শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ফিল্ড হাসপাতালের প্রেমে চীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা

প্রকাশিতঃ ৯ অগাস্ট ২০২০ | ৭:৫৯ অপরাহ্ন


চট্টগ্রাম : ব্যবস্থাপনা পরিচালক জিয়ালিয়াং চেনের প্রতিনিধি হয়ে চট্টগ্রামের উত্তর কাট্টলী অবস্থিত শতভাগ রপ্তানিমুখী চীনা প্রতিষ্ঠান জিনদে ইলাস্টিক (বিডি) কোম্পানি লিমিটেডে এসেছিলেন চীনা নাগরিক সুনজুন।

মার্চের শেষের দিকে চীনে ফিরে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু বাংলাদেশের লকডাউন পরিস্থিতিতে সেটা আর সম্ভব হয়নি। সুনজুন প্রতীক্ষার প্রহর গুণছিলেন কখন দুই দেশের করোনা পরি্স্থিতি স্বাভাবিক হবে; নিরাপদে, নির্বিঘ্নে ফিরে যাবেন স্বদেশে স্বজনের কাছে।

কিন্তু স্বদেশে ফেরার আগেই নিজ দেশে সৃষ্ট করোনায় চট্টগ্রামে বসেই আক্রান্ত হয়ে পড়েন সুনজুন। ২৯ জুলাই যখন করোনা শনাক্ত হয়, রীতিমতো ভড়কে গিয়েছিলেন সুনজুন। কী হবে গতি? বাঁচবেন তো? বেঁচেফিরে স্বজন-প্রিয়জনের মুখচ্ছবি দেখবেন তো?

কারণ, ইতোমধ্যে বাংলাদেশের চিকিৎসায় আস্থাহীনতার কথা জেনেছেন সুনজুন। অজানা শঙ্কায় ধুরু ধুরু বুক সুনজুনের। এমন এক পরিস্থিতিতে জিনদে ইলাস্টিকের সহকারী নির্বাহী ইসমাইল হোসেন রিয়াদ সেদিন পড়ন্ত বিকেলে সুনজুনকে পৌছে দেন ফৌজদারহাটস্থ দেশের প্রথম ফিল্ড হাসপাতালে।

মুশকিল হচ্ছে, চায়নিজ ভাষা ছাড়া আর কোনও ভাষা জানেন না, বোঝেন না সুনজুন। ফলে যা হবার তাই হচ্ছিল। সুনজুন আর স্বেচ্ছাসেবকরা কেউ কারো ভাষা, ইশারা বুঝতে পারেন না। এই পরি্স্থিতিতে নতুন পথ তৈরি করলো ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরস্পরের মনের ভাব, অভিব্যক্তি প্রকাশে বেছে নিলো ’গুগল ট্রান্সলেশন’ অ্যাপস। এই মাধ্যমে বাংলায় বলা কথাগুলো চায়নিজ ভাষায় উপস্থাপিত হচ্ছে সুনজুনের কাছে, আর সুনজুনের চীনা ভাষার অভিব্যক্তি বাংলায় অনুবাদ করে দিচ্ছে গুগল।

ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়িত্বরত স্বেচ্ছাসেবকের পাশাপাশি শুধু সুনজুনের চাহিদা বুঝতে কিংবা তার পাঠোদ্ধারে নিয়োজিত করলো আইটি পারদর্শী স্বেচ্ছাসেবক ফারুক চৌধুরী ফয়সালকে। গুগল অনুবাদের মাধ্যমে বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে ফয়সাল চিকিৎসকসহ অন্যদের সুনজুনের প্রতিনিধিত্ব করা শুরু করলেন। চলতে লাগলো সুনজুনকে সুস্থ করতে ফয়সালসহ অন্যান্য স্বেচ্ছাসেবকদের যূথবদ্ধ প্রয়াস।


এদিকে রুটি, ডিম, ডাল, ভাজি, খিচুরি, ভাত, মাছ, মাংস, সবজি-ইত্যকার খাবারতালিকা পছন্দ নয় সুনজুনের। ডিম, তরল দুধ, ফলমূল, মাংস তার মূল খাবার। পরম মমতায় চিকিৎসাসেবা প্রদানের পাশাপাশি এসব খাবার নিয়মিত সরবরাহ করা হতো সুনজুনকে। নিবিড় পরিচর্যার বদৌলতে সুনজুন বুঝে গেলেন এই হাসপাতালই তার ঘর, এখানকার লোকজন তার স্বজন। ভলান্টিয়ারদের সঙ্গে লুডু, ক্যারম খেলার পাশাপাশি গান, আড্ডা, নিয়মিত শরীরচর্চায় টানা ১১ দিন পার করার ফলে ফিল্ড হাসপাতালের তুমুল প্রেমে পড়ে যান সুনজুন।

ফলে শনিবার (৭ আগস্ট) চূড়ান্ত নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ হওয়ার পরও হাসপাতালের মায়া ছাড়তে পারছিলেন না সুনজুন। করোনা-আক্রান্ত হওয়ার পর সুচিকিৎসার অনিশ্চয়তায় ভড়কে যাওয়া সেই সুনজুনই বলে বসলেন, ফিল্ড হাসপাতাল ছেড়ে যাবেন না তিনি। প্রয়োজনে ভলান্টিয়ার হিসেবে থেকে যাবেন।

নানাভাবে বোঝানোর পর সুনজুন রোববার (৮ আগস্ট) হাসপাতাল ছাড়লেন বটে, কিন্তু শুনিয়ে গেলেন ভালোবাসার অনবদ্য কাব্য। গুগুল ট্রান্সলেশনে বললেন, এখানে আসার পর বাংলাদেশের চিকিৎসাসেবার ব্যাপারে তার ধারণা পাল্টে গেছে। ফিল্ড হাসপাতালে না এলে বুঝতেন না এখানে এমন মায়াবি সেবা দেওয়া হয়।

এসময় চীন গিয়ে সেই দেশের সরকারকে বাংলাদেশের চিকিৎসা খাতে বিনিয়োগের অনুরোধ করবেন বলেও জানান সুনজুন। প্রায় ৪০ বছর বয়সী সুনজুন চীনের কমউনিস্ট পার্টির নানজিং সিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা।

জানা যায়, ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসাসেবায় অভিভূত হয়ে এরইমধ্যে চীন সরকারের উচ্চপর্যায়ে ইতিবাচক বার্তা পাঠিয়েছেন সুনজুন। সেখানে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তার কয়েকটি গুগুল ট্রান্সলেশনের মাধ্যমে বাংলায় অনুবাদ করেও দেখান ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক ভলান্টিয়ারদের। সেগুলো হলো- ‘পরেরবার যখন চীন সরকার বাংলাদেশকে সহায়তা করবে, তখন রাস্তাঘাট ও সেতু নির্মাণের পরিবর্তে চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে বিবেচনা করতে বলবো।’ ‘আমি এখনই তাদের জানিয়েছি যে, এই হাসপাতালটি মানুষের জন্য আনন্দ এবং স্বাস্থ্য নিয়ে এসেছে।’ ‘আমি আমার চারপাশের বন্ধুদের বলব, আমি এমন হাসপাতালে থাকতাম, এখানকার চিকিৎসাকর্মীরা কীভাবে লড়াই করেছিলেন।’


এ প্রসঙ্গে ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান উদ্যোক্তা ও সিইও ডা. বিদ্যুত বড়ুয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘চীনা নাগরিক সুনজুনকে নিয়ে শুরুতে বেশ বেকায়দায় পড়তে হয়েছিল। মুশকিল হলো, তিনি চীনা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা জানেন না। দু-চার শব্দ ইংরেজি বোঝলে, তাও কথা ছিল। তার উপর হাসপাতালের দেওয়া খাবার খেতে তিনি অভ্যস্ত নন। চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি নিয়মিত তরল দুধ, ডিম, চিকেন ব্রোস্টসহ তার চাহিদামতো খবার জোগান দিতে আমরা সচেষ্ট ছিলাম সবসময়। উন্নত মানবিক সেবা দেওয়ার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত আমরা চেষ্টা করেছি সুনজুনের মাধ্যমে চীন তথা বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে। কারণ এদেশের উচ্চসোপান, সম্মান আমাদেরই সম্মান।’


সুনজুনের সার্বক্ষণিক সেবায় নিযোজিত মানবিক ভলান্টিয়ার ফারুক চৌধুরী ফয়সাল বলেন, সুনজুন ভিনদেশি নাগরিক। তাদের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা সবদিকেই আমাদের সাথে যোজন পার্থক্য। কিন্তু সুনজুনের সাথে আমাদের গড়ে ওঠা আত্মিক সম্পর্ক সেই পার্থক্য-দূরত্ব নিমিশে ঘুচে দিয়েছে। বহুরৈখিক মেলবন্ধনে, সেবায়, বন্ধুতায় প্রমাণ করার চেষ্টা করেছি মানবিকতা, মানবপ্রেম প্রশ্নে ভৌগোলিক সীমারেখা, জাতি ও রাষ্ট্রগত তফাৎ আমাদের কাছে গৌন।

একুশে/এটি