
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে অবসর নেওয়া নুরুল ইসলামের দিনগুলো বেশ দুশ্চিন্তায় কাটছে। সারাজীবনের চাকরির পর পাওয়া পেনশনের টাকাটুকু তিনি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করেছিলেন। সেই মুনাফা আর যৎসামান্য পেনশন দিয়েই এই ব্যয়বহুল বন্দরনগরীতে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিলেন। কিন্তু সরকারের এক নতুন সিদ্ধান্তে তার কপালে পড়েছে গভীর চিন্তার ভাঁজ। চলতি বছরের জুলাই মাস থেকে সঞ্চয়পত্রের মুনাফার হার কমিয়ে দিয়েছে সরকার, যা তার মতো হাজারো মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জীবনে এক নতুন সংকট তৈরি করেছে।
নুরুল ইসলামের মতো মানুষেরাই আমাদের সমাজের নীরব স্তম্ভ। তারা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে যান না, শেয়ারবাজারের উত্থান-পতন বোঝেন না। তাদের কাছে সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা হলো সঞ্চয়পত্র—একমাত্র নিরাপদ বিনিয়োগ, যা মাস শেষে সংসারের খরচের একটি নির্দিষ্ট যোগান দেয়। কিন্তু সরকারের এই সিদ্ধান্তে সেই আস্থার জায়গাতেই যেন আঘাত হানা হয়েছে। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি প্রশ্ন রাখেন, “একে তো জিনিসপত্রের দামের আগুনে পুড়ছি, তার ওপর এখন আয়ের এই সামান্য উৎসটুকুও যদি কমে যায়, তাহলে মাস শেষে বাড়িভাড়া, ওষুধ আর সংসারের খরচ চালাব কীভাবে? এটা তো আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ওপর এক ধরনের জুলুম।”
এই চিত্র শুধু নুরুল ইসলামের একার নয়, পুরো চট্টগ্রামজুড়েই হাজারো শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, গৃহবধূ এবং অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা একই আতঙ্কে ভুগছেন। এমনিতেই চলতি বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো হয়নি, তার ওপর মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপ। এই দ্বিমুখী সংকটের সঙ্গে এখন যুক্ত হলো সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমে যাওয়ার নতুন বোঝা। এই ‘ত্রিমুখী’ চাপ চট্টগ্রামের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোকে এক ভয়াবহ আর্থিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
সরকারের নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে মুনাফার হার কমানো হয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘পরিবার সঞ্চয়পত্রে’ সাড়ে সাত লাখ টাকার কম বিনিয়োগে যেখানে মুনাফার হার ছিল সাড়ে ১২ শতাংশ, তা এখন কমে হয়েছে ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। একইভাবে, ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্রে’র মুনাফার হারও কমানো হয়েছে। যদিও এই নতুন হার পুরনো বিনিয়োগের ওপর আপাতত কোনো প্রভাব ফেলবে না, কিন্তু মেয়াদ শেষে যখন এই মানুষগুলো তাদের অর্থ পুনঃবিনিয়োগ করতে যাবেন, তখন তাদের আয় এক লাফে অনেকটাই কমে যাবে।
কিন্তু সরকার কেন এমন একটি অজনপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিল? অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টার বক্তব্য অনুযায়ী, এটি ব্যাংক খাতের তারল্য সংকট মোকাবিলার একটি প্রচেষ্টা। তার মতে, সঞ্চয়পত্রের সুদহার বেশি আকর্ষণীয় হলে মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করবে, যার ফলে ব্যাংকগুলো তারল্য সংকটে পড়তে পারে। দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ভারসাম্য রক্ষার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে।
তবে অর্থনীতিবিদদের একটি বড় অংশ সরকারের এই ব্যাখ্যার সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফের দেওয়া ঋণের শর্ত। বাংলাদেশকে দেওয়া ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের বিপরীতে আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলেছিল, তার মধ্যে অন্যতম ছিল সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ কমানো এবং এর সুদহারকে বাজারভিত্তিক করা। অধ্যাপক এম এম আকাশের মতো অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো ‘বাজার মৌলবাদী’ এবং তারা সামাজিক সুরক্ষার চেয়ে বাজার অর্থনীতিকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। শুধুমাত্র তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়েই সাধারণ মানুষের আয়ের ওপর এই কোপ দেওয়া হয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এর সঙ্গে আরও একটি কারণ যোগ করেছেন। তিনি মনে করেন, সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে ব্যর্থ হয়ে এখন খরচ কমানোর সবচেয়ে সহজ পথটি বেছে নিয়েছে। বিপুল পরিমাণ সঞ্চয়পত্রের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করা সরকারের জন্য একটি বড় ব্যয়। যেহেতু রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হচ্ছে না, তাই সরকার সুদ পরিশোধের ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে।
কারণ যা-ই হোক না কেন, এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে দেশের সবচেয়ে সৎ এবং আইন মেনে চলা এক বিশাল জনগোষ্ঠীর ওপর। যারা কর ফাঁকি দেয় না, যারা ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ করে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার স্বপ্ন দেখে না, জীবনের শেষ সম্বলটুকু দিয়ে যারা একটুখানি নিরাপদ আয়ের নিশ্চয়তা চেয়েছিল, তারাই আজ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা কমিয়ে দেওয়া হলে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। সরকারের উচিত ছিল, ব্যাংক খাতের সংস্কার এবং রাজস্ব আদায় বাড়ানোর মতো কঠিন কিন্তু জরুরি পদক্ষেপগুলো নেওয়া। তার পরিবর্তে, সঞ্চয়পত্রের ওপর নির্ভরশীল সাধারণ মানুষের আয় কমিয়ে দেওয়া কোনোভাবেই একটি সুবিবেচনাপ্রসূত নীতি হতে পারে না। চট্টগ্রামের মতো শহরে, যেখানে জীবনযাত্রার ব্যয় আকাশচুম্বী, সেখানে এই সিদ্ধান্ত মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোকে আরও প্রান্তিক অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে। এই মানুষগুলোর শেষ আশ্রয়টুকু কেড়ে নেওয়ার আগে সরকারের উচিত বিকল্প কোনো সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা।