
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সৃষ্ট তীব্র তাপপ্রবাহ বাংলাদেশে মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠেছে, যার ফলে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অপরিণত (প্রিম্যাচিউর) ও কম ওজনের শিশু জন্ম এবং নবজাতকের মৃত্যু। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর দেশে যে প্রায় পৌনে ছয় লাখ অপরিণত শিশু জন্মায়, তার অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে অসহনীয় গরম।
ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তামান্না (ছদ্মনাম) তীব্র গরমের মধ্যে নিয়মিত ক্লাস করে গর্ভকালীন সময় পার করছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি একটি মৃত সন্তান প্রসব করেন। তার চিকিৎসক এই মর্মান্তিক ঘটনার জন্য তীব্র গরমের মধ্যে নিয়মিত যাতায়াতকে একটি সম্ভাব্য কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। তামান্নার মতো হাজারো মায়ের গল্প এখন বাংলাদেশের করুণ বাস্তবতা।
আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)-এর তথ্যমতে, বছরে প্রায় ৪ লাখ ৮৮ হাজার অপরিণত শিশু জন্ম নিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের ১০৩টি দেশের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। দেশে প্রতি ঘণ্টায় ৫৬টি শিশু অপরিণত অবস্থায় জন্মায়, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ হার। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি পাঁচটি নবজাতকের মধ্যে একজনের মৃত্যুর কারণ অপরিণত জন্ম সংক্রান্ত জটিলতা।
জলবায়ু পরিবর্তন যেভাবে ঝুঁকি বাড়াচ্ছে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গর্ভবতী মায়ের শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে। এ অবস্থায় বাইরের অতিরিক্ত গরম, বিশেষ করে তাপপ্রবাহ, মায়ের শরীরে ‘শক’ এবং ‘স্ট্রেস’ তৈরি করে।
আইসিডিডিআর,বি-এর মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানুর রহমান বলেন, “অতিরিক্ত গরমের কারণে গর্ভবতী মায়েদের প্রি-এক্লাম্পসিয়া (গর্ভাবস্থায় উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা) হতে পারে, যা অপরিণত জন্ম, কম ওজনের শিশু জন্ম এমনকি মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে দেয়।”
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা বলছে, তাপমাত্রা প্রতি এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়লে অপরিণত জন্মের ঝুঁকি ৪ থেকে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা তাপপ্রবাহের সময় ২৬ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। আইসিডিডিআর,বি-এর গবেষক মাহীন আল নাহিয়ান জানান, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে এবং ভবিষ্যতে এই বৃদ্ধির হার আরও বাড়বে।
স্বাস্থ্যখাতে প্রভাব ও করণীয়
অপরিণত এবং কম ওজনের শিশুরা শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা, কিডনির দুর্বলতা এবং কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসহ নানা ধরনের স্বাস্থ্য জটিলতা নিয়ে জন্মায়, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফেটো-ম্যাটারনাল মেডিসিন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নহরিন আক্তার বলেন, “তীব্র গরম মায়ের গর্ভে ভ্রূণের বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেওয়া একটি শিশু বাইরের তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে না।”
এই সংকট মোকাবিলায় বিশেষজ্ঞরা একটি সমন্বিত কর্মপরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন। তাদের সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে: তাপপ্রবাহপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করে তথ্য সংগ্রহ করা; গর্ভবতী মায়েদের জন্য বিশেষ সতর্কতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি; এবং সরকারি তাপপ্রবাহ নির্দেশিকাগুলোতে মাতৃস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
আইসিডিডিআর,বি-এর বিজ্ঞানী এহসানুর রহমান বলেন, “সৌদি আরবের মতো দেশে তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রিতে পৌঁছালে সব ধরনের কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশেরও এই ধরনের বৈশ্বিক চর্চা অনুসরণ করে জরুরি অ্যাম্বুলেন্স সেবা নিশ্চিতকরণ এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো পদক্ষেপ নিতে হবে।”
বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মানো শিশুর মধ্যে ৩১ জন পাঁচ বছর বয়সের আগে এবং ২০ জন নবজাতক অবস্থায় মারা যায়। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন করতে হলে ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার যথাক্রমে ২৫ এবং ১২-তে নামিয়ে আনতে হবে, যা জলবায়ু পরিবর্তনের এই ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ছাড়া প্রায় অসম্ভব।