
গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার শত শত মানুষের ভিড়, গাড়ির অবিরাম হর্ন আর যান্ত্রিক কোলাহলের মাঝে গত বৃহস্পতিবার রাতটি এক ভিন্ন কারণে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেই রাতে সেখানে রচিত হয়েছে এক নির্মম নীরবতার উপাখ্যান, যার কেন্দ্রে ছিলেন আমাদের সহকর্মী, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন। তাঁকে সেই অনন্ত নীরবতার চাদরে মুড়ে দিয়েছে একদল পেশাদার সন্ত্রাসী। তাঁর অপরাধ? তিনি তাঁর পেশা থেকে বিচ্যুত হননি। তাঁর অপরাধ? তিনি একদল দুর্বৃত্তের অপরাধকর্মের দৃশ্য মুঠোফোনে ধারণ করার মতো নাগরিক ও পেশাগত দায়িত্ববোধ দেখিয়েছিলেন। সত্যকে ক্যামেরাবন্দী করার এই ‘স্পর্ধা’র কারণেই তাঁর শরীর ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে, তাঁর প্রাণপ্রদীপ নিভে গেছে ব্যস্ত রাস্তার পাশের এক চায়ের দোকানে।
তুহিনের এই হত্যাকাণ্ডকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এটি আমাদের সমাজে গভীরে প্রোথিত বিচারহীনতার সংস্কৃতির এক বীভৎস ও রক্তাক্ত দলিল। সিসিটিভি ফুটেজে আমরা যা দেখেছি, তা সভ্য সমাজের যেকোনো মানুষের বিবেককে নাড়িয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। প্রকাশ্যে, জনাকীর্ণ একটি এলাকায় একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র হাতে একজনকে ধাওয়া করছে, আর সেই দৃশ্য ধারণ করার কারণেই আরেকজন মানুষকে ধাওয়া করে, প্রকাশ্য স্থানে কুপিয়ে হত্যা করছে। এই ঘটনাটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, অপরাধীদের মনে রাষ্ট্র বা আইনের প্রতি ন্যূনতম কোনো ভয় অবশিষ্ট নেই। তারা জানে, একজন সাংবাদিককে হত্যা করলেও হয়তো কিছুই হবে না, অতীতে যেমন অনেক ঘটনারই কিছু হয়নি। এই ভয়হীনতাই তাদের দানবীয় করে তুলেছে। তাই তুহিনের রক্তভেজা ক্যামেরাটি শুধু একটি হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ হিসেবে নয়, বরং রাষ্ট্রযন্ত্রের সামনে আমাদের গণমাধ্যম কর্মীদের চরম নিরাপত্তাহীনতার এক জীবন্ত স্মারক হয়ে থাকবে।
যখন একজন সাংবাদিককে তাঁর কাজের জন্য প্রাণ দিতে হয়, তখন কেবল একটি মানুষের মৃত্যু হয় না; তখন সত্যের কণ্ঠকে জোর করে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। যখন কলম ধরতে গিয়ে বা ক্যামেরা তাক করতে গিয়ে একজন সাংবাদিকের হাত ভয়ের কারণে কেঁপে ওঠে, তখন বুঝতে হবে সমাজের বিবেক পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এই ভয়—এই নিরাপত্তাহীনতার সংস্কৃতি—আমাদের সমাজকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
এর প্রথম ও সবচেয়ে বিধ্বংসী প্রভাব হলো স্বআরোপিত সেন্সরশিপ। সাংবাদিকরা যখন দেখেন যে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, অপরাধী চক্র বা রাজনৈতিক দুর্বৃত্তদের নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করলে জীবনের ঝুঁকি তৈরি হয় এবং রাষ্ট্র সেই ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দেয় না, তখন তাঁরা স্বাভাবিকভাবেই নিজেদের গুটিয়ে নেন। দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহারের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সংবাদমাধ্যম থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মতো গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য একটি চর্চা তখন বিলাসিতায় পরিণত হয়। কারণ, দীর্ঘমেয়াদী ও গভীর অনুসন্ধান মানেই ঝুঁকি নেওয়া। সেই ঝুঁকির বিপরীতে যদি জীবনের নিরাপত্তা না থাকে, তবে সাংবাদিকরা বাধ্য হন কেবল নিরাপদ, নিরীহ এবং প্রেস রিলিজ-সর্বস্ব সাংবাদিকতায় নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখতে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে, মফস্বল শহরগুলোতে কর্মরত সাংবাদিকরা—যেমনটি ছিলেন তুহিন—সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন। তাঁদের ওপর আক্রমণের ঘটনাগুলো জাতীয় পর্যায়ে ততটা আলোড়ন তোলে না, ফলে অপরাধীরা আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
এই নিরাপত্তাহীনতার চিত্রটি কেবল আমাদের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানেও এর প্রতিফলন স্পষ্ট। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস কর্তৃক প্রকাশিত সর্বশেষ ‘বিশ্ব গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচক, ২০২৫’-এ বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৪৯তম অবস্থানে রয়েছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা উন্নতি হলেও এই অবস্থান কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয় এবং এটি দেশে গণমাধ্যমের ‘খুবই গুরুতর’ পরিস্থিতিকেই নির্দেশ করে। ইউনেস্কোর পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ। সংস্থাটির তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে প্রতি চার দিনে একজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয় এবং দশটি ঘটনার মধ্যে প্রায় নয়টিতেই অপরাধীরা কোনো ধরনের শাস্তি পায় না। এই বৈশ্বিক বিচারহীনতাই গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তার দুর্বৃত্তদের সাহস জোগায়। যখন তারা দেখে যে সাগর-রুনির মতো আলোচিত মামলার এক যুগেও কোনো কিনারা হয় না, তখন তুহিনের মতো তৃণমূলের একজন সাংবাদিককে হত্যা করা তাদের কাছে মামুলি বিষয়ে পরিণত হয়।
প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর আমরা একটি পরিচিত চিত্র দেখতে পাই। সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানানো হয়, ‘দ্রুততম সময়ে’ অপরাধীদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেওয়া হয়, কয়েকটি অভিযানও পরিচালিত হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই উত্তাপ কমে আসে। মামলাটি বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় হারিয়ে যায় এবং একসময় জনপরিসর থেকে পুরোপুরি মুছে যায়। এই চক্রটিই নতুন অপরাধীদের উৎসাহিত করে। এটি এক ধরনের নীরব বার্তা দেয় যে, কিছুদিন হইচই হলেও চূড়ান্তভাবে কিছুই হবে না।
আমরা, গণমাধ্যমকর্মীরা, আর শোক বা প্রতিবাদের এই চক্রে ঘুরপাক খেতে চাই না। তুহিনের এই আত্মত্যাগ তখনই অর্থবহ হবে, যখন রাষ্ট্র তাঁর হত্যাকারীদের শুধু গ্রেপ্তারই নয়, বরং দ্রুততম সময়ে একটি স্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করবে। এই হত্যাকাণ্ডকে কোনোভাবেই সাধারণ ছিনতাইকারীর হাতে মৃত্যু বলে লঘু করার সুযোগ নেই। এটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভের ওপর সরাসরি আক্রমণ এবং এর বিচার সেভাবেই হতে হবে।
আমরা বহু বছর ধরে একটি সমন্বিত ও কার্যকর ‘সাংবাদিক সুরক্ষা আইন’ দাবি করে আসছি। এমন একটি আইন, যা সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেবে, হামলা-মামলার ক্ষেত্রে বিশেষ বিধান রাখবে এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি খসড়া অধ্যাদেশের কথা শোনা যাচ্ছে, যা আশার সঞ্চার করে। কিন্তু সেই আইন প্রণয়ন ও তার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন, তার প্রতিফলন আমরা দেখতে চাই।
আসাদুজ্জামান তুহিন তাঁর নাগরিক ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন। এখন রাষ্ট্র কি তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করবে? রাষ্ট্র কি তার বিবেক, অর্থাৎ গণমাধ্যমকে রক্ষা করার জন্য শক্ত পায়ে দাঁড়াবে? নাকি তুহিনের রক্তভেজা শার্টটিও বিচারহীনতার দীর্ঘ মিছিলে আরেকটি সংখ্যা হয়ে হারিয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই লুকিয়ে আছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম, সমাজ ও গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।