বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

আজাদকে ছাড়া ৭৩০ দিন

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৫ | ৯:০৫ পূর্বাহ্ন


আজ ২ আগস্ট। সময় স্থির থাকে না, তবু কিছু দিনপঞ্জির পাতা যেন জীবনের গতিকে থামিয়ে দেয়। দুটি বছর… ৭৩০টি দিন… কত সহস্র মুহূর্ত তোকে ছাড়া নিঃশব্দে পেরিয়ে গেল, আজাদ। কিন্তু আমার কাছে সময়টা আজও স্থির হয়ে আছে সেই একটি বিন্দুতে, যেখানে দাঁড়িয়ে আমি শেষবার তোর চোখের দিকে তাকিয়েছিলাম।

আজ এই মৃত্যুবার্ষিকীতে আকাশেও মেঘের আনাগোনা। তোর জন্মদিনের মতোই। কামাল পারভেজ ভাই ঠিকই লিখেছিলেন, তুই জন্মেছিলি এক বর্ষার দিনে। তোর চরিত্রটাও তো ছিল ঠিক বর্ষার মতোই—কখনো ঝুম বৃষ্টিতে সব ভাসিয়ে দেওয়া উদ্যম, কখনো অভিমানী মেঘের মতো গম্ভীর হয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা, আবার কখনো বা বৃষ্টির শেষে স্নিগ্ধ মাটির সোঁদা গন্ধের মতো তোর অকৃত্রিম মমতা।

আজ তুই নেই, আর তোর অগণিত স্মৃতি সেই বর্ষার বারিধারার মতোই অবিরাম ঝরে চলেছে আমার হৃদয়ের উঠোনজুড়ে, তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে, উর্বর করছে, আবার কখনো প্লাবিত করছে অসহনীয় যন্ত্রণায়।

আমাদের বন্ধুত্বের গল্পটা শুরু হয়েছিল সেই ১৯৯০ সালে, স্কুলজীবনের সেই সোনালি দিনগুলোতে। কাঠের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে কত ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুনেছি, তার কি কোনো ইয়ত্তা আছে? টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে একসঙ্গে বাদাম ভাগাভাগি করে খাওয়া, ছুটির পর অনেকটা পথ একসঙ্গে হেঁটে বাড়ি ফেরা, আর সেই হাঁটার পথে দেশ-দুনিয়া নিয়ে আমাদের কতশত বিশ্লেষণ!

আমাদের মধ্যে ছিল এক আশ্চর্য্য মনের মিল; তোর না বলা কথাগুলোও যেন আমি অনায়াসে পড়ে ফেলতে পারতাম। আমাদের সেই বন্ধুত্ব শুধু খুনসুটি বা উচ্ছ্বাসের ছিল না, ছিল একে অপরের ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর এক অলিখিত প্রতিজ্ঞা। সেই প্রতিজ্ঞা আমরা আগলে রেখেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। আজ তুই নেই, কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞার অদৃশ্য বর্মটা আমি আজও অনুভব করি।

তোর প্রজ্ঞা, সাহস আর দূরদর্শী নেতৃত্বে ‘একুশে পত্রিকা’ আজ কেবল একটি সংবাদমাধ্যম নয়, দেশজুড়ে আপসহীন ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এক বিশ্বস্ত বাতিঘর। তোর এই অকাল প্রয়াণ যে কী বিশাল এক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে, তার গভীরতা কেবল আমিই বুকের পাঁজর দিয়ে অনুভব করতে পারি। তুই বেঁচে থাকলে আমরা, এই সমাজ, এই দেশ আরও কত কী যে পেত, তা ভেবে মনটা হাহাকার করে ওঠে।

তোর জীবন ছিল এক বহুবর্ণিল ক্যানভাস। সাতাশ বছরের দীর্ঘ সাংবাদিকতার পথচলায় তুই ছিলি এক নির্ভীক কলমযোদ্ধা। তোর কণ্ঠ ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে বজ্রের মতো কঠিন, আবার সত্যের পক্ষে ঝর্ণার মতো স্বচ্ছ। তুই ছিলি এক স্বচ্ছ আয়না, যার অন্তরে ছিল কেবল সততা আর নিষ্ঠার আলো। কিন্তু তোর বিশালতা তো শুধু সাংবাদিকতার গণ্ডিতে বাঁধা ছিল না। তুই নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিস মানুষের সেবায়। কখনো প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে বসে শহরবাসীর জন্য লড়েছিস, কখনো বা ছুটে গিয়েছিস প্রত্যন্ত গ্রামে, চিকিৎসা সেবা ক্যাম্পের আয়োজন করেছিস অসহায় মানুষের জন্য। আমি যেন আজও দেখতে পাই, কোনো এক বৃদ্ধার হাত ধরে তুই পরম মমতায় তাঁর কষ্টের কথা শুনছিস। দলমত, ধর্ম, বয়স—কোনো কিছুই তোর কাছে বাধা ছিল না। সবাইকে আপন করে নেওয়ার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তোর, যা আজও আমাদের মুগ্ধ করে।

কী করে ভুলি বিআরবি হাসপাতালের সেই বেদনাবিধুর দিনের কথা? হাসপাতালের সেই দীর্ঘ, নীরব করিডোর ধরে তোর কেবিনের দিকে এগোনোর প্রতিটি পদক্ষেপ আমার কাছে পাহাড়সম ভারী মনে হচ্ছিল। বুকের ভেতরটা অজানা আশঙ্কায় বারবার কেঁপে উঠছিল। অবশেষে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আমার পৃথিবীটা যেন দুলে উঠল। স্তব্ধ পাহাড়ের মতো দৃঢ় সেই মানুষটা, আমার বন্ধু, আমার আজাদ, বিছানার সঙ্গে মিশে আছে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যন্ত্রণাকাতর, ক্লান্ত চোখ দুটোয় ছিল কত না বলা কথা, কত অভিমান, কত ভালোবাসা!

তারপর… তারপর সব বাঁধ ভেঙে গেল। শিশুর মতো হাউমাউ করে কেঁদে উঠে তুই বলেছিলি, ‘নজরুল, তুই এসেছিস?’

তোর সেই ভাঙা কণ্ঠের আর্তনাদ আমার হৃৎপিণ্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছিল। আমার চারপাশটা যেন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল পৃথিবী। বাবার মৃত্যুতেও সম্ভবত এতটা অসহায়, এতটা ভেঙে পড়িনি আমি। তোর সেই কান্না ছিল তোর একার নয়, সেই কান্না ছিল আমাদের দুজনের, আমাদের ছত্রিশ বছরের বন্ধুত্বের। তোর সেই কান্না ছিল জমে থাকা কষ্ট, অভিমান আর আমার প্রতি তোর গভীর আস্থার বহিঃপ্রকাশ।

সেই কান্নার রেশ থামতে না থামতেই, দুর্বল, কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে তুই আমার কাঁধে তোর জীবনের সবচেয়ে পবিত্র দুটি আমানতের ভার তুলে দিয়েছিলি—তোর নয়নের মণি, একমাত্র পুত্র অর্ঘ্য আর তোর রক্ত-ঘামে গড়া স্বপ্নের ‘একুশে পত্রিকা’। বলেছিলি, ‘বন্ধু, আমার অর্ঘ্যকে তুই দেখিস। ওকে মানুষের মতো মানুষ করিস।’ আর ‘একুশে পত্রিকা’কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য তোর সেই আকুতি!

সে তো শুধু একটি অনুরোধ ছিল না, ছিল এক কলমযোদ্ধার তার আজন্ম লালিত আদর্শকে টিকিয়ে রাখার আকুল আর্তি। বন্ধু, আমি তোকে কথা দিয়েছিলাম। হাজারো মানুষের ভিড়ে, তোর নিথর দেহের পাশে দাঁড়িয়ে আমি মনে মনে আবারও প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আজও সেই কথায়, সেই প্রতিজ্ঞায় আমি অটল। যতদিন এই দেহে প্রাণ আছে, শত কষ্ট হলেও তোর এই দুটি আমানত আমি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখার চেষ্টা করব।

আজও কি তুই দেখছিস, বন্ধু? তোর অর্ঘ্য বড় হচ্ছে, ওর চোখে আমি তোর স্বপ্নের ছায়া দেখতে পাই। তোর ‘একুশে পত্রিকা’ আজও তোর দেখানো পথেই হাঁটছে, সত্য প্রকাশে একচুলও আপস করছে না।

বন্ধু, তুই আমাদের ছেড়ে কোথাও যাসনি। তুই সশরীরে অনুপস্থিত, কিন্তু তোর অস্তিত্ব আমাদের সত্তার সঙ্গে মিশে আছে। তুই বেঁচে আছিস তোর কর্মে, তোর আদর্শে, একুশে পত্রিকার প্রতিটি অক্ষরে। তোর সততা আর সাহসিকতা থেকে প্রেরণা নিয়ে জন্ম নেবে আরও হাজারো কলমযোদ্ধা।

আমি বিশ্বাস করি, এই ঘুণে ধরা সমাজে একদিন তারা সত্যের মশাল জ্বালবে, দ্যুতি ছড়াবে। আর তাদের অগ্রভাগে হয়তো একদিন তোর স্বপ্নপূরণ করে নেতৃত্ব দেবে আমাদেরই প্রিয় অর্ঘ্য। সেদিন তুই নিশ্চয়ই দেখবি, তোর অর্ঘ্য তোর মতোই নির্ভীক, তোর মতোই আদর্শবান হয়েছে।

ভালো থাকিস বন্ধু… অনন্তলোকে। তুই আমাদের প্রেরণার ধ্রুবতারা হয়ে বেঁচে থাকবি অনন্তকাল। তোর দেখানো পথেই আমরা হেঁটে চলব, আলো জ্বেলে যাবো এই আঁধার তাড়াতে।

লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।