
রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের এক বছরের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও দেশের সড়ক নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি, বরং বিশৃঙ্খলা আরও তীব্র হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। মারাত্মক দুর্ঘটনা, ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহনের অবাধ চলাচল, বেপরোয়া গতি এবং চালকদের প্রশিক্ষণের অভাবসহ নানা কারণে সড়কে মানুষের দুর্ভোগ অব্যাহত রয়েছে।
এমন পরিস্থিতির মধ্যেই আজ (বুধবার) পালিত হচ্ছে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা দিবস। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছরের আগস্টে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরবে বলে প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে সড়কে নৈরাজ্য বেড়েছে এবং দুর্ঘটনার সংখ্যাও ঊর্ধ্বমুখী।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী নয় এবং কোনো বিশেষ উদ্যোগও নেয়নি। তিনি বলেন, “উদাহরণস্বরূপ, এই সরকারের আগে কিছু সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশার চলাচল সীমিত করা হচ্ছিল, কিন্তু এখন এগুলো ফ্লাইওভারসহ সর্বত্র নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে।”
বাড়ছে দুর্ঘটনা ও মৃত্যু
সড়ক দুর্ঘটনার সরকারি ও বেসরকারি পরিসংখ্যানে অমিল থাকলেও সবখানেই ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪,৬৩৬ জন নিহত হয়েছেন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০২৩ সালে ৫,০২৪ জন এবং ২০২৪ সালে ৫,৪৮০ জন নিহত হয়েছেন। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৪,১৫০ জন।
তবে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসাবে মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি। তাদের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে ৬,৫২৪ জন, ২০২৪ সালে ৭,২৯৪ জন এবং চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ৪,৯২৫ জন নিহত হয়েছেন। অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) হিসাবে ২০২১ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩১,৫৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে জানান, গত ১২ বছরে দেশে ৬৭,৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জন নিহত হয়েছেন। তিনি এর জন্য সরকারের ‘ভুল নীতিকে’ দায়ী করেন।
ব্যর্থ প্রচারণা ও ক্ষতিপূরণ
বিআরটিএর তথ্য অনুযায়ী, সড়ক নিরাপত্তা বিভাগ গত ছয় অর্থবছরে (২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩-২৪) প্রচারণা বাবদ ১৮ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয় করলেও তা দুর্ঘটনা কমাতে কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
এছাড়া, সড়ক দুর্ঘটনায় হতাহতদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার যে স্কিম আড়াই বছর আগে চালু হয়েছিল, তাতেও তেমন অগ্রগতি নেই। বিআরটিএর তথ্যমতে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৪,৬৫৪ জন নিহত এবং ১৯,০১০ জন আহত হলেও ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন মাত্র ১,৮১১ জন (মোট হতাহতের ৫.৩৭ শতাংশ)। প্রায় ২৭০ কোটি টাকার তহবিল থাকলেও এ পর্যন্ত মাত্র ৮০ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান স্বীকার করেছেন যে, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আরও সময় লাগবে। তিনি প্রশিক্ষিত চালকের অভাবকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জানান, চালকদের লাইসেন্স দেওয়ার আগে ৬০ ঘণ্টার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।
উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান আনফিট যানবাহন চলাচল বন্ধে কঠোর হওয়ার কথাও জানান। তিনি বলেন, “বর্তমানে আমরা প্রতিদিন গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি আনফিট গাড়ি ডাম্পিং করছি।” হতাহতদের ক্ষতিপূরণ প্রদানের প্রক্রিয়া দ্রুত করার জন্য বিআরটিএকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে উল্লেখ করে তিনি আশা প্রকাশ করেন, ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পরিস্থিতির ‘দৃশ্যমান উন্নতি’ হবে।