শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আনসার-ভিডিপি : ‘জাল সনদে’ চাকরি, অতপর ঘুষ ও নিয়োগ-বাণিজ্য!

প্রকাশিতঃ ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১১:৪৩ অপরাহ্ন

এম কে মনির, সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) : এসএসসির জাল সনদ ব্যবহার করে প্রায় ১৩ বছর ধরে চাকরি করার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক কাজী সাহেরা বেগমের বিরুদ্ধে।
শুধু তাই নয়, স্বজনপ্রীতি ও টাকার বিনিময়ে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে ওয়ার্ড দলনেত্রী-দলনেতা নিয়োগ, আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের ডিউটি-ভাতা আত্মসাতের অভিযোগও ওঠেছে তার বিরুদ্ধে; এসব অনিয়মে সীতাকুণ্ড উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান মিয়াও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

একুশে পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা গেছে, কাজী সাহেরা বেগম ১৯৮৪ সালে আনসারবাহিনীতে মহিলা আনসার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ১৯৯৬ সালে আনসার-বাহিনীতে উপজেলা মহিলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক পদ সৃষ্টি হলে কাজী সাহেরা এ পদে যোগদান করেন। ২০০৮ সালে অস্থায়ী আনসারদের স্থায়ীকরণ শুরু হলে ভুয়া এসএসসি সনদ দিয়ে তিনি চাকরিতে স্থায়ী হয়েছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। সেই থেকে দীর্ঘ ১৩ বছর কোনো বদলি ছাড়াই সীতাকু-েই কর্মরত আছেন তিনি।

সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৪ মার্চ কাজী সাহেরার বিরুদ্ধে আনসার ও ভিডিপির রেকর্ড শাখার স্মারক নং ৪৪.০৩.০০০০.০১৩.৩১.০০৩.১৬.৪৫৯ মূলে এসএসসির ভুয়া সনদ দিয়ে চাকরি করার অভিযোগের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রশাসন শাখার স্মারক নং-৪৪.০৩.০০০০.০১১.৭১.৭৪২.০৮.৫১০ তারিখ ২৮/০৩/২০২১ মূলে বিভাগীয় মামলা রুজু হয়। উক্ত বিভাগীয় মামলার অভিযোগ তদন্তের জন্য গত ১০ আগস্ট ঢাকা মহানগর উত্তর জোন অধিনায়ক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ও ৩৮ আনসার ব্যাটালিয়ন, মানিকগঞ্জের উপ-পরিচালক আরিফ বিন জলিলকে তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে।

শুধু জাল সনদই নয়, কাজী সাহেরার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে ওয়ার্ড দলনেতা ও দলনেত্রীর শূন্যপদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ঘুষবাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন এবং আনসারদের ভাতা আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, নিয়ম অনুসারে আনসার ও ভিডিপিতে ওয়ার্ড দলনেতা বা দলনেত্রী নিয়োগ পেতে হলে প্রথমে আনসার ও ভিডিপির সাধারণ সদস্য হতে হবে এবং আনসার ও ভিডিপির মৌলিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও সনদ থাকা আবশ্যক। একইসাথে প্রার্থীকে ন্যূনতম এসএসসি পাশ ও সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হতে হবে। এছাড়াও যেই ওয়ার্ডের শূন্যপদে নিয়োগ দেওয়া হবে সেই ওয়ার্ডে সিনিয়র ও প্রশিক্ষিত আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। সাধারণত ওয়ার্ড পর্যায়ে দলনেতা ও দলনেত্রী নিয়োগের বিষয়টি উপজেলা আনসার প্রশিক্ষিকা ও আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা করে থাকেন।

একটি ওয়ার্ডে জ্যেষ্ঠতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে বাছাই করে একজন প্রার্থীকে জেলা পর্যায়ে দলনেতা বা দলনেত্রী প্রশিক্ষণে পাঠানো হয়। কিন্তু সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ড ও কুমিরা ইউনিয়নের দলনেতা নিয়োগের ক্ষেত্রে আনসার ও ভিডিপি সদস্যই নয় এমন একজন পুরুষ দলনেতা ও মহিলা দলনেত্রীকে চূড়ান্ত করার অভিযোগ ওঠেছে কাজী সাহেরার বিরুদ্ধে। আর এসব কর্মকা-ে তাকে সমর্থন ও অবৈধ আর্থিক সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান মিয়ার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, সম্প্রতি আনসার ও ভিডিপির সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ড দলনেত্রী মাসুদা খায়ের দীর্ঘদিন পর অবসরে গেলে ওই পদটি শূন্য হয়। এরপর থেকে ৮নং ওয়ার্ডের কয়েকজন শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত নারী আনসার ও ভিডিপি সদস্য উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়ে গিয়ে ওয়ার্ড দলনেতা হওয়ার আগ্রহের কথা জানান। কিন্তু কাজী সাহেরা কারও যোগ্যতা বিবেচনা না করে সাবেক ওয়ার্ড দলনেত্রীর পুত্রবধূ মেহেজাবীন আক্তার মৌকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর এতে প্রশিক্ষিত জ্যেষ্ঠ আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।

বঞ্চিত একাধিক আনসার ও ভিডিপি সদস্য জানান, তাদের ওয়ার্ডে মেহেজাবীন আক্তার মৌ নামের যাকে দলনেত্রী নিয়োগ করা হচ্ছে তিনি কখনোই আনসার ও ভিডিপি সদস্য ছিলেন না। এমনকি তিনি প্রশিক্ষণও নেননি। এখানে অর্থের বিনিময়ে দলনেত্রী নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে এবং স্বজনপ্রীতি করা হচ্ছে। কারও আবেদন আমলে না নিয়ে আনসার ও ভিডিপি সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানহীন ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তিনি একজন নববধূ। তার বাড়ি চট্টগ্রামের বাইরের জেলায়। এখানকার স্থানীয় বাসিন্দা না হয়ে, প্রশিক্ষণ না নিয়ে কীভাবে তিনি নিয়োগ পাচ্ছেন- এ প্রশ্ন এখন সংশ্লিষ্টদের মুখো মুখে?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুরুষ আনসার ও ভিডিপি সদস্য একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমি উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়ে যাই। সেসময় আমি পুরুষ দলনেতা হতে চেয়েছিলাম। মাস্টার্স পাশ করেছি, প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভাবলাম বেকার সময়টাকে দেশের সেবায় নিয়োজিত করি। কিন্তু কাজী সাহেরা ম্যাডাম আমার কাছে দশ হাজার টাকা চাইলেন। পরে আরেকবার গেলে আবারও টাকা-পয়সার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেই থেকে আনসারের প্রতি আমার আস্থা উঠে গেছে। সাধারণ দলনেতা হতে হলে যদি টাকা দেওয়া লাগে তাহলে আমরা কোথায় যাবো?’

পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের একজন দলনেত্রী প্রার্থী বলেন, ‘আমি পড়াশোনা করেছি। ওয়ার্ডের সকল সদস্যের চেয়ে আমার পড়াশোনা বেশি। এই এলাকার স্থানীয় আমরা। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে দলনেত্রী পদটি খালি হলেও আমাদের সুযোগ হয়নি। একটি পরিবারেই থেকে যাচ্ছে পদটি। আগের দলনেত্রীর জায়গায় ভিন্ন জেলার বাসিন্দা পুত্রবধূ মেহেজাবীন আক্তার মৌকে দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে, সবকিছুই চূড়ান্ত।’

একই ওয়ার্ডের একজন মহিলা আনসার ও ভিডিপি সদস্য বলেন, ‘প্রায় বিশ বছর ধরে আনসারের সদস্য আমি। কোনোদিন কোনো সুযোগ-সুবিধা পাইনি। ট্রেনিং আসলে আমরা জানি না। বেশ কয়েকবার পূজা ও মেলার অস্থায়ী ডিউটি করে কম টাকা পেয়েছি। গতবার পূজায় ২ দিনের বেশি ডিউটি করে আমাদেরকে মাত্র ৫’শ টাকা দেওয়া হয়েছে। কত টাকা বরাদ্দ জানতে চাইলে কখনো জানানো হয়নি।’

আরেক নারী আনসার ও ভিডিপি সদস্য বলেন, ‘বছরে নির্বাচন, পূজা, মেলাসহ বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে আনসার সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। এসবকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের অবৈধ আয় করে থাকে কাজী সাহেরা ও মজিবুর রহমান মিয়া। মূলত সরকারের বরাদ্দ করা ভাতা থেকে একটা অংশ কেটে নিয়ে ঠকানো হয় আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের। এমনও ঘটেছে একবার এক ডিউটির ভাতা সরকার মোবাইলের মাধ্যমে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে ওয়ার্ড দলনেত্রীকে দিয়ে চাপ দিয়ে তাদের পারসেন্টেজ তুলে নেয় আমাদের থেকে। অন্যথায় পরবর্তী অনুষ্ঠানের ডিউটি বঞ্চিত করার হুমকি দেওয়া হয়।’

তিনি আরও বলেন, আনসারে দুর্নীতির শেষ নেই। প্রতিবারই কমপক্ষে অর্ধশতাধিক আনসার ও ভিডিপি সদস্য ট্রেনিং বা ডিউটি করে থাকে। জনপ্রতি ২০০ টাকার নিচে কখনো তারা কাটে না। সে হিসেবে বড় অঙ্কের টাকা তারা হাতিয়ে নেয়। এভাবে তারা বড় ধরনের অবৈধ আয় করে থাকে।’

এদিকে প্রশিক্ষণ ছাড়া কীভাবে পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের দলনেত্রী মেহেজাবীন আক্তার মৌকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে তা জানতে অনুসন্ধানে নামে একুশে পত্রিকা। উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়ে কর্মরত একজন জানান, গত বছর সৈয়দপুর ইউনিয়ন পরিষদে অনুষ্ঠিত ১০ দিনের একটি প্রশিক্ষণের ভর্তি তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা মূলত ভুয়া ভর্তি। ৩৩ জন পুরুষ ও ৩৩ জন নারীর ওই তালিকায় ৫৯ নং সিরিয়ালে সৈয়দপুর ইউনিয়নের পূর্ব সৈয়দপুর গ্রাম ও ডাকঘর জাফরনগর দেখিয়ে মেহেজাবীন আক্তার মৌ’র নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু নিয়োগ পেতে মেহেজাবীন আক্তার মৌকে পৌরসভার বাসিন্দা দেখানো হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ইউনিয়ন দলনেতা একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এক ইউনিয়নের বাসিন্দা অন্য ইউনিয়নে প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার নিয়ম নেই। নিয়ম অনুযায়ী সব ইউনিয়ন ও পৌরসভায় যখন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আসবে তখন সংশ্লিষ্ট এলাকার স্থানীয়রা অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া দলনেতা বা দলনেত্রী হতে হলে স্থানীয় বাসিন্দা হতে হবে। কারণ এখানে সবাইকে চেনার একটা ব্যাপার আছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পৌরসভা হচ্ছে টাউন ডিফেন্স পার্টি অর্থাৎ শহর প্রতিরক্ষাবাহিনী। আর ইউনিয়ন পর্যায়ে হচ্ছে ভিলেজ ডিফেন্স পার্টি অর্থাৎ গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। কেউ যদি শহর প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতা হতে চায়, তাহলে তাকে শহর প্রতিরক্ষার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। আমার জানা মতে, এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে ট্রেনিং নেওয়ার নিয়ম নেই।’

উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কার্যালয়ে কর্মরত একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সে (মেহেজাবীন আক্তার মৌ) কখন প্রশিক্ষণ নিয়েছে? আমি নিজেই জানি না। উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মজিবুর রহমান মিয়া ও কাজী সাহেরাই তার নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে আমাকে চাপ দেয়। বাধ্য হয়ে আমি অন্তর্ভুক্ত করি। এটা সম্পূর্ণ অন্যায়। ওই সদস্য প্রশিক্ষণ নেয়নি। পৌরসভার লোক ইউনিয়নে কী করে ট্রেনিং নেয়? তাছাড়া সে তো ট্রেনিং নেয়নি। ট্রেনিং ছাড়াই তাকে সনদ দেওয়া হয়েছে।’

এদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলার বিভিন্ন শিল্প কারখানার নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ‘আনসারগার্ড’ থেকে আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মাসিক মাসোয়ারা নেন বলে একটি অভিযোগ একুশে পত্রিকার কাছে এসেছে।

সীতাকুণ্ডস্থ পিএইচপি ফ্লোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রির আনসারগার্ডের ইনচার্জ গৌতম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আগের স্যার থাকতে একরকম দিতাম। এখন অন্য নিয়ম। তবে প্রতিমাসে টাকা দিই।’ এ সময় কত টাকা দিতে হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব মুঠোফোনে বলা যাবে না। সরাসরি দেখা হলে একদিন সব বলবো।’

উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মজিবুর রহমান মিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে একজন আনসার সদস্য বলেন, ‘বিভিন্ন আনসারগার্ডে যখন আনসার সদস্যরা বদলি হন তখন সেখানে পূর্বে কর্মরত মোট আনসার সদস্যদের ভাতা ও আনুষঙ্গিক তুলে নেওয়া হয় এবং অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের কথা বলে টাকাগুলো পরিপূরক বিল হিসেবে দেখিয়ে দেওয়া হয়। মূলত ওইসব টাকা আনসার সদস্যের দেওয়া হয় না। উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা ও গার্ড ইনচার্জরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে ফেলেন।’

নিজের পরিচয় গোপন করে এ আনসার সদস্য আরও বলেন, ‘বিভিন্ন ওয়ার্ড দলনেতা নিয়োগে টাকা নেওয়া হয়। সরকারিভাবে দলনেতাদের ২ হাজার ৫০০ টাকা ভাতা দেওয়া হয়। যা কেউ কেউ অবৈধভাবে নিয়োগ পেয়ে বসে বসেই খাচ্ছেন। অথচ তারা আনসারের কোনো কিছুই জানেন না। তাদেরকে যদি সাধারণ পিটি করাতে বলা হয় তারা পারবে কিনা সন্দেহ রয়েছে। ফলে আসল আনসার ও ভিডিপি সদস্যরা বছরের পর বছর বঞ্চিত হচ্ছে।’

এদিকে শুধু আনসারগার্ড থেকে মাসোহারাই নয়, অঙ্গিভূত আনসার ও ভিডিপি সদস্যদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ডিউটি-ভাতা আত্মসাতের অভিযোগও ওঠেছে মো. মজিবুর রহমান মিয়ার বিরুদ্ধে। বরাদ্দকৃত টাকার একটা অংশ যাতায়াত ও আনুষঙ্গিক খরচের বায়না দেখিয়ে আত্মসাৎ করেন তিনি- এমন অভিযোগ আনসার সদস্যদের।

জানা যায়, চলতি বছরের ২৬ মার্চ উপজেলা পরিষদ আয়োজিত কুচকাওয়াজে ৩২ জন আনসার অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও সেখানে ২৩ জন আনসার দিয়ে কুচকাওয়াজ করানো হয়। কিন্তু ভাতা তোলা হয় ৩২ জনের। তন্মধ্যে প্রতিজনের জন্য বরাদ্দ আসে ৭৫০ টাকা করে। কিন্তু উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মজিবুর রহমান জনপ্রতি ৫০০ টাকা করে দিয়ে ২৫০ টাকা করে কেটে রাখেন এবং ৯ জনের পুরো টাকাই নিজের পকেটে নিয়ে ফেলেন বলে অভিযোগ।

ওই কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়া সীতাকুণ্ডস্থ পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত আনসার সদস্য মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি ও আমার সহকর্মী সুদীপ্ত ২৬ মার্চের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলাম। আমাদের ৫০০ টাকা করে দুজনকে ১ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। বাকি টাকা গাড়ি ভাড়ার কথা বলে কেটে নিয়েছে।’ শফিকুল আরও বলেন, ‘সত্য বলে মরাও ভালো। এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের কারণে আজ পুরো জাতির দুর্দশা। তারা দেশকে ঠকাচ্ছে, ঠকাচ্ছে পুরো আনসার বাহিনীকে।’

কুমিরা ইউনিয়ন আনসার দলনেতা মো. সেলিম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে একজনকে নিয়ম লঙ্ঘন করে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল কাজী সাহেরা। আমি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানিয়েছি। এখানে অনিয়ম করে নিয়োগ-বাণিজ্য আমরা মানবো না।’

নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সীতাকুণ্ড উপজেলা আনসার ও ভিডিপি প্রশিক্ষক কাজী সাহেরা বেগম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ডের সাবেক দলনেত্রী মৌকে রেফার করেছে। তাই আমি দিয়েছি। টাকা-পয়সা আমি নিই নাই।’ প্রশিক্ষণ না নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে প্রশিক্ষণ নিয়েছে এবং সে শিক্ষিত। তাছাড়া এখানে পোষ্য কোটা আছে। সে নিয়মে নিয়োগ বৈধ।’

জাল সনদে চাকরি করার অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কাজী সাহেরা বেগম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সেটা আমি আমার বিভাগে প্রমাণে করবো। এটা আমার নিজের বিষয়।’

অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা আনসার ও ভিডিপি কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান মিয়া একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘অর্থের বিনিময়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। এটা ভুল তথ্য। ওই এলাকা থেকে কেউ আসেননি দলনেত্রী হতে। তাই মৌকে দেওয়া হয়েছে। আপনি একদিন আসেন। চায়ের দাওয়াত রইলো।’

এসময় নিয়ম লঙ্ঘন করে নিয়োগ পেতে যাওয়া সদস্যরা কোথায়, কখন ও কোন কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন তা জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন তিনি।

আনসারদের ভাতার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এসব মিথ্যা কথা। আমি ৭৫০ টাকা করে দিয়েছি। যারা কুচকাওয়াজে ছিল তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন।’ অথচ পল্লী বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কর্মরত আনসার সদস্যরা ২৬ মার্চের কুচকাওয়াজে অংশ নিয়েছিলেন; তারা অভিযোগ করছেন ৫’শ টাকা করে দিয়ে ২৫০ টাকা করে কেটে নেওয়া হয়েছে।

আনসারগার্ড থেকে মাসোহারা নেওয়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে মজিবুর রহমান মিয়া বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যা। আমি কোনো টাকা নিই না।’

এসব বিষয়ে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষাবাহিনীর চট্টগ্রাম জেলার কমান্ডেন্ট আশরাফ হোসেন ছিদ্দিক একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি কারও লিখিত অভিযোগ পাইনি। আনসারের ট্রেনিং থাকলে নিয়োগ পেতে পারে। কিন্তু ট্রেনিং ছাড়া নিয়োগ সম্ভব নয়।’

কাজী সাহেরার বিরুদ্ধে জাল সনদে চাকরি নেওয়া সংক্রান্ত বিভাগীয় মামলা থাকার সত্যতা স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এরকম অনেকের মামলা হয়েছে। বিষয়টি হেডকোয়ার্টার বলতে পারবে। আমি বলতে পারবো না।’
জানতে চাইলে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশাসন শাখার উপ-পরিচালক এএসএম সাখাওয়াৎ হোসাইন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যখন বিভাগীয় মামলাটি নিস্পত্তি করে দেওয়া হবে, তখন তার শাস্তি যা পাওয়ার সে পাবে। তখন গণমাধ্যম বিষয়টি জানতে পারবে।’

আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রশাসন শাখার পরিচালক নুরুল আমিন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সাহেরার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলার বিষয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না। এরকম অনেকজনের বিরুদ্ধে মামলা আছে।’ এসময় তদন্তের কার্যক্রম বা ফলাফল সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।

এদিকে জাল সনদে চাকরি করার অভিযোগের প্রেক্ষিতে দায়ের হওয়া বিভাগীয় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আরিফ বিন জলিলকে একাধিকবার ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।