শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চট্টগ্রামে যুবকের মৃত্যুতে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

প্রকাশিতঃ ২২ অক্টোবর ২০২১ | ২:২৩ অপরাহ্ন


মোহাম্মদ রফিক : চট্টগ্রাম নগরের বহদ্দারহাট এলাকায় পুলিশের ভয়ে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে মুন্না ওরফে মনাইয়া (২৪) নামে সেই যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।

মামলার এজাহারের বর্ণনা মতে, গত ১৭ অক্টোবর ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় মুন্নার। এর আগে রাত ৩টা ১৫ মিনিটে স্থানীয়দের সহায়তায় তাকে আহত অবস্থায় চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।

এদিকে, ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার সাথে মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকার বর্ণনার মিল পাওয়া যাচ্ছে না।
এজাহার মতে, ১৭ অক্টোবর রাত ৩টা ১৫ মিনিটে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে উপস্থিত দুইজন সাক্ষীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়। এরপর স্থানীয়দের সহায়তায় মুন্নাকে চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। কিন্তু চমেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির তথ্য অনুযায়ী, ১৭ অক্টোবর রাত ৩টা ১৫ মিনিটে আহত অবস্থায় মুন্নাকে জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান খালাতো বোন রাবেয়া খাতুন।

রাবেয়া খাতুন একুশে পত্রিকাকে বলেন, “মুন্নার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে আমি ১৭ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টার দিকে চমেক হাসপাতালে যাই। রাত ৩টা ১৫ মিনিটে আমি হাসপাতালে যাওয়ার প্রশ্নই উঠে না। সেদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মুন্নার লাশ চমেক হাসপাতালের পাঁচতলার ২৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নিচে নামিয়ে লাশঘরে রাখা হয়। এসময় এক পুলিশ অফিসার এসে আমার নাম ও মোবাইল নম্বর নেন।”

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রফিক সওদাগর একুশে পত্রিকাকে জানান, সেই রাতে (২টা থেকে ৩টার মধ্যে) তার টিনশেড দোকানের উপর থেকে তিন যুবক লাফিয়ে পড়েন। এরমধ্যে দুইজন দৌড়ে পালিয়ে যায়। আরেকজন তার দোকানের সামনে আহত অবস্থায় কাতরাতে থাকেন। এসময় ঘটনাস্থলে পুলিশের একটি গাড়ি আসে। রফিকের ভাষ্যমতে, আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে তিনিই পুলিশ সদস্যদের বলেছেন। পুলিশই মুন্নাকে হাসপাতালে নিয়ে যান বলে দাবি রফিকের।

এজাহার মতে, রাত ১টা ৪০ মিনিটে যমুনা ব্যাংকের পেছনে ছাবের কলোনির তৃতীয় তলার ১০ নম্বর রুম থেকে আসামিদের ফেলে যাওয়া চারটি পলিব্যাগে ৬২২ পিস ইয়াবাসহ ইয়াবা সেবনের বিভিন্ন সরঞ্জাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষী ছাবের কলোনির বাসিন্দা মো. কামাল ও মো. ফয়সালের উপস্থিতিতে জব্দ করেন চান্দগাঁও থানার এসআই হৃদয় মাহমুদ লিটন। এরপর এসআই হৃদয় মাহমুদ লিটন ও তার সঙ্গীয় ফোর্স এবং জব্দ তালিকার সাক্ষী কামাল, ফয়সালসহ ভবনটির নিচে নামলে সেখানে থাকা লোকজন আহত অবস্থায় এক যুবক (মুন্না) পড়ে থাকার খবর পুলিশকে জানায়।

জব্দ তালিকায় সাক্ষী হওয়া মো. কামাল একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি ফুটপাতে ভোর ৪/৫টা পর্যন্ত চায়ের দোকান করি। সেই রাতে রফিক সওদাগরের দোকানের সামনে কিছু সিএনজি অটোরিকশা চালকের চেঁচামেচি শুনে রফিক সওদাগরের পানের দোকানের সামনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি-এক লোক মাটিতে পড়ে আছে। ছাবের কলোনির তৃতীয় তলা থেকে পুলিশ ইয়াবা জব্দ করার সময় আমি ছিলাম না।’

আহত অবস্থায় মুন্নাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকায় অসঙ্গতির বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চান্দগাঁও থানার ওসি মঈনুর রহমান একুশে পত্রিকাকে বলেন, “এ ঘটনায় পুলিশের তরফ থেকে কোনও ফাউল প্লে হয়নি। সব মাদক ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে তো আর থানায় মামলা নেই। জব্দ তালিকায় যারা সাক্ষী হয়েছেন, তারা আদালতে ঘটনার বর্ণনা দেবেন।”

এদিকে মারা যাওয়া মুন্নার পরিবারের এক সদস্য প্রশ্ন রেখে বলেন, “খালাতো বোন রাবেয়া খাতুনই যদি মুন্নাকে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যেতেন তাহলে মুন্নার বাবার সঠিক নামটাই দিতেন। এজাহারে মুন্নার বাবার নাম উল্লেখ করা হয়েছে দুলাল আহমদ। হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির রেকর্ডে কেন মুন্নার বাবার নাম মৃত আনোয়ার হোসেন লেখা হয়েছে।”

মুন্নার বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের কোনও থানায় অভিযোগ বা মামলা ছিল না দাবি করে তার মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে দিনমজুরের কাজ করতো। স্ত্রীকে নিয়ে সে থাকতো শুলকবহর এলাকায়। তার স্ত্রী গার্মেন্টেসে চাকরি করে। তাদের ১০ মাস বয়সী এক সন্তান আছে। আমি থাকি খতিবের হাট গায়েবি মসজিদ এলাকায়। মুন্না আমাকে প্রায় প্রতিদিন দেখতে আসতো। আমার জন্য পান সুপারি নিয়ে আসত। ঘটনার দিন সন্ধ্যা ৭টায় তার স্ত্রীকে দেড়হাজার টাকা দিয়ে বাসা থেকে বের হয়েছিল। এ টাকা দিয়েছিল জশনে জুলুস উপলক্ষে তার জন্য একটি পাঞ্জাবি, আমার জন্য একটি মেক্সি কিনতে। সে মাঝেমধ্যে ইয়াবা সেবন করতো বলে শুনেছি।’

প্রসঙ্গত, এ ঘটনায় ১৭ অক্টোবর সকালে চান্দগাঁও থানায় পলাতক আসামি রানা ও ধামা জুয়েলের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দায়ের হয়। এর আগে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করেন চান্দগাঁও থানার এসআই হৃদয় মাহমুদ লিটন। জিডি নম্বর ৯৪৭। তারিখ-১৭ অক্টোবর ২০২১। সময়-২টা ৩০ মিনিট। ঘটনাস্থল : বহদ্দারহাট যমুনা ব্যাংকের পেছনে ছাবের সওদাগরের কলোনির, তৃতীয় তলার ১০ নম্বর রুম।

এতে পুলিশ উল্লেখ করেন, পলায়নরত আসামি মো. মুন্না, রানা (২৫) এবং মোহাম্মদ জুয়েলদের ফেলে যাওয়া মতে উদ্ধারপূর্বক জব্দকৃত। জব্দ তালিকায় সাক্ষী করা হয় ঘটনাস্থল যমুনা ব্যাংকের পেছনে ছাবের কলোনির অস্থায়ী বাসিন্দা মৃত বজল আহমদের ছেলে মো. কামাল (২৯) এবং একই কলোনির বাসিন্দা মৃত আজিজুর রহমানের ছেলে মো. ফয়সাল। জব্দ দেখানো হয়েছে গোলাপি রংয়ের ৬২২ পিস ইয়াবা, এক বান্ডেল ইয়াবা সেবনের ফয়েল পেপার এবং ইয়াবা সেবনের পাঁচটি গ্যাস লাইট।

জব্দ তালিকায় বলা হয়-উপরোক্ত আলামতসমূহ পলায়নরত আসামিদের ফেলে যাওয়া মতে ঘটনাস্থল হইতে উদ্ধারপূর্বক উপস্থিত সাক্ষীদের সম্মুখে জব্দকৃত।

এজাহারের বর্ণনা অনুযায়ী, মারা যাওয়া মো. মুন্না ওরফে মনাইয়ার গ্রামের বাড়ি পটিয়া উপজেলার পূর্ব বাড়ইখড়া দুলাল ফকির সওদাগরের বাড়ি। তার বাবার নাম দুলাল আহমদ। মায়ের নাম-মনোয়ারা বেগম। বর্তমানে তারা বসবাস করেন পাঁচলাইশ থানাধীন খতিবের হাট গায়েবি মসজিদ এলাকার হারুন সওদাগরের ভাড়া বাসায়। মামলার দুই নম্বর আসামি চান্দগাঁও থানাধীন বারই পাড়ার মো. আবু ওরফে ডাকাত আবুর ছেলে রানা (২৫)। তিন নম্বর আসামি চান্দগাঁও থানাধীন খাঁজা রোডের কসাই পাড়ার মো. জুনু ওরফে জুনু ড্রাইভারের ছেলে মো. জুয়েল ওরফে ধামা জুয়েল (৩০)।

এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত ১৬ অক্টোবর চান্দগাঁও থানার জিডি (৯৪৭) মূলে সঙ্গীয় ফোর্সসহ থানা এলাকায় স্পেশাল-৩১ (নৈশ) ডিউিটি করাকালীন ১৭ অক্টোবর রাত ১টা ২০ মিনিটে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল অবস্থানকালীন গোপন সংবাদের ভিত্তিতে জানতে পারি যে, বহদ্দারহাট এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. জুয়েল ওরফে ধামা জুয়েল তার সঙ্গীয় মাদক ব্যবসায়ীদের নিয়ে যমুনা ব্যাংকের পেছনে ছাবের সওদাগর কলোনির তৃতীয় তলার ১০ নম্বর রুমে অবস্থান করছে।

সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে রাত ১টা ৪০ মিনিটে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদক ব্যবসায়ী মো. জুয়েল ওরফে ধামা জুয়েলসহ দুইজন মাদক ব্যবসায়ী দৌড়ে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। ঘটনার বিষয়টি থানার ওসিকে অবহিত করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত সাক্ষী মো. কামাল ও মো. ফয়সালের সামনে নীল রংয়ের চারটি পলিব্যাগ থেকে ১ লাখ ২৪ হাজার ৪০০ টাকা মূল্যের গোলাপি রংয়ের ৬২২ পিস ইয়াবা এবং ইয়াবা সেবনের কিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। রাত ৩টা ১৫ মিনিটে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে কামাল ও ফয়সালের স্বাক্ষর নেওয়া হয়।

এজাহারে বলা হয়েছে, সাক্ষী মো. কামাল পুলিশকে জানান যে, ঘটনাস্থলের ১০ নম্বর রুমে মো. জুয়েল ওরফে ধামা জুয়েলের সাথে মাদক ব্যবসায়ী মুন্না (মারা গেছেন) ও রানা উপস্থিত ছিল। ঘটনাস্থল থেকে আলামত জব্দ করে উপস্থিত সাক্ষী ও সঙ্গীয় ফোর্সসহ বিল্ডিংয়ের নিচে নামলে স্থানীয় লোকজন জানায়, পলাতক আসামি মুন্না ছাবের সওদাগর কলোনির পাশে রফিক সওদাগরের টিনশেড দোকানের উপর থেকে লাফিয়ে পড়লে মাথার পেছনে রক্তাক্ত জখম হয়। এসময় মুন্নাকে স্থানীয়দের সহায়তায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করি। ১৭ অক্টোবর ভোর ৬টা ৩৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

সাক্ষী মো. কামাল ও ফয়সাল জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা পুলিশকে জানান, পলাতক আসামি মো. মুন্না ওরফে মনাইয়া, রানা ও জুয়েল বহদ্দারহাট কাঁচাবাজার ও যমুনা ব্যাংক সংলগ্ন এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা করতো।

এদিকে মামলার এজাহারে নানা অসঙ্গতির বিষয়ে জানতে এসআই হৃদয় মাহমুদ লিটনের মুঠোফোনে বৃহস্পতিবার (২১ অক্টোবর) একাধিকবার কল করা হলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

মামলার এজাহার ও জব্দ তালিকায় কোনো প্রকার অসঙ্গতি নেই বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) উপকমিশনার (উত্তর) মোখলেছুর রহমান। তিনি একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘মারা যাওয়া মুন্নার বিরুদ্ধে এর আগে থানায় কোনো মামলা না থাকলেও সে মাদক ব্যবসায় জড়িত ছিল। মামলার এজাহারে তথ্যের ঘাটতি থাকতে পারে। কারণ পুলিশের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক পাওয়া তথ্য ক্রসচেক করার সুযোগ থাকে না। পরে তদন্তে সত্যটা বেরিয়ে আসে। এক্ষেত্রে চান্দগাঁও থানা পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি আছে বলে আমি মনে করি না।’