেখানে একটি পরিবারের প্রতিদিনের খাবার নির্ভর করে বন থেকে আনা কয়েকটি ঝাড়ু বা লাকড়ির ওপর, সেখানে অদৃশ্য মাইনের ভয়কে জয় করে পেটের ক্ষুধা। যখন একজন মানুষের সামনে তার সন্তানের মুখের আহার জোগানোর প্রশ্ন আসে, তখন স্থলমাইনের মতো অদৃশ্য বিপদ তার কাছে গৌণ হয়ে যায়। আমরা যদি তাদের এই কাজের বিকল্প কোনো সম্মানজনক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারি, তবে শুধু ‘যেও না’ বলে তাদের আটকে রাখা সম্ভব নয়।

এই সংকটের আরেকটি বড় দিক হলো কূটনৈতিক দুর্বলতা। মিয়ানমার জাতিসংঘের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি, তাই আন্তর্জাতিকভাবে তাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করা কঠিন। আগে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে পতাকা বৈঠক বা প্রতিবাদের মাধ্যমে আলোচনার একটি ক্ষীণ সুযোগ ছিল। কিন্তু এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণের কারণে সেই আনুষ্ঠানিক পথটিও প্রায় বন্ধ।

তাহলে করণীয় কী? প্রথমত, শুধু সতর্কবার্তায় সীমাবদ্ধ না থেকে রাষ্ট্রকে তার নাগরিকদের সুরক্ষায় আরও সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। যেসব পরিবার মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। এই পুনর্বাসন শুধু একটি কৃত্রিম পা বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এর সঙ্গে প্রয়োজন শারীরিক চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কাউন্সেলিং, নতুন কোনো পেশার জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ এবং তাদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, যাতে একটি দুর্ঘটনা পুরো একটি প্রজন্মকে পিছিয়ে না দেয়।

দ্বিতীয়ত, সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদার করার পাশাপাশি সীমান্তবাসীদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস সৃষ্টিতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ক্ষুদ্রঋণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ বা স্থানীয়ভাবে কুটির শিল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে তাদের স্বাবলম্বী করে তুলতে পারলে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের আর সীমান্তে যেতে হবে না।

তৃতীয়ত, আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা আরও জোরদার করতে হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ফোরাম ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাছে এই বিষয়টি নিয়মিত তুলে ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে তারা তাদের সীমান্তে মাইন স্থাপনের মতো অমানবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করে।

এই সমস্যা কোনো একক পক্ষের নয়। এর সমাধানের জন্য সরকার, আন্তর্জাতিক সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় সব মহলের একটি সম্মিলিত ও আন্তরিক উদ্যোগ প্রয়োজন। সীমান্তের প্রতিটি নাগরিকের জীবনের মূল্য সমান। তাদের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করে, এই নীরব ঘাতকের হাত থেকে তাদের রক্ষা করাই হোক আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।