
চট্টগ্রামের মানচিত্রজুড়ে সর্পিল গতিতে বয়ে চলা কর্ণফুলী কেবল একটি নদী নয়, এটি এই শহরের প্রাণপ্রবাহিনী, অর্থনীতির হৃদপিণ্ড এবং ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। এই নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, যা বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির সিংহদ্বার। কর্ণফুলীকে ঘিরে আবর্তিত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন ও জীবিকা। কিন্তু যে নদী চট্টগ্রামকে প্রাণের স্পন্দন দিয়েছে, আজ সেই নদী নিজেই মানুষের লোভ, অবহেলা আর অপরিণামদর্শিতার শিকার হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। একসময়কার প্রাণচঞ্চল কর্ণফুলী আজ এক বিষাক্ত ভাগাড়ে পরিণত হতে চলেছে, যার পানি ও পলিতে মিশেছে নীরব ঘাতক—মাইক্রোপ্লাস্টিক।
সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের একটি গবেষণা আমাদের চোখের সামনে এক ভয়াবহ বাস্তবতাকে উন্মোচিত করেছে। এই গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীতে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ হাজার মেট্রিক টনেরও বেশি বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে। এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্পকারখানা, গৃহস্থালি এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক, পলিথিনসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পদার্থ। এই প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পাঁচ মিলিমিটারের চেয়েও ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হয়, যা মাইক্রোপ্লাস্টিক নামে পরিচিত। এই অদৃশ্য শত্রু এখন নদীর পানি থেকে শুরু করে তলদেশের গভীরেও ছড়িয়ে পড়েছে।
গবেষণায় আরও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। নদীর পৃষ্ঠের পানির চেয়ে তলদেশের পলিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের ঘনত্ব অনেক বেশি। বিশেষ করে শীতকালে যখন নদীতে পানির প্রবাহ কমে যায়, তখন এই দূষণের মাত্রা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়। আশঙ্কার বিষয় হলো, পোশাক কারখানা থেকে নির্গত সিনথেটিক তন্তু এবং পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল থেকে উৎপন্ন হওয়া মাইক্রোপ্লাস্টিক ফাইবারের পরিমাণই সবচেয়ে বেশি। এই কণাগুলো নদীর বাস্তুতন্ত্রের জন্য এক চরম হুমকি। নদীর মাছ, কাঁকড়া, শামুকসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী খাবারের সঙ্গে এই বিষাক্ত কণা গ্রহণ করছে। ফলস্বরূপ, খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে এই মাইক্রোপ্লাস্টিক শেষ পর্যন্ত মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবদেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি ক্যান্সার, হরমোনজনিত সমস্যা, স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতিসহ নানা ধরনের জটিল রোগের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। কর্ণফুলীর দূষণ আজ কেবল নদীর প্রাণবৈচিত্র্যকেই ধ্বংস করছে না, বরং চট্টগ্রামবাসীর স্বাস্থ্যকেও এক মারাত্মক হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের লাইফলাইনের এই করুণ পরিণতি? এর উত্তর আমাদের সকলেরই জানা, কিন্তু আমরা চোখ বন্ধ করে আছি। প্রথমত, অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। একটি ক্রমবর্ধমান মহানগরী হিসেবে চট্টগ্রামে যে সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন ছিল, তা আজও গড়ে ওঠেনি। দ্বিতীয়ত, নাগরিকদের অসচেতনতা এবং যত্রতত্র প্লাস্টিক ও পলিথিন ফেলার আত্মঘাতী প্রবণতা। ২০০২ সালে আইন করে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হলেও, সেই আইনের কোনো কার্যকর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। হাট-বাজার থেকে শুরু করে অভিজাত বিপণিবিতান—সর্বত্রই পলিথিনের অবাধ ব্যবহার চলছে।
দূষণের পাশাপাশি কর্ণফুলীর ওপর চলছে দখলের মহোৎসব। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি ও ভূমিদস্যুরা নদীর দুই পাড় দখল করে একের পর এক অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করে চলেছে। এর ফলে নদীর প্রশস্ততা সংকুচিত হয়ে এর স্বাভাবিক গতিপথ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন সময়ে মহামান্য হাইকোর্ট নদী দখল উচ্ছেদের নির্দেশ দিলেও সেই অভিযান প্রায়শই মাঝপথে থেমে যায়। দখলদারদের ক্ষমতার কাছে বারবার আইন অসহায় আত্মসমর্পণ করে। ফলে নদী তার চিরচেনা রূপ হারিয়ে একটি সরু খালে পরিণত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। নদীর প্রবাহ কমে যাওয়ায় পলি জমে এর নাব্যতা হ্রাস পাচ্ছে, যা চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্যও একটি বড় অন্তরায়।
সবচেয়ে বড় শঙ্কার বিষয় হলো, চট্টগ্রাম ওয়াসা এই কর্ণফুলী নদী থেকেই পানি সংগ্রহ করে শোধন করার পর নগরবাসীর কাছে সরবরাহ করে। প্রশ্ন উঠেছে, ওয়াসার পানি শোধন প্রক্রিয়ায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের মতো ক্ষুদ্র কণা পরিশোধন করার সক্ষমতা আছে কি? যদি না থাকে, তবে প্রতিদিন চট্টগ্রামবাসী যে পানি পান করছে, তার মাধ্যমে তাদের শরীরে প্রবেশ করছে বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা। এটি একটি নীরব মহামারী ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা কর্ণফুলীকে ‘চট্টগ্রামের প্রাণ’ বলে মুখে ফেনা তুলি, অথচ সেই প্রাণের টুঁটি চেপে ধরেছি আমরা নিজেরাই।
এখন আর কেবল গবেষণা, সেমিনার বা আলোচনার সময় নেই। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে প্রয়োজন সমন্বিত, কঠোর এবং জরুরি পদক্ষেপ। এর জন্য প্রশাসনিক গাফিলতি এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব—এই দুটি মূল প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে। প্রথমত, নদীর সীমানা নির্ধারণ করে সকল প্রকার দখলদারকে উচ্ছেদ করতে হবে। এক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক পরিচয় বা ক্ষমতার দাপটকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া চলবে না। দ্বিতীয়ত, যারা নদীতে শিল্পবর্জ্য ফেলছে, সেইসব কারখানা ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের জন্য এফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট (ইটিপি) স্থাপন ও ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে।
একইসাথে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনকে একটি আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। উৎস থেকে বর্জ্য পৃথকীকরণ, রিসাইক্লিং এবং প্লাস্টিক বর্জ্যের বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং এর বিকল্প হিসেবে পাটের ব্যাগ বা অন্যান্য পরিবেশবান্ধব সামগ্রী ব্যবহারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। গণমাধ্যম ও সামাজিক সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা অপরিহার্য।
কর্ণফুলী নদী আমাদের মা। এই মাকে রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের সকলের। সরকার, প্রশাসন, শিল্পমালিক, এবং সাধারণ নাগরিক—প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। যদি আমরা এখনও উদাসীন থাকি, তবে অদূর ভবিষ্যতে কর্ণফুলী কেবলই এক মৃতপ্রায় নর্দমায় পরিণত হবে। আর সেদিন চট্টগ্রামের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং জনস্বাস্থ্য—দুটোই এক অপূরণীয় সংকটের সম্মুখীন হবে। কর্ণফুলীর কান্না শোনার এখনই শেষ সময়।
লেখক : ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।