বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

ডেঙ্গুর দুঃস্বপ্ন: চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কি প্রস্তুত?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ৭ জুলাই ২০২৫ | ১০:৫৯ পূর্বাহ্ন

চট্টগ্রামে ডেঙ্গু
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে আবারও ফিরে এসেছে ডেঙ্গুর দুঃস্বপ্ন। বর্ষার আগমনী বার্তার সাথে সাথেই নগরের ঘরে ঘরে বাড়ছে জ্বর আর আতঙ্ক। কিন্তু ডেঙ্গু এখন আর শুধু বর্ষাকালের মৌসুমি অসুখ নয়, এটি পরিণত হয়েছে প্রায় সারা বছর ধরে চলা এক জনস্বাস্থ্য সংকটে। পাহাড় আর সমুদ্রবেষ্টিত এই সুন্দর নগরীর মানুষ মশার কাছে যেন জিম্মি হয়ে পড়েছে। একদিকে রোগের ভয়, অন্যদিকে চিকিৎসার বিপুল খরচ—এই দুইয়ের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে সাধারণ মানুষ। কিন্তু সংকট যতটা গভীর, আমাদের নগর কর্তৃপক্ষের প্রস্তুতি ততটাই অস্থায়ী, খণ্ডিত এবং সমন্বয়হীন বলে মনে হচ্ছে।

বছর দেড়েক আগের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল, ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রত্যেক রোগীর গড় খরচ প্রায় ১৯ হাজার টাকা। এটি ছিল সারাদেশের গড় হিসাব। চট্টগ্রামের মতো একটি ব্যয়বহুল শহরে এই খরচ আরও বেশি হওয়াই স্বাভাবিক। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করালেও আনুষঙ্গিক খরচ মিলিয়ে তা ৩০ হাজার টাকা ছাড়িয়ে যায়, আর বেসরকারি হাসপাতালের কথা তো বলাই বাহুল্য। একবার ভাবুন, এই শহরের একজন পোশাক শ্রমিক, একজন রিকশাচালক বা একজন সাধারণ দোকানদার কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ খরচ বহন করবেন? একটি মশার কামড় একটি নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্ত পরিবারকে মুহূর্তেই ঋণের বোঝায় ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। ডেঙ্গু এখন আর শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, এটি আমাদের জন্য এক বিশাল অর্থনৈতিক বোঝাও হয়ে উঠেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে হয়তো বলা হবে, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে, ডেঙ্গু ইউনিট খোলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এসব ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সাধারণ মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে বেসরকারি খাতের দিকে। সরকারি হাসপাতালে প্রায়ই রক্তের সংকট, প্লাটিলেটের ঘাটতি কিংবা আইসিইউ বেড না পাওয়ার মতো অভিযোগ শোনা যায়। এই সীমাবদ্ধতার সুযোগে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো বিপুল অংকের টাকা আদায় করে নেয়। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, এই অব্যবস্থাপনা বা সমন্বয়হীনতার দায় কেউ নিচ্ছে না।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্ষা মৌসুম এলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মশকনিধন অভিযান শুরু হয়। ফগার মেশিন নিয়ে অলিগলিতে ধোঁয়া দেওয়া হয়, চলে কিছু পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম। কিন্তু এই তৎপরতা কতটা বিজ্ঞানসম্মত, নিয়মিত ও টেকসই—তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। মশার লার্ভা ধ্বংসে প্রকৃত কার্যকর ব্যবস্থা কী নেওয়া হয়েছে, তার কোনো স্বচ্ছ তথ্য নেই। বরং প্রায়ই দেখা যায়, নগরের যে ওয়ার্ডে বা যে এলাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে, সেখানেই প্রতিরোধমূলক কার্যক্রম সবচেয়ে দুর্বল। চট্টগ্রামের অসংখ্য অলিগলিতে জমে থাকা পানি, নির্মাণাধীন ভবনের চৌবাচ্চা আর যত্রতত্র ফেলে রাখা আবর্জনা মশার বংশবিস্তারের জন্য এক উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

এমন বাস্তবতায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, অর্থাৎ চসিকের মধ্যে সমন্বয়হীনতা অত্যন্ত প্রকট। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, তাদের কাজ চিকিৎসা দেওয়া। আর সিটি করপোরেশন বলছে, তারা পরিচ্ছন্নতা ও মশা নিধনের কাজ করছে। এই দুই সংস্থার দায় এড়ানোর খেলায় জনগণের দুর্ভোগের কোনো কমতি নেই। ডেঙ্গু এখন আর সামান্য জ্বর বা সাধারণ কোনো রোগ নয়। যে রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়, রক্ত বা প্লাটিলেটের জন্য হাহাকার করতে হয়, এমনকি আইসিইউ পর্যন্ত প্রয়োজন হয়—তা একটি গুরুতর স্বাস্থ্যসংকট।

বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে হলে একটি বার্ষিক, সুপরিকল্পিত ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো সেই মৌসুমি অভিযান আর ফটোসেশনের বৃত্তেই আটকে আছি। মশা নিধনের নামে যে ওষুধ ছিটানো হয়, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে হলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে সমন্বিতভাবে একটি দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। শুধু বর্ষার কয়েক মাস নয়, সারা বছর ধরেই মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করার কার্যক্রম চালাতে হবে। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করতে হবে এবং জনগণকে সচেতন করতে নিয়মিত প্রচার অভিযান চালাতে হবে।

একই সঙ্গে, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনামূল্যে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো, প্লাটিলেট ও রক্তের সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসকদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা জরুরি। ডেঙ্গুর মতো একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগে কেন বারবার আমাদের জনজীবন এভাবে বিপর্যস্ত হবে? নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে এমন অবহেলা চলতে পারে না। স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আস্থা হারালে যে সংকট তৈরি হয়, তা আর শুধু ডেঙ্গুতে সীমাবদ্ধ থাকে না, রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়েও বড় প্রশ্ন তৈরি হয়। চট্টগ্রামের নাগরিকদের এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্তি দিতে হলে মৌসুমি তৎপরতার বদলে বছরব্যাপী সুচিন্তিত ও কার্যকর পদক্ষেপের কোনো বিকল্প নেই।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।