
চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার বিস্তীর্ণ মাঠ। ক’বছর আগেও বোরো মৌসুমে যেদিকে চোখ যেত, দেখা মিলত শুধু সবুজ ধানের শীষের দোল। কিন্তু এখন সেই সবুজের সাথে পাল্লা দিয়ে জায়গা করে নিয়েছে ভুট্টার সোনালী মোচা আর নানা জাতের সবজি। কৃষকরা বলছেন, ধানের চেয়ে ভুট্টা আর সবজিতেই লাভ বেশি, টাকাও হাতে আসে দ্রুত। মাঠের এই বদলে যাওয়া চিত্র স্পষ্ট, কিন্তু সরকারি পরিসংখ্যানে এর প্রতিফলন নেই।
কাগজে-কলমে দেশে প্রতি বছর বাড়ছে বোরো ধানের আবাদ ও উৎপাদন। অথচ ‘চোখের আন্দাজে’ তৈরি করা এই অতিরঞ্জিত পরিসংখ্যানের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। উৎপাদনের ‘রেকর্ড’ দেখিয়ে সরকার বাহবা নিলেও চট্টগ্রামের চাক্তাই থেকে শুরু করে নগরীর খুচরা বাজার পর্যন্ত চালের দামে আগুন। মৌসুমের ভরা সময়েও দাম বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। আমদানির অনুমতি দিয়েও লাগাম টানা যাচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, তথ্যের গরমিলের কারণেই নীতির সঙ্গে বাজারের এই বিরাট ফারাক, যার খেসারত দিচ্ছে ভোক্তারা।
মাঠের বাস্তবতা: ধান ছেড়ে ভুট্টায় ঝুঁকছেন কৃষক
রাঙ্গুনিয়ার কৃষক মোহাম্মদ সোহাগের কথাই ধরা যাক। ২৬ বছরের কৃষি জীবনে এবারই প্রথম তিনি বোরো ধানের বদলে তিন বিঘা জমিতে ভুট্টা লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, “ধানের আবাদে খরচ বেশি, কিন্তু দাম পাওয়া যায় না। আশপাশের সবাই ভুট্টা চাষ করে লাভ করছে দেখে আমিও করেছি। ফসল ওঠার সাথে সাথেই ভালো দামে বিক্রি হয়ে গেল।”
এই চিত্র শুধু রাঙ্গুনিয়ার নয়, আনোয়ার, সাতকানিয়া, মীরসরাইসহ চট্টগ্রামের প্রায় সব কৃষিপ্রধান এলাকার। নগরের কাছাকাছি হওয়ায় লাভজনক সবজি ও ভুট্টা চাষে ঝুঁকছেন কৃষক। এর সাথে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের থাবায় প্রতি বছর কমছে মোট কৃষি জমির পরিমাণ। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে, সরকারি হিসাবে প্রতি বছরই ধানের আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ছে।
পরিসংখ্যানের গোলকধাঁধা ও বাজারের আগুন
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, গত বোরো মৌসুমে দেশে ২ কোটি ২৬ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে প্রায় ১৬ লাখ টন বেশি। উৎপাদনের এই সরকারি পরিসংখ্যান সত্যি হলে ভরা মৌসুমে চালের দাম কেজিতে ১০ টাকা বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু চট্টগ্রামের বাজারগুলোতে নাজির ও মিনিকেট চাল বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৭৫-৮৫ টাকায়।
চালের বাজারের এই অস্থিরতা সামাল দিতে সরকার ৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু মাত্র ২ শতাংশ শুল্কের এই চালও বাজারের আগুন নেভাতে পারেনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, চাহিদা ও সরবরাহের যে হিসাব সরকার দিচ্ছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই। উৎপাদনের তথ্যে বড় ধরনের গরমিল থাকায় এই সংকট তৈরি হয়েছে।
‘চোখের দেখা’ যেভাবে জাতীয় হিসাব
কীভাবে তৈরি হয় এই পরিসংখ্যান? ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মরত উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা, যারা ‘ব্লক সুপারভাইজার’ হিসেবে পরিচিত, তারাই এর মূল উৎস। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চট্টগ্রামের এক উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, “আমার ব্লকে কোন ফসলের আবাদ কতটুকু জমিতে হচ্ছে, তার পুরোটাই চোখের দেখা আর কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তৈরি করা হয়। জমি মেপে বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে সঠিক হিসাব করার কোনো পদ্ধতি আমাদের নেই।”
তিনি আরও বলেন, কৃষকরা লাভজনক ফসলে ঝুঁকছেন, এটা আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু ওপর থেকে ফলন ও আবাদ বাড়িয়ে দেখানোর এক ধরনের চাপ থাকে। ফলে মাঠের প্রকৃত চিত্র আর কাগজের হিসাবে ফারাক থেকে যায়। এই ‘চোখের দেখা’ তথ্যই উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় ঘুরে জাতীয় পরিসংখ্যানে পরিণত হয়।
নীতিগত সংকট ও সমাধানহীন অপেক্ষা
উৎপাদনের ভুল তথ্য শুধু বাজারকেই প্রভাবিত করছে না, বরং সার, বীজ বরাদ্দ থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্তকেও ভুল পথে চালিত করছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, “ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া সিদ্ধান্ত মূল্যস্ফীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি করে।”
পরিসংখ্যানের এই গরমিল নিয়ে বিতর্ক বহু পুরনো। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত জাতীয় শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিও এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছে। এমনকি কৃষি মন্ত্রণালয় ৮টি পণ্যের প্রকৃত উৎপাদন বের করার একটি উদ্যোগ নিলেও তা এক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান সক্ষমতার ঘাটতির কথা স্বীকার করে বলেন, “আমরা ২৫ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা করছি, যেখানে এসব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।”
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, তারা রিমোট সেন্সরিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসলের প্রকৃত তথ্য বের করার জন্য একটি প্রকল্প হাতে নিতে যাচ্ছে। তবে সেই প্রযুক্তি মাঠে নামার আগ পর্যন্ত ‘চোখের আন্দাজই’ থেকে যাচ্ছে ভরসা। আর এই অনুমানের ওপর ভর করে চলা নীতির মাশুল গুনতে হচ্ছে চট্টগ্রামের লক্ষ লক্ষ ভোক্তাকে।