
রাজনীতির গতিপথ যে কতটা অপ্রত্যাশিত ও নাটকীয় হতে পারে, তার সর্বশেষ উদাহরণ সৃষ্টি হলো আমাদের প্রতিবেশী দেশ নেপালে। প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির আকস্মিক পদত্যাগ কোনো রাজনৈতিক দলের অনাস্থা প্রস্তাব বা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ফল নয়, বরং এটি রাজপথে নেমে আসা একদল ক্ষুব্ধ তরুণের সম্মিলিত শক্তির কাছে নতিস্বীকার। এই তরুণরা, যারা ‘জেন-জি’ বা জেনারেশন জেড নামে পরিচিত, তাদের বিক্ষোভের আগুন এতটাই তীব্র ছিল যে কাঠমান্ডুর ক্ষমতার মসনদ পর্যন্ত এর উত্তাপ সইতে পারেনি। নেপালের এই ঘটনা কেবল একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট হিসেবে দেখলে ভুল হবে; এর গভীরে লুকিয়ে আছে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বজুড়ে সরকারগুলোর জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। আর সেই বার্তার প্রতিধ্বনি বাংলাদেশের মানুষও চেনে, সাম্প্রতিক অতীতে যার সাক্ষী আমরাও হয়েছি।
নেপালের বিক্ষোভের প্রধান কারণ ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর সরকারের খড়্গহস্ত হওয়া। আদালতের এক আদেশের পর দেশটির যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স (সাবেক টুইটার), হোয়াটসঅ্যাপসহ ২৬টি জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মকে নিবন্ধনের জন্য মাত্র সাত দিনের সময়সীমা বেঁধে দেয়। এই অযৌক্তিক সময়সীমার মধ্যে নিবন্ধন করতে না পারায় প্ল্যাটফর্মগুলোর ওপর নেমে আসে নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া। সরকারের এই সিদ্ধান্ত ছিল আত্মঘাতী এবং বাস্তবতাবিবর্জিত। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে দাঁড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কেবলই বিনোদন বা ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যম নয়, এটি বহু মানুষের জীবন-জীবিকার অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নেপালের মতো দেশ, যার অর্থনীতির একটি বড় অংশ পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল, সেখানে ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো বিপণন ও যোগাযোগের প্রধান হাতিয়ার। বহু ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ট্যুর অপারেটর এবং ফ্রিল্যান্সাররা এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলোকে ব্যবহার করে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তে তাদের আয়ের পথ বন্ধ হয়ে যায়, যা ছিল জ্বলন্ত আগুনে ঘি ঢালার মতো। দেশটির তরুণ সমাজ এমনিতেই চাকরি ও অর্থনৈতিক সংকটে জর্জরিত। এমন পরিস্থিতিতে ডিজিটাল অর্থনীতিকে উৎসাহিত করার বদলে তাকে গলা টিপে ধরার এই প্রচেষ্টা তাদের ক্ষোভকে আন্দোলনে রূপ দেয়।
তবে এই বিক্ষোভের গভীরে ছিল সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে জমে থাকা পুঞ্জীভূত অসন্তোষ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের সিদ্ধান্তটি ছিল সেই ক্ষোভের আগুনে স্ফুলিঙ্গের মতো, যা দাবানলে পরিণত হয়। মূল ইস্যু ছিল দুর্নীতি। সাধারণ মানুষ যখন অর্থনৈতিক চাপে পিষ্ট, তখন রাষ্ট্রযন্ত্রের ভেতরে চলা দুর্নীতি তাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ছিল সেই জায়গা, যেখানে মানুষ সরকারের ব্যর্থতা, দুর্নীতি ও নানা অসংগতির বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কথা বলতে পারত। সরকার এই কণ্ঠকেই রোধ করতে চেয়েছিল। কিন্তু দমনপীড়ন যে প্রতিবাদের ভাষাকে আরও শক্তিশালী করে তোলে, নেপালের সরকার তা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছিল। তরুণরা যখন দেখল তাদের কথা বলার অধিকার এবং রুটি-রুজি—দুটোই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, তখন তাদের রাজপথে নামা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। কাঠমান্ডুসহ সাতটি শহরে একযোগে জ্বলে ওঠা বিক্ষোভ, পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগিয়ে যাওয়া, এবং সবশেষে কারফিউ ও সেনাবাহিনী মোতায়েন—এই প্রতিটি দৃশ্যপট প্রমাণ করে যে পরিস্থিতি কতটা গুরুতর আকার ধারণ করেছিল।
নেপালের এই ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অতীতের সাদৃশ্য আশ্চর্যজনকভাবে স্পষ্ট। গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার পেছনেও ছিল সরকারের প্রতি একরাশ ক্ষোভ এবং ডিজিটাল মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণের প্রচেষ্টা। বৈষম্যমূলক কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শুরু হওয়া সেই আন্দোলনও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর ভর করেই দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল। ঠিক নেপালের মতোই, বাংলাদেশের তরুণরাও তখন সরকারের দীর্ঘদিনের নানা নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অসন্তুষ্ট ছিল। যখন সেই অসন্তোষ প্রকাশের মাধ্যমকেও সংকুচিত করার চেষ্টা করা হলো, তখন প্রতিবাদের বিস্ফোরণ ছিল অনিবার্য। উভয় ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি, কীভাবে একটি আপাত বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে তরুণ প্রজন্মের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ এক গণ-অভ্যুত্থানের জন্ম দিয়েছে, যার পরিণতিতে সরকারের পতন ঘটেছে।
এই দুটি ঘটনাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, বর্তমান বিশ্বের শাসকেরা যদি তাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষাকে বুঝতে না পারেন, তবে তাদের জন্য কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। আজকের জেন-জি কেবল প্রযুক্তিনির্ভর নয়; তারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তথ্যের মহাসড়কে বিচরণ করে। তারা অন্যায়, দুর্নীতি এবং অগণতান্ত্রিক আচরণের বিরুদ্ধে আগের যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে বেশি সোচ্চার ও সংগঠিত হতে সক্ষম। তাদের হাতে থাকা স্মার্টফোনটি শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি প্রতিবাদের একটি শক্তিশালী অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহার করে তারা ভৌগোলিক সীমানা ছাড়িয়ে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে, মুহূর্তের মধ্যে বার্তা ছড়িয়ে দিতে পারে এবং জনমত গঠন করতে পারে।
সুতরাং, নেপালের ঘটনা থেকে সরকারগুলোর জন্য শিক্ষণীয় বিষয় হলো—জনগণের কণ্ঠকে, বিশেষ করে তরুণদের কণ্ঠকে, স্তব্ধ করার চেষ্টা করা একটি বুমেরাং কৌশল। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং ভাবের আদান-প্রদানের পথ উন্মুক্ত রাখা একটি সুস্থ সমাজের পূর্বশর্ত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে হয়তো সাময়িকভাবে সমালোচনাকে চাপা দেওয়া যায়, কিন্তু তাতে ভেতরের অসন্তোষ আরও ঘনীভূত হয় এবং সঠিক সময়ে আরও ভয়ংকর রূপে প্রকাশ পায়।
শাসকদের বুঝতে হবে, যুগ বদলেছে। এখনকার তরুণরা কেবল চাকরি বা সুযোগ-সুবিধা চায় না, তারা চায় সম্মান, স্বচ্ছতা এবং নিজেদের কথা বলার অধিকার। তাদের সমস্যা বা স্বার্থের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন এবং তাদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির পদত্যাগ এবং বাংলাদেশের বিগত সরকারের পতন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। এই বার্তা শুধু নেপাল বা বাংলাদেশের জন্য নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার সেইসব শাসকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা, যারা ডিজিটাল যুগেও প্রস্তরযুগীয় মানসিকতা নিয়ে দেশ শাসন করতে চান। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব না দিলে জনরোষের উত্তাল তরঙ্গে ক্ষমতার তরী ডুবে যেতে মুহূর্তও সময় লাগে না।
লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।