
আমাদের শব্দভাণ্ডারে এমন একটি শব্দ আছে, যা সবচেয়ে পুরোনো হয়েও সবচেয়ে আধুনিক। শব্দটি মাত্র দুই অক্ষরের, কিন্তু এর শক্তিতে পুরো পৃথিবী নড়বড়ে হয়ে যেতে পারে। শব্দটি হলো—‘কেন?’। আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ এই প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া যেমন সহজ, তেমনি মাঝেমধ্যে মারাত্মক কঠিন। এই একটি ‘কেন’-এর পেছনে লেগে থেকেই উন্মোচিত হয়েছে জগতের হাজারো সমস্যার সমাধান, আবিষ্কৃত হয়েছে যুগান্তকারী সব ধারণা।
চলুন, একটা গল্পে ডুব দেওয়া যাক। অলস এক বিকেলে মহাবিজ্ঞানী নিউটন আপন মনে হেঁটে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ধপ্ করে তার সামনে একটি আপেল পড়ল। আমাদের মতো সাধারণ কেউ হলে হয়তো আপেলটি তুলে খেতে শুরু করতাম। কিন্তু নিউটন তা করেননি। তিনি আপেলটি হাতে নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলেন। তার মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকল একটিই প্রশ্ন—‘আপেলটা নিচে পড়ল কেন? ওপরেও তো উড়ে যেতে পারত!’ এই একটি ‘কেন’ তাকে এতটাই ভাবিয়ে তুলল যে, এর পেছনের কারণ খুঁজতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করে ফেললেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূত্র—মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।
ভাবছেন, এই সূত্র দিয়ে আর কী হবে? একটু থামুন। আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোন, ঘরের কোণে থাকা টেলিভিশন, কিংবা মহাকাশে ভেসে বেড়ানো হাজার হাজার স্যাটেলাইট—এই সবকিছুই সম্ভব হয়েছে নিউটনের ওই ‘কেন’-এর উত্তর জানার ফলে। যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) একটা ফুটবল মাঠের সমান হয়েও পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে, সেটাও কিন্তু ওই মাধ্যাকর্ষণ সূত্রের কারণেই ভেসে আছে। যেখানে আমরা একটা ঢিল ছুড়লে মাটিতে পড়ে যায়, সেখানে এত বিশাল একটা স্টেশন আকাশে ভাসে কী করে? উত্তরটা এখন আপনার জানাই!
‘কেন’ শব্দটির ক্ষমতা শুধু বিজ্ঞানের জগতেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে জটিল অপরাধ তদন্ত—সবখানেই এর জয়জয়কার। ধরুন, একজন মানুষ মারা গেল। প্রথম প্রশ্ন কী আসে? ‘কেন মারা গেল?’ আমরা ডাক্তারের কাছে যাই। ডাক্তার পরীক্ষা করে বলেন, ডেঙ্গুতে মৃত্যু। আবার প্রশ্ন আসে, ‘কেন ডেঙ্গু হলো?’ উত্তর—মশার কামড়ে। ‘কেন মশা কামড়াল?’ উত্তর—লোকটি মশারি ছাড়া ঘুমিয়েছিল। দেখুন, কীভাবে একটি ‘কেন’ আমাদের সমস্যার একেবারে গভীরে নিয়ে গেল!
এবার আসা যাক আরও রহস্যময় প্রসঙ্গে। প্রায়ই আমরা খবরের কাগজে অনাকাঙ্ক্ষিত বা রহস্যজনক মৃত্যুর খবর পড়ি। হতভাগা মানুষটি ‘কেন’ মারা গেল, তার কোনো কূলকিনারা যখন পাওয়া যায় না, তখনই মাঠে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লোকে বলে, তদন্তকারীরা নাকি মরা মানুষের পেট থেকেও কথা বের করতে পারে! কথাটা কিন্তু খুব একটা মিথ্যে নয়। আঙুলের ছাপ, ডিএনএ টেস্ট আর ফরেনসিক পরীক্ষার মতো আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে বেরিয়ে আসে আসল সত্য। খুনিকে ধরার পর তদন্তকারীর প্রধান প্রশ্নটিই থাকে—‘কেন খুনটা করেছেন?’ প্রথমে সাজানো গল্পের আড়ালে খুনি নিজেকে লুকাতে চাইলেও ‘কেন’-এর ম্যারাথন জিজ্ঞাসাবাদের মুখে একসময় ঘড়ঘড় করে সত্যিটা বেরিয়ে আসে। প্রশাসনকে ধোঁকা দেওয়া যে সহজ কাজ নয়!
তবে সব ‘কেন’-এর উত্তর কি আমরা পেয়েছি? মোটেই না। কেন মিশরীয়রা বিশাল বিশাল পিরামিড বানিয়েছিল? কেন তিনটি পিরামিড আকাশের তিনটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের দিকে মুখ করে আছে? কীভাবে তারা এত বড় পাথরগুলোকে অত উঁচুতে তুলেছিল? বিজ্ঞানীরা আজও এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। কেন সমুদ্রের পানি লবণাক্ত? কেন সূর্য প্রতিদিন পূর্ব দিকে ওঠে আর পশ্চিমে অস্ত যায়? কেন দিনরাত ছোট-বড় হয়?
এসব প্রশ্নের কিছু উত্তর আমাদের জানা—আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি বা চাঁদের আকর্ষণ। কিন্তু আপনার বন্ধুটি কেন সবার চেয়ে সফল আর সম্মানিত? উত্তরটা কিন্তু আপনার ঠিকই জানা—তার সততা, কঠোর পরিশ্রম, সময়ের সদ্ব্যবহার, নতুন চিন্তা এবং বড়দের প্রতি সম্মান ও ছোটদের প্রতি স্নেহ।
আসলে, ‘কেন’ শুধু একটি প্রশ্ন নয়, এটি একটি চালিকাশক্তি। এটি আমাদের ভাবতে শেখায়, আবিষ্কার করতে উৎসাহ দেয় এবং নিজেকে জানতে সাহায্য করে। তাই পরের বার যখন আপনার সামনে কোনো সমস্যা বা বিস্ময় আসবে, তখন ভয় না পেয়ে বা এড়িয়ে না গিয়ে প্রশ্ন করুন—‘কেন?’। নিজের ভেতরের নিউটনকে জাগিয়ে তুলুন এবং এই দুই অক্ষরের শব্দের পেছনে ছুটতে থাকুন। কে জানে, হয়তো একদিন আপনিও হয়ে উঠবেন মানুষের মাঝে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র!
তবে হ্যাঁ, এই শক্তিশালী শব্দের প্রয়োগ যেন কখনোই কোনো খারাপ বা অনৈতিক কাজে না হয়, সেদিকে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।