বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

আপনার দেখানো পথেই হেঁটে চলেছি

একুশে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক আজাদ তালুকদারের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ২০২৩ সালের ২ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁর স্মরণে এই লেখা।
জিন্নাত আয়ুব | প্রকাশিতঃ ২ অগাস্ট ২০২৫ | ১১:৩২ পূর্বাহ্ন


সময় বয়ে যায়, কিন্তু কিছু স্মৃতি, কিছু শূন্যতা কখনো পুরনো হয় না। দেখতে দেখতে দুটি বছর কেটে গেল, আমাদের প্রিয় সম্পাদক, আমাদের অভিভাবক আজাদ তালুকদার স্যার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, তিনি নেই। মনে হয়, এই তো, একুশে পত্রিকা অফিসের দরজা ঠেলে হাসিমুখে ভেতরে ঢুকবেন, সহকর্মীদের নিয়ে আড্ডায় মেতে উঠবেন আর আমার দিকে তাকিয়ে বলবেন, “কিরে জিন্নাত, আজকেও ছোলা মুড়ি হবে না?”

২০১৯ সাল থেকে আমি একুশে পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু আজাদ স্যার আমাকে শুধু একজন সহকর্মী হিসেবে নয়, তাঁর পরিবারের একজন সদস্য হিসেবেই গ্রহণ করেছিলেন। তিনি চাইতেন, আমি যেন প্রতিদিন বিকেলে হাউজে থাকি। তাঁর ভালোবাসার এক অদ্ভুত প্রকাশ ছিল। আমি দুই-একদিন হাউজে না গেলেই ফোন করে দুষ্টুমি করে বলতেন, “জিন্নাত, অফিসে না আসলে চাকরি থাকবে না!” স্যারের এই স্নেহের শাসনে আমি প্রতিদিন ছুটে যেতাম তাঁর কাছে।

স্যারের বিকেলের আড্ডাগুলো ছিল আমাদের প্রাণ। তিনি সহকর্মীদের নিয়ে গান, গল্প আর খাওয়াদাওয়ায় মেতে থাকতে ভালোবাসতেন। বিশেষ করে ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু মাখানোটা তাঁর ভীষণ পছন্দের ছিল এবং অদ্ভুতভাবে, সেই মাখানোটা তিনি আমার হাতেই খেতে চাইতেন। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলো আজ স্মৃতি হয়ে বুকে বড় পাথর সমান ভার হয়ে আছে। যখনই এসব কথা মনে পড়ে, নিজের অজান্তেই চোখের পাতা ভিজে ওঠে।

সাংবাদিকতা করতে এসে সত্য কথা বলার সাহস সবাই করতে পারে না। কিন্তু আজাদ তালুকদার ছিলেন সেই বিরল মানুষটি, যিনি সাংবাদিকতাকে কেবল পেশা নয়, একটি ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। তিনি শিখিয়েছেন, সাংবাদিকের কলম আপোষহীন হবে। ২০২২ সালের ২০ মের কথা আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে। আনোয়ারায় বিদ্যুতের ফাঁদ পেতে এক সিএনজিচালককে হত্যার ঘটনা ঘটে। আমি স্যারকে ফোন দিয়ে জানালে তিনি এক মুহূর্ত দ্বিধা করেননি। ফোনের ওপার থেকে তাঁর নির্দেশ ছিল, “অনিয়মকারী, অপরাধী যেই হোক না কেন, ঘটনাস্থলে গিয়ে বিস্তারিত জেনে নিউজ করো।”

সেদিন একুশে পত্রিকায় নিউজটি লিড হওয়ার পর প্রভাবশালী মহল থেকে আমাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। আমি ভয় পেয়ে স্যারকে জানালে তিনি অভয় দিয়ে বলেছিলেন, “আমরা সাংবাদিকতার পাশাপাশি মানবিক মূল্যবোধ থেকে নিউজটি করেছি। আমরা সমাজের নিপীড়িত মানুষের কথা লিখতে এসেছি, লিখে যাবো।” এর কিছুদিন পর আমার ও সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন অকুতোভয়। তাঁর ছায়ায় থেকে আমরা শিখেছি, কীভাবে রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সত্যের পক্ষে দাঁড়াতে হয়।

২০২২ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি আমার হাতে বছরের সেরা প্রতিনিধির পুরস্কার তুলে দিয়েছিলেন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, “আমরা সাংবাদিকতার সেরা কাজটুকু করতে চাই সর্বোচ্চ, সর্বস্ব দিয়ে। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমরা শুধু সাংবাদিকতা করতে চাই, আর কিছু করতে চাই না। আমরা জানি, সত্য প্রকাশ করতে গেলে বাধা আসবেই। কিন্তু সত্যের আছে নিজের শক্তি।” তাঁর এই কথাগুলোই আজ আমাদের চলার পথের পাথেয়।

স্যারের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছিল গত বছরের ২৩ জুলাই, ঢাকার বিআরবি হাসপাতালে। আমি তাঁর রুমে প্রবেশ করতেই রুগ্ন শরীর নিয়েও তিনি বলে উঠেছিলেন, “জিন্নাত আসছো?” সেই দুর্বল ডাক শুনে আমি আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। তাঁর হাতটি ধরে কপালে চুমু দিয়েছিলাম। কী দুঃসাহস! কিন্তু সেদিন নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আমার ছিল না।

সেই অসুস্থ অবস্থাতেও তাঁর চিন্তা ছিল আমাদের নিয়ে। তিনি বলছিলেন, “তোমরা সকালের নাস্তা করেছো? আমি তোমাদের সকালের নাস্তাটা করাই।” একজন মানুষ কতটা ব্যতিক্রম আর অনন্য হলে মৃত্যুর আগেও সহকর্মীদের জন্য এতটা ভাবতে পারেন!

আমরা সেদিনও আশায় বুক বেঁধেছিলাম, স্যার সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন। কিন্তু তিনি যে এত মানুষকে কাঁদিয়ে চিরতরে চলে যাবেন, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি।

আজ দুটি বছর পরেও তাঁর শূন্যতা আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপে অনুভূত হয়। তিনি শুধু একজন সম্পাদক ছিলেন না, ছিলেন চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার এক বাতিঘর, আমাদের আশ্রয় আর সাহসের নাম।

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমার প্রিয় সম্পাদক মহোদয়কে জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন এবং তাঁর জীবনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন। আমিন।

লেখক : একুশে পত্রিকার আনোয়ারা ও কর্ণফুলী উপজেলা প্রতিনিধি।