বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

সীমান্তে আরাকান আর্মির সঙ্গে বিপজ্জনক বাণিজ্য কেন থামছে না?

নজরুল কবির দীপু | প্রকাশিতঃ ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | ৩:২৯ অপরাহ্ন


সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসছে বারুদের গন্ধ, আর এপার থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের চালান—এই আপাতদৃষ্টিতে বিপরীতমুখী স্রোতটিই এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের সবচেয়ে উদ্বেগজনক বাস্তবতা। এটি কোনো সাধারণ চোরাচালান নয়; এটি একটি পরিকল্পিত, অবৈধ এবং অত্যন্ত বিপজ্জনক ‘বিনিময় প্রথা’। এই প্রথার এক প্রান্তে রয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি (এএ), যাদের প্রয়োজন রসদ। অন্য প্রান্তে রয়েছে বাংলাদেশি অপরাধী চক্র, যাদের লক্ষ্য মাদকের চালান। আলু, ডাল, তেল, সার আর ওষুধের বিনিময়ে বাংলাদেশে ঢুকছে সর্বনাশা ইয়াবা আর আইসের মতো সিন্থেটিক ড্রাগস। মাছ ধরার ট্রলারের আড়ালে গভীর সমুদ্রে চলমান এই বিষাক্ত বাণিজ্য কেবল আইনশৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি সরাসরি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বুকে ছুরিকাঘাত করার শামিল।

রাখাইনের ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্র বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে সীমান্তের অপরাধ জগতের ধরন। একসময় টেকনাফ স্থলবন্দর ছিল দুই দেশের বাণিজ্যের মূল কেন্দ্র। কিন্তু মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সংঘাত, বিশেষ করে আরাকান আর্মির কাছে জান্তা বাহিনীর পিছু হটার পর সেই বন্দরের ফটকে তালা পড়েছে। কিন্তু চাহিদা তো থেমে থাকেনি। আরাকান আর্মি এখন একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রক। তাদের হাজার হাজার সদস্যের জন্য খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি থেকে শুরু করে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য সিমেন্ট পর্যন্ত প্রয়োজন। এই বিপুল চাহিদা মেটানোর জন্য তারা বেছে নিয়েছে সবচেয়ে সহজ এবং পরীক্ষিত পথ—মাদকের অর্থনীতি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কথায়, আরাকান আর্মির টিকে থাকার মূল ভিত্তিই হলো মাদক। এই মাদককে পুঁজি করে তারা তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের জন্য একটি সমান্তরাল অর্থনীতির সাপ্লাই চেইন তৈরি করেছে, যার প্রধান রসদ জোগানদাতা হয়ে উঠেছে সীমান্তের এপাশের লোভী চক্রগুলো।

সাম্প্রতিক সময়ে কোস্টগার্ড ও অন্যান্য বাহিনীর অভিযানে জব্দ হওয়া পণ্যের তালিকা দেখলেই এই সাপ্লাই চেইনের গভীরতা আঁচ করা যায়। ৬ সেপ্টেম্বর সেন্টমার্টিনের কাছে ট্রলার থেকে উদ্ধার হওয়া ৪০০ বস্তা আলু ও ৪০ বস্তা রসুন, ৪ সেপ্টেম্বর নাজিরারটেক থেকে জব্দকৃত ১৯৭ বস্তা সিমেন্ট, পেরেক ও বিপুল পরিমাণ ওষুধ, কিংবা ২৯ আগস্ট কর্ণফুলী চ্যানেল থেকে আটককৃত ৬২০ বস্তা ডাল, ৪৮০টি লুঙ্গি ও ৪০০টি শাড়ি—এগুলো বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। এগুলো একটি বিশাল কর্মযজ্ঞের একেকটি খণ্ডচিত্র, যা প্রমাণ করে আরাকান আর্মির চাহিদা কতটা ব্যাপক এবং আমাদের অপরাধী চক্রগুলো তা মেটাতে কতটা তৎপর। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এই পণ্যগুলো যখন মিয়ানমারে পৌঁছায়, তার বিনিময়ে খালি ট্রলার ফিরে আসে না; ফিরে আসে তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করার মারাত্মক সব মাদকদ্রব্য নিয়ে।

এই অবৈধ বিনিময় প্রথার ভয়াবহতা বহুমাত্রিক। প্রথমত, এটি বাংলাদেশের মাদক সমস্যাকে আরও তীব্র করে তুলছে। সরকার যখন মাদকের বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি নিয়ে এগোচ্ছে, তখন সীমান্তের এই নতুন রুট মাদকের এক বিশাল প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছে। এতে শুধু সামাজিক অবক্ষয়ই বাড়ছে না, দেশের স্বাস্থ্যখাত ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপরও প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, এই চক্র মানব পাচারের মতো জঘন্য অপরাধকেও রসদ জোগাচ্ছে। রাখাইনের অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনের লোভ দেখিয়ে প্রথমে কক্সবাজারের ক্যাম্পে আনা হচ্ছে এবং পরে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে পাচার করা হচ্ছে। আরাকান আর্মির সদস্যরা এই মানব পাচারের পথকে সচল রাখতেও মাদককে ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে মাদক, চোরাচালান এবং মানব পাচারের এক অশুভ ত্রিভুজ সংকট সীমান্তে তৈরি হয়েছে।

তৃতীয়ত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো—এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক অশনি সংকেত। একটি প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যখন কোনো দেশের অপরাধী চক্রের সরাসরি অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়, তখন তা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়। আরাকান আর্মিকে রসদ জুগিয়ে আমরা প্রকারান্তরে নিজেদের আঙিনায় একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতিকে আরও উসকে দিচ্ছি। আজ যারা আলু-ডালের বিনিময়ে মাদক দিচ্ছে, কাল তারা অর্থের লোভে অস্ত্র কিংবা আরও বিপজ্জনক সামগ্রী পাচার করবে না—তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিজিবির টেকনাফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমানের ভাষায়, এই চোরাচালান চক্র জাতীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য মারাত্মক হুমকি।

এই সংকট মোকাবিলায় বিজিবি, কোস্টগার্ড এবং নৌবাহিনীর সমন্বিত অভিযান নিঃসন্দেহে প্রশংসার যোগ্য। গভীর সমুদ্রে নজরদারি বাড়িয়ে তারা পাচারকারীদের পরিকল্পনা অনেকাংশেই নস্যাৎ করে দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কেবল অভিযান চালিয়ে কি এই সমস্যার মূল উৎপাটন করা সম্ভব? যে চক্রটি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন জেটি ব্যবহার করে হাজার হাজার বস্তা পণ্য পাচারের সক্ষমতা রাখে, তাদের শেকড় সমাজের কতটা গভীরে, তা অনুসন্ধান করা জরুরি। শুধু বাহকদের আটক করলেই হবে না, এই নেটওয়ার্কের মূল হোতা, অর্থ জোগানদাতা এবং রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে।

এই অবৈধ বিনিময় প্রথা ভাঙতে একটি সমন্বিত ও কঠোর কৌশল গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। সীমান্তে নজরদারি আরও প্রযুক্তিনির্ভর করার পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা বহুগুণ বাড়াতে হবে। মাদক ও চোরাচালানের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ কোথায় বিনিয়োগ হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে। পাশাপাশি, সীমান্ত এলাকার সাধারণ মানুষকে এই চক্রান্তের ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতন করতে হবে এবং তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। আরাকান আর্মির এই বিষাক্ত বাণিজ্যের লাইফলাইন কেটে দিতে না পারলে, আলু-ডালের বিনিময়ে কেনা এই মাদক ধীরে ধীরে আমাদের সামাজিক ও জাতীয় নিরাপত্তার ভিত্তিকেই ক্ষয় করে দেবে।

লেখক: ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, একুশে পত্রিকা।