বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

এআই: মানব সভ্যতার নতুন সূর্য নাকি ধ্বংসের অশনি সংকেত?

সাইফুল আযম | প্রকাশিতঃ ২০ অগাস্ট ২০২৫ | ১০:২৭ অপরাহ্ন


সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত মানবজাতির পথচলার প্রতিটি বাঁকে বিজ্ঞান ছিল এক বিশ্বস্ত সহচর। বিজ্ঞান ছাড়া আধুনিক জীবন কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু এই অমোঘ সত্যের বিপরীতে একটি প্রশ্নও ঘুরপাক খায়—বিজ্ঞান ছাড়াও কি মানুষ বাঁচতে পারে? এর উত্তর হ্যাঁ এবং না দুয়ের মধ্যেই নিহিত। আজও পৃথিবীর ফুসফুসখ্যাত আমাজনের গহীন অরণ্যে এমন কিছু আদিবাসী গোষ্ঠীর সন্ধান মেলে, যারা আধুনিক সভ্যতার আলো থেকে শত শত মাইল দূরে। নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা আর ঐতিহ্যকে আঁকড়ে ধরে তারা দিব্যি টিকে আছে। তাদের জীবনযাত্রা আমাদের চোখে সরল ও কঠিন মনে হলেও, তারা প্রমাণ করে যে বিজ্ঞান ছাড়াও মানব অস্তিত্ব সম্ভব।

তবে এই বিচ্ছিন্ন উদাহরণ দিয়ে পুরো মানব সভ্যতাকে বিচার করা যায় না। আমাদের শৈশবের সেই চিরচেনা ভাবসম্প্রসারণ, “বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ?”, আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তখন আমরা নির্দ্বিধায় বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ হিসেবেই প্রতিষ্ঠা করতাম। আর তার কারণও ছিল স্পষ্ট। হাতের মুঠোয় থাকা স্মার্টফোনটি আজ শুধু কথা বলার যন্ত্র নয়, এটি যেন পুরো পৃথিবীকে এনে দিয়েছে আমাদের হাতের তালুতে। মুহূর্তের মধ্যে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের খবর নেওয়া, যোজন যোজন দূরে থাকা প্রিয়জনের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলা—এসবই বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান। বিদ্যুৎ আবিষ্কার ছিল মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার এক মাইলফলক, যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে আজকের প্রযুক্তিনির্ভর বিশ্ব। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য প্রায় সবকিছুই বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল।

যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে চিকিৎসা, কৃষি, শিল্প—সর্বত্রই বিজ্ঞানের জয়জয়কার। একসময় মানুষ মাইলের পর মাইল পায়ে হেঁটে পাড়ি দিত, আর আজ বিমান, ট্রেন, বাসের কল্যাণে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে যাওয়াটা মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার। চিকিৎসা বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি মারাত্মক সব রোগকে পরাজিত করেছে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় ও তার প্রতিকার আজ কোটি কোটি মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে। কৃষিক্ষেত্রে সবুজ বিপ্লব ঘটেছে বিজ্ঞানের হাত ধরেই। একসময় যে জমিতে সামান্য ফসল ফলত, আজ আধুনিক প্রযুক্তি ও গবেষণার ফলে তার উৎপাদন বেড়েছে চার থেকে পাঁচ গুণ। মৎস্যচাষ ও পশুসম্পদ পালনেও এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনকেও বিজ্ঞান করেছে আরামদায়ক ও সহজ। প্রচণ্ড গরমে হাতপাখার বদলে আজ বৈদ্যুতিক পাখা বা এয়ারকন্ডিশনার আমাদের স্বস্তি দেয়। কনকনে শীতে উষ্ণতা দেয় রুম হিটার। রান্নাঘরের কাজ সহজ করেছে রাইস কুকার, মাইক্রোওয়েভ ওভেন। আর ফ্রিজ বা হিমাগারের মতো আবিষ্কার খাদ্য সংরক্ষণকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। নিঃসন্দেহে, বিজ্ঞানের এই আশীর্বাদগুলো অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

কিন্তু মুদ্রার অপর পিঠও রয়েছে। যে বিজ্ঞান একদিন মানুষের জীবন বাঁচানোর ব্রত নিয়েছিল, সেই বিজ্ঞানের অপব্যবহারই আজ মানব সভ্যতাকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভয়ংকর ভবিষ্যতের দিকে। বিজ্ঞানের আশীর্বাদের পাল্লার চেয়ে অভিশাপের পাল্লাটাই যেন দিন দিন ভারী হয়ে উঠছে। বিধ্বংসী আগ্নেয়াস্ত্র, পারমাণবিক বোমা, অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান—এসব এক নিমিষেই একটি সাজানো শহরকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করতে পারে। আর এই ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে যে প্রযুক্তিটি আজ সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও শঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, তার নাম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)।

এআই তৈরি হয়েছিল মূলত মানুষের কাজকে সহজ করতে, মানুষের কল্যাণে। কিন্তু এর অপব্যবহার এক নতুন সংকটের জন্ম দিয়েছে। এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে এমন নিখুঁত নকল ভিডিও বা ‘ডিপফেক’ তৈরি হচ্ছে, যা দেখে আসল-নকলের পার্থক্য করা প্রায় অসম্ভব। এর মাধ্যমে যেকোনো সম্মানিত ব্যক্তির সম্মানহানি করা, সামাজিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করা, কিংবা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। তথ্যের সত্যতা যাচাই করা হয়ে উঠেছে এক বিরাট চ্যালেঞ্জ।

এই প্রযুক্তির ভয়ংকরতম রূপটি হয়তো আমরা দেখতে পাবো যুদ্ধক্ষেত্রে। বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো সামরিক খাতে বিপুল পরিমাণে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। চালকবিহীন ড্রোন, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবস্থা এবং রোবট সৈন্য তৈরির প্রতিযোগিতা চলছে। এখানেই আমাদের মনে করিয়ে দেয় রজনীকান্ত অভিনীত বিখ্যাত সিনেমা ‘রোবট’-এর কথা। সিনেমার প্রধান চরিত্র বিজ্ঞানী বশীকরণ মানুষের কল্যাণের জন্য ‘চিট্টি’ নামক একটি রোবট তৈরি করেছিলেন। কিন্তু একসময় সেই রোবট নিজে আপডেট হয়ে ‘ভার্সন ২.০’-তে রূপান্তরিত হয় এবং মানব সভ্যতার জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়। যদিও সিনেমাটি ছিল কাল্পনিক, কিন্তু এর মূল ভয়টি—নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া প্রযুক্তি—আজকের পৃথিবীতে অত্যন্ত বাস্তব একটি শঙ্কা।

ভাবুন তো একবার, কোনো কারণে যদি সামরিক রোবটগুলো, যেগুলোকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পরিচালনা করা হয়, কোনো প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বা নিজে নিজে আপডেট হয়ে মানুষের নির্দেশ অমান্য করা শুরু করে? যদি তারা শত্রু-মিত্র চিনতে ভুল করে? সেই ধ্বংসলীলার চিত্র কল্পনা করাও কঠিন। তাদের কাছে মানব আবেগ, নৈতিকতা বা অনুশোচনার কোনো স্থান থাকবে না। তারা কেবল তাদের প্রোগ্রামিং অনুযায়ী কাজ করবে, যা মানব সভ্যতার জন্য সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠতে পারে।

তাহলে আমরা কোন পথে হাঁটছি? আমরা কি প্রযুক্তির এমন এক চূড়ায় পৌঁছাতে চলেছি যেখান থেকে পতনের আর কোনো সীমা থাকবে না? উত্তরটি হলো, প্রযুক্তি নিজে ভালো বা খারাপ নয়। এর ব্যবহারই একে আশীর্বাদ বা অভিশাপে পরিণত করে। আগুন দিয়ে যেমন রান্না করা যায়, তেমন ঘরবাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

সময় এসেছে লাগাম টেনে ধরার। আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, এআই-এর উন্নয়ন যেন মানবতাকে কেন্দ্র করে হয়। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী আন্তর্জাতিক আইন, নৈতিক নীতিমালা এবং কঠোর তদারকি। আমাদের মনে রাখতে হবে, “মানুষের জন্য বিজ্ঞান, বিজ্ঞানের জন্য মানুষ নয়।” বিজ্ঞান হোক আমাদের অগ্রযাত্রার সঙ্গী, নিয়ন্ত্রক নয়। আমরা যদি বিজ্ঞানকে যথাযথভাবে, মানবতার কল্যাণে ব্যবহার করতে পারি, তবেই এর আসল সার্থকতা। নতুবা আমাদের নিজেদের তৈরি প্রযুক্তিই হয়তো একদিন আমাদের অস্তিত্বের সংকট তৈরি করবে।

লেখক: সহকারী শিক্ষক, কাইচতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।