বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

চাকসু নির্বাচন: ৩৫ বছরের প্রতীক্ষার অবসান, উৎসবে উত্তাল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে প্রতিবেদক | প্রকাশিতঃ ১৩ অক্টোবর ২০২৫ | ৮:১৬ পূর্বাহ্ন


ক্যাম্পাসজুড়ে বইছে নির্বাচনী হাওয়া। হ্যান্ডবিল, লিফলেট, গান, গম্ভীরা আর নাটকের সুরে মুখর প্রতিটি চত্বর। চায়ের কাপ থেকে শুরু করে দুই টাকার নোটের আদলে তৈরি প্রচারপত্র, সবেতেই যেন সৃজনশীলতার ছড়াছড়ি। এ চিত্র দীর্ঘ ৩৫ বছর পর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচনের। আর মাত্র একদিন পরই ভোট, তাই প্রার্থী, সমর্থক কিংবা সাধারণ শিক্ষার্থী—কারও যেন দম ফেলার ফুরসত নেই। শেষ মুহূর্তের প্রচারে সবাই ব্যস্ত, ক্যাম্পাস পরিণত হয়েছে এক মিলনমেলায়।

আগামী ১৫ অক্টোবর সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলবে ভোটগ্রহণ। এই নির্বাচনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের উত্তেজনা তুঙ্গে। কে জিতবে, কে হারবে—এই আলোচনা এখন ঝুপড়ির আড্ডা থেকে শুরু করে শাটল ট্রেনের বগি পর্যন্ত বিস্তৃত। প্রার্থীরা ভোটারদের মন জয় করতে চষে বেড়াচ্ছেন পুরো ক্যাম্পাস, এমনকি শহরে বসবাসরত শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়েও ভোট চাইছেন তারা। জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ইসলামী ছাত্রশিবির, বাম ছাত্রসংগঠনসহ স্বতন্ত্র মিলিয়ে মোট ১৩টি প্যানেলের প্রার্থীরা দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি।

ভোটারদের আকৃষ্ট করতে প্রার্থীরা নিয়েছেন অভিনব সব পন্থা। কেউ চায়ের কাপ, সংবাদপত্র, ডলার, টাকা, পুতুল বা রাইফেলের আদলে প্রচারপত্র বানিয়েছেন। আবার কেউ লিফলেটের সাথে জুড়ে দিয়েছেন শাটল ট্রেনের সময়সূচি, জরুরি হটলাইন নম্বর কিংবা রিকশার ভাড়ার তালিকা। শহীদ আবদুর রব হলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মো. রিফাতুল ইসলাম যেমন তার ২ নম্বর ব্যালটের সঙ্গে মিল রেখে দুই টাকার নোটের আদলে কার্ড তৈরি করে সবার নজর কেড়েছেন।

শিবির সমর্থিত প্যানেলের সহ-সভাপতি (ভিপি) প্রার্থী ইব্রাহিম হোসেন রনি জানান, তারা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন ও প্রত্যাশার কথা শুনে ইশতেহার তৈরি করেছেন এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রচার চালিয়ে যাবেন। অন্যদিকে, ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী মো. শাফায়েত হোসেন বলেন, শিক্ষার্থীদের মৌলিক অধিকার রক্ষায় কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা ভোটারদের কাছে পৌঁছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন।

তবে এই উৎসবমুখর পরিবেশের মধ্যেও রয়েছে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ। ছাত্রদল মনোনীত প্যানেলের বিরুদ্ধে মাইক ব্যবহার করে প্রচার চালানোর অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রশিবিরের সহ-সাহিত্য সংস্কৃতি ও প্রকাশনা সম্পাদক পদপ্রার্থী জিহাদ হোসাইন।

প্রশাসনের কঠোর অবস্থান ও স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি
নির্বাচনকে স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিয়েছে কঠোর পদক্ষেপ। বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাসে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সার্বক্ষণিক পরিচয়পত্র সঙ্গে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. হোসেন শহীদ সরওয়ার্দী।

সবচেয়ে বড় চমক থাকছে ভোট গণনায়। চাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. মনির উদ্দিন জানিয়েছেন, ভোট ব্যালট পেপারে হলেও গণনা করা হবে ওএমআর (অপটিক্যাল মার্ক রিডার) পদ্ধতিতে। এতে দ্রুত ও নির্ভুলভাবে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, “অ্যানালগ পদ্ধতিতে গণনা করলে অনেক সময় লাগবে। তাই আমরা এ পদ্ধতিতে যাব না।”

নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রতিটি ভোট কক্ষে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হবে এবং কেন্দ্রের বাইরে তার দৃশ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা থাকবে। এমনকি বিদ্যুৎ বিভ্রাট হলেও ভিডিও রেকর্ড সংরক্ষিত থাকবে। পাঁচটি অনুষদ ভবনের ৬০টি কক্ষে প্রায় ৭০০টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে, যেখানে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ব্যবহার করা হবে। প্রকৌশল অনুষদ, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, সমাজবিজ্ঞান অনুষদ এবং ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ভবনগুলোতে স্থাপিত কেন্দ্রে প্রায় ২৭ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের দাবিগুলোর অগ্রাধিকার তালিকা করে কাজ করা হচ্ছে এবং তারই অংশ হিসেবে দীর্ঘদিন পর এই চাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

সব মিলিয়ে, এক বর্ণিল ও উত্তেজনাময় আবহের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় তার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার জন্য প্রস্তুত। এখন শুধু অপেক্ষা ১৫ অক্টোবরের, যেদিন শিক্ষার্থীরা বেছে নেবেন তাদের আগামী দিনের নেতৃত্ব।