বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

কেরানি বানানোর কারখানা ও ছয় লাখ ফেলের গল্প

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১১ জুলাই ২০২৫ | ৮:৩৬ অপরাহ্ন


প্রতি বছর পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিন আমার বুকটা ভেঙে যায়। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হলো না। যখন দেখলাম, এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় ৩২ শতাংশ, অর্থাৎ ১৯ লাখ পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৬ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী ফেল করেছে, তখন মনে হলো, এই ব্যর্থতা শুধু ওই ছয় লাখ ছেলেমেয়ের নয়, এই ব্যর্থতা আমাদের সবার। ভাবটা এমন যেন, প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনের তো ফেল করারই কথা! আমরা এমন এক অদ্ভুত জাতি, যারা এই নিদারুণ অপচয়কে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিয়েছি। অথচ, বিশ্বের ৭১টি দেশের মোট জনসংখ্যাও এই ছয় লাখের চেয়ে কম।

ফলাফল বিপর্যয়ের পরদিন থেকেই শুরু হয়েছে এর কারণ ‘অনুসন্ধান’। গণমাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা বেশ কিছু কারণ খুঁজে বের করেছেন। বলা হচ্ছে, করোনা মহামারির কারণে শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো ক্লাস করতে পারেনি, গণিতের প্রশ্ন নাকি এবার ‘কঠিন’ হয়েছিল এবং খাতা দেখায় নাকি এবার বেশ ‘কড়াকড়ি’ করা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে কারণগুলো বেশ যৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্তু একটু গভীরে গেলেই বোঝা যায়, পুরো দায়ভারটা কী সুকৌশলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

যারা জিপিএ-৫ নামের সোনার হরিণ পেয়েছে, তারাও তো মহামারির কারণে ক্লাস কমই পেয়েছে। তাহলে সমস্যাটা শুধু অকৃতকার্যদের বেলায় কেন প্রযোজ্য হবে? আসলে, ‘ওরা পারল, তুমি পারলে না’—এই সহজ সমীকরণে আমরা আমাদের মূল রোগটা আড়াল করতে চাইছি। প্রশ্ন ‘কঠিন’ করা হয়েছে আর খাতা ‘কড়া’ করে দেখা হয়েছে—এই দুটি কারণের দায়ভার কি আমাদের শিক্ষা প্রশাসন এড়াতে পারে? এর মানে তো এটাই দাঁড়ায় যে, বিদ্যালয়ে পড়ালেখাটা ঠিকমতো হচ্ছে না, শিক্ষকেরা ক্লাসে পাঠদানে সফল হচ্ছেন না এবং প্রশাসনও সেটি তদারক করতে পারছে না। আর দিন শেষে এর খড়্গ নেমে আসছে শিক্ষার্থীদের ওপর।

আসলে, ব্রিটিশ আমলে লর্ড মেকলে যে কেরানি তৈরির শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেছিলেন, আমরা দুর্ভাগ্যবশত আজও সেই একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একশ বছরেরও বেশি সময় আগে আক্ষেপ করে বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা এমন এক শিক্ষা, যা ‘হাউইয়ের মতো কোনোক্রমে ইস্কুলমাস্টারি পর্যন্ত উড়িয়া তাহার পর পেন্সনভোগী জরাজীর্ণতার মধ্যে ছাই হইয়া মাটিতে আসিয়া পড়িবার জন্য’। তিনি চেয়েছিলেন এমন শিক্ষা, যা তরুণদের মনে এই মন্ত্র জপ করাবে যে, ‘তুমি কেরানির চেয়ে বড়, ডেপুটি-মুন্সেফের চেয়ে বড়’। কিন্তু আজও আমরা সেই কেরানি বানানোর কারখানাই চালিয়ে যাচ্ছি। একুশ শতকের এই সময়ে এসে ‘সৃজনশীল মুখস্থ’ পদ্ধতিতে আমরা প্রতি বছর লাখ লাখ ছেলেমেয়ের গায়ে ‘অকৃতকার্য’-এর মোহর লাগিয়ে দিচ্ছি।

আমাদের গণিত শিক্ষার যে বেহাল দশা, তার শেকড় আরও গভীরে। আশির দশকে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য আবশ্যিক ‘উচ্চতর গণিত’ বিষয়টিকে ঐচ্ছিক করে দেওয়া হয়েছিল। এর ফল হয়েছে ভয়াবহ। আমরা এমন সব ‘বিএসসি গ্র্যাজুয়েট’ পেয়েছি, যারা নবম শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত মাত্র ১০০ নম্বরের সাধারণ গণিত পড়েছেন। নব্বইয়ের দশকে এই ধারার গ্র্যাজুয়েটরাই যখন স্কুলগুলোতে গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেন, তখন তারা নিজেরাই শরণাপন্ন হলেন নীলক্ষেতের ‘সমাধান’ বইয়ের।

আমরা যখন গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি, তখন দেখেছি এই সমাধান বইয়ের অনেক সমাধানই ভুল। যেহেতু একজন শিক্ষক নিজেই একটি অঙ্ক কয়েকভাবে সমাধান করতে পারেন না, তিনি ক্লাসে চালু করলেন ‘শিক্ষকের নিয়মে অঙ্ক না করলে’ শূন্য দেওয়ার এক অদ্ভুত রেওয়াজ। এর ফলেই আমাদের শিক্ষার্থীদের মনে তৈরি হয়েছে ‘গণিত ভীতি’।

একইভাবে, নব্বইয়ের দশকে দাতাগোষ্ঠীর শর্ত পূরণ করতে গিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নারী শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি নির্ধারণ করা হয়েছিল। বিশ্বজুড়ে প্রমাণিত যে, শিশুদের জন্য নারী শিক্ষকেরাই সেরা। কিন্তু ন্যূনতম যোগ্যতা না থাকায় সেই শিক্ষকেরা শিশুদের গণিতের ভিত্তি, বিশেষ করে সংখ্যাপাতন (স্থানীয় মান) সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিতে পারেননি। আমরা গণিত অলিম্পিয়াডে দেখেছি, অনেক শিক্ষার্থী ‘দুই কোটি দুই’ সংখ্যাটিকেই অঙ্কে লিখতে পারে না। জ্যামিতিতে পিথাগোরাসের সূত্রের কঠিন প্রমাণ মুখস্থ করানো হলেও, এর বাস্তব প্রয়োগ তারা শেখে না। ওদের কী দোষ!

আমাদের সবচেয়ে বড় মূঢ়তা হলো, আমরা সব ছেলেমেয়েকেই সাধারণ শিক্ষা, অর্থাৎ কেরানি বানানোর শিক্ষায় আটকে রাখতে চাই। যার হয়তো একজন ভালো খেলোয়াড়, শিল্পী বা কারিগর হওয়ার সামর্থ্য আছে, তাকেও আমরা রাত জেগে মোগল সাম্রাজ্যের সীমানা মুখস্থ করতে বাধ্য করি। যে পরীক্ষায় কই মাছকে ডাঙায় দৌড়াতে হয়, সেই পরীক্ষায় সে তো ফেল করবেই।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা কি বছর বছর এই লাখ লাখ ভগ্ন হৃদয়ের কান্না দেখব, নাকি এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজব? বিশ্বজুড়ে হাইস্কুলের পাবলিক পরীক্ষার নানা পদ্ধতি রয়েছে। ব্রিটিশ কারিকুলামে একজন শিক্ষার্থী বছরে তিনবার এবং বিষয় ভাগ করে পরীক্ষা দিতে পারে। আর আমরা আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর দুই বছরের পাঠক্রম একসঙ্গে চাপিয়ে দিই।

এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ায় নজর দিতে হবে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা চালু করে এরপর শিক্ষাকে সাধারণ ও কারিগরি—এই দুই ধারায় ভাগ করে দেওয়া উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা নিজেদের আগ্রহ ও সামর্থ্য অনুযায়ী পথ বেছে নিতে পারে।

এবারের এসএসসি পরীক্ষার ব্যবস্থাপনায় একটি পেশাদারত্বের ছাপ দেখা গেছে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে পাসের হার বাড়ানোর জন্য কোনো চাপ ছিল না। বহু বছর পর আমরা একটি বাস্তবসম্মত ফলাফল পেয়েছি। এই বাস্তবতা হয়তো আনন্দদায়ক নয়, কিন্তু সত্যকে মেনে নেওয়ার সৎ সাহস আমাদের থাকতে হবে। এই ফলাফল আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার আসল চেহারাটা দেখিয়ে দিয়েছে। এখন এই রোগ সারানোর জন্য বিদেশি বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন নেই। আমাদের দেশের শিক্ষা-গবেষকদের কথা শুনলেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি দীর্ঘমেয়াদি ও বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ করলেই হয়তো ভবিষ্যতের কোনো এক সকালে ফলাফল প্রকাশের দিন আমাদের আর বুক ভাঙবে না।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।