বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

যে ক্ষত কখনো শুকাবে না

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
শরীফুল রুকন | প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৫ | ৮:৪৯ পূর্বাহ্ন


সময় নাকি সব ক্ষত সারিয়ে দেয়। মানুষ ভুলতে শেখে। কিন্তু কিছু শূন্যতা থাকে, যা সময়ও পূরণ করতে পারে না; কিছু ক্ষত থাকে, যা কখনো শুকায় না। আজ ২ আগস্ট। দুটি বছর হয়ে গেল। আমার বুকের ভেতর সেই না শুকানো ক্ষতটা ঠিক আগের মতোই দগদগে, টাটকা। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা বদলালেও আমার জন্য সময়টা যেন স্থির হয়ে আছে ২০২৩ সালের সেই ভোরে। ঠিক ৪টা ১১ মিনিটে আমার পৃথিবীটা একবার থমকে গিয়েছিল, আর চলেনি। আমার পরম শ্রদ্ধেয় আজাদ ভাইয়া, আমার প্রিয় সম্পাদক, আমার বুকের ভেতর থেকে সবচেয়ে মূল্যবান টুকরোটা ছিঁড়ে নিয়ে চলে গেলেন।

তাঁর ‘শোক সংবাদ’ একুশে পত্রিকায় লেখার দায়িত্ব ছিল আমার। সে এক অকল্পনীয় যন্ত্রণা! কি-বোর্ডের প্রতিটি অক্ষরে হাত কাঁপছিল, ঝাপসা চোখে স্ক্রিনের দিকে তাকাতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, এ আমি কী লিখছি! কেন লিখছি! নিজের হাতেই যেন প্রিয় সম্পাদকের কবরের মাটি খুঁড়ছিলাম।

ভাইয়ার সঙ্গে কাটানো দশ বছরের প্রতিটি মুহূর্ত আজ স্মৃতির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে। ২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কোকেন আটকের সেই উত্তাল দিনে যে সম্পর্কের সূচনা, তা ছিল আস্থা ও নির্ভরতার। সেই ঘটনার পর থেকেই তিনি আমাকে আগলে রেখেছিলেন এক অদৃশ্য বর্ম হয়ে।

আমার ওপর বিপদের সামান্য আঁচও লাগতে দিতেন না তিনি। একবার এক প্রভাবশালী নেতা আমার সাথে অন্যায় আচরণ করলে, তিনি আমার হয়ে সেই নেতার সঙ্গে লড়েছিলেন, ‘প্রতিশোধ’ নিয়েছিলেন। যখনই প্রশ্ন উঠত—আমি নাকি অন্য কেউ? তিনি এক মুহূর্ত দ্বিধা না করে আমাকে বেছে নিতেন, সামনে যেই থাকুক। আমার সামান্য সাফল্যে তাঁর উল্লাস ছিল আকাশছোঁয়া, যেন সাফল্যটা আমার নয়, তাঁর নিজের।

ফেসবুকের দেয়ালে তিনি আমাকে নিয়ে লিখতেন, ঠিক যেন এক গর্বিত অভিভাবক তাঁর সন্তানের কৃতিত্ব জগৎকে দেখাচ্ছেন। এমআরডিআই ফেলোশিপের জন্য মনোনীত হওয়ার পর তিনি লিখেছিলেন, “সাফল্যের পাখায় নতুন পালক… শুধু জাতীয়ভাবে নয়, একদিন আন্তর্জাতিকভাবেও সাংবাদিকতায় জায়গা করে নেবে রুকন– এ আমার বিশ্বাস।” ইউনিসেফ মিনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অল্পের জন্য হাতছাড়া হওয়ায় যখন আমার মন খারাপ, তিনি সাহস জুগিয়েছিলেন, “…এত এত প্রতিযোগীর মাঝে টপ থ্রিতে আসা চারটিখানি কথা নয়! …আমার বিশ্বাস আরও বড় কিছু অপেক্ষা করছে রুকনের জন্যে।”

ঠিক তার পরদিনই টিআইবি ফেলোশিপ পাওয়ার খবর শুনে বাংলাদেশ সময় গভীর রাতে ভারত থেকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ফেসবুকে লিখেছেন, “ইউনিসেফ মিনা মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড অল্পের জন্য হাতছাড়া হওয়ার পর মাত্র একদিন আগেই বলেছিলাম আরও ভালো কিছু অপেক্ষা করছে রুকনের জন্য। তাই সত্য হলো। …আমি জানি, আরও অনেকদূর যাবে, যাক রুকন…” তাঁর সেই বিশ্বাস, সেই ভালোবাসা ছিল আমার পথচলার সবচেয়ে বড় শক্তি।

তিনি শুধু আমার ঢালই ছিলেন না, আমি সামান্য সুযোগ পেলেই তাঁর শক্তি হতে চাইতাম। জীবনের শেষ দিকে এসে ভারতের মুম্বাইয়ে যখন তিনি চিকিৎসার জন্য লড়ছিলেন, নিয়মের বেড়াজালে আটকে প্রতি মুহূর্তে কষ্ট পাচ্ছিলেন, তখন সেই অসহায়ত্ব আমি এখান থেকে অনুভব করতাম। তাঁর ভিসার জটিলতা নিয়ে যখন সব পথ বন্ধ, তখন তিনি তাঁর ফেসবুক পোস্টে আমার ওপর আস্থা রেখে লিখেছিলেন, “আমার সহকর্মী একুশে পত্রিকার চিফ রিপোর্টার শরীফুল রুকনের কোনো কাজেই ব্যর্থতা নেই। কাজ যতই কঠিন হোক, সে হাত দিলে পানির মতো সহজ হয়ে যায়। এটি অন্তত আমার অভিজ্ঞতা। এবার সেই রুকনই এগিয়ে এলো।”

তাঁর মতো বিশাল হৃদয়ের একজন মানুষ, যিনি সবসময় আমার রক্ষাকবচ ছিলেন, তাঁর এই কঠিন সময়ে আমি তাঁর আস্থার প্রতিদান দিতে পারিনি, তাঁকে নিয়মের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতে পারিনি—এই যন্ত্রণা আমাকে আজও কুরে কুরে খায়।

২০২৩ সালের ৩১ জুলাই। ঢাকার বিআরবি হাসপাতালের আইসিইউতে আমাদের প্রাণের আজাদ ভাইয়াকে দেখতে গেলাম। সেই দৃশ্য দেখার জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না। আমাদের চিরচেনা গতিশীল মানুষটা বিছানার সঙ্গে মিশে গেছেন। চোখ বন্ধ, ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত। আমি তাঁর মাথায় হাত রাখতেই তিনি চোখ খুললেন, সালাম নিলেন। ফিসফিসে গলায় বললেন একুশে পত্রিকার কথা, আমাদের কথা।

হঠাৎ আমাকে কাছে ডাকলেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ভাঙা গলায় বললেন, “আমাকে অনেক ভালোবাসেন, আমার জন্য দোয়া করছেন।” তাঁর এই কথাগুলো শুনে আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করে বেরিয়ে এলাম সেই ঘর থেকে, বুকের ভেতর এক অসীম শূন্যতা নিয়ে। কে জানত, এটাই হবে তাঁর সাথে আমার শেষ কথা, শেষ স্পর্শ!

দশ বছর! আজাদ তালুকদার নামের এই বটবৃক্ষের ছায়ায় কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন। নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয়। কিন্তু আজ, এই দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে এসেও সেই ৪টা ১১ মিনিটের ভোরে আমার পৃথিবীটা থমকে আছে। বুকের ক্ষতটা এখনো সমানভাবেই রক্ত ঝরায়।

যেখানেই থাকুন, ভালো থাকবেন, আমার সম্পাদক, আমার আজাদ ভাইয়া। আল্লাহ আপনাকে জান্নাতের সর্বোচ্চ স্থান দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রধান প্রতিবেদক, একুশে পত্রিকা।