বুধবার, ৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১ কার্তিক ১৪৩২

অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে গতি নেই

| প্রকাশিতঃ ২৯ নভেম্বর ২০২১ | ২:০৩ অপরাহ্ন

  • চট্টগ্রামে তিন শতাধিক অবৈধ ইটভাটা এখনো দূষণ ছড়াচ্ছে
  • তিন ফসলি জমি ও স্কুলের পাশে গড়ে উঠেছে ইটভাটা
  • অবৈধ ইটভাটা রক্ষায় জনপ্রতিনিধিরা
  • অবৈধভাবে ৯টি ইটভাটার অনুমোদন দিয়ে ফেঁসে যাচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তরের তিন কর্মকর্তা

জিন্নাত আয়ুব : ফসলি জমিতে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। আশপাশের জমি থেকে মাটি কেটে ওই ভাটায় নেওয়া হচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় ভাটার মালিককে জরিমানাও করা হয়েছে। তারপরও ভাটায় ইট তৈরির কার্যক্রম চলছে। শাহ মোহছেন আউলিয়া ব্রিকস (এমবিএম) নামের অবৈধ এই ইটভাটাটির অবস্থান চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের হলুদিয়া পাড়া এলাকায়।

সরেজমিনে দেখা যায়, এমবিএম ইটভাটার পাশে ফসলি জমি। এসব জমিতে চাষ করা হয়েছে ধানসহ বিভিন্ন ফসল। কৃষিজমিতে ইটভাটা স্থাপন করায় চাষাবাদে ফলন কমে গেছে। ইটভাটার পাশেই বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। এছাড়া ভাটার পাশ দিয়ে গেছে হলদিয়া পাড়া সড়ক ও শাহ মোহছেন আউলিয়া মাজার সংযোগ সড়ক। ভাটার কারণে প্রায় সময় ধুলাবালুতে আচ্ছন্ন থাকে এলাকা। ফলে যানবাহনের চালক, যাত্রী ও পথচারীরা দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন।

স্থানীয়রা জানান, ২০১৬ সালের শুরুতে পরীরবিল এলাকায় তিন ফসলি জমিতে এমবিএম নামের এই ইটভাটা স্থাপন করা হয়। প্রশাসনের অনুমতি না পেলেও প্রতিষ্ঠানটি ইট তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন ২০০৩ অনুযায়ী, ফসলি জমিতে ইটভাটা স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা আছে। তবে এ ক্ষেত্রে সেই নিষেধাজ্ঞা মানা হয়নি।

সর্বশেষ গত ১৯ জানুয়ারি সকাল ১১টার দিকে জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুরাইয়া ইয়াছমিনের নেতৃত্বে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজারুল ইসলাম ও শেখ মুজাহিদ, পুলিশ, র‌্যাব ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন স্কেভেটর নিয়ে এমবিএম ইটভাটা উচ্ছেদ করতে যান। কিন্তু রহস্যজনক কারণে ইটভাটা উচ্ছেদ না করে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করে ফিরে যায় প্রশাসন।

উচ্ছেদ না করে জরিমানা করা প্রসঙ্গে তখন জেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুরাইয়া ইয়াছমিন একুশে পত্রিকাকে বলেছিলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় শাহ মোহছেন আউলিয়া ব্রিকসকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এবার শেষ চান্স, তিনমাসের মধ্যে কাগজপত্র ঠিক না করলে পুনরায় অভিযান করা হবে।’

কিন্তু সেই ‘কাগজপত্র’ আর ঠিক করতে পারেননি এমবিএম ইটভাটার মালিকরা। চলতি বছরও ভাটায় পুরোদমে ইট তৈরি হচ্ছে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইটভাটার মালিকরা কৃষকদের অস্বচ্ছলতার সুযোগে নামমাত্র মূল্যে কৃষিজমির ‘টপ সয়েল’ কেটে নিয়ে যাচ্ছে আজ ছয় বছর ধরে। এতে জমির পুষ্টিগুণ ও উৎপাদন শক্তি হারিয়েছে। এভাবে টপ সয়েল কেটে নেওয়া কারণে ভাটার আশপাশের জমিগুলো ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হারাতে বসেছে। এছাড়াও উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মাটি সংগ্রহ করে কৃষকের ফসলি জমির উপর দিয়ে ট্রাক্টরযোগে মাটিগুলো স্থানান্তরিত করার কারণে নষ্ট হয়েছে ফসলি জমি ও সড়ক।

এমবিএম ইটভাটার কাছেই বটতলী শাহ মোহছেন আউলিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের অবস্থান। স্কুলের শিক্ষক নজরুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘এরকম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ইটভাটা করার নিয়ম নেই। ইটভাটার কারণে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে অসুবিধা তো আছেই। এখন এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবে প্রশাসন। আমি শিক্ষক মানুষ এসব নিয়ে বেশি কথা বলতে চাই না। আমার তো এখানে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করতে হয়। শুনেছি ইটভাটার মালিকরা খুব প্রভাবশালী।’ বটতলী গ্রামের কৃষক মো. আলী একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যে জমিতে বছরে তিনবার ধান চাষ হতো, সেখানে ইটভাটা হয়েছে। এতে আমরা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমরা চাই ইটভাটাটি বন্ধ হোক।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শাহ মোহছেন আউলিয়া ব্রিকসের (এমবিএম) অন্যতম মালিক মো. মাইনুউদ্দীন একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা তো এখন ফসলি জমির মাটি কাটছি না। মাটিগুলো আমরা গত বছর সংগ্রহ করেছি। এসব নিয়ে নিউজ বাদ দিন। আপনার সঙ্গে আমি বসতে চাই।’

এ বিষয়ে আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ জোবায়ের আহমেদ একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘যাদের জমি থেকে ইটভাটার জন্য মাটি নিচ্ছে তারা অভিযোগ দিলে ব্যবস্থা নেব। তাছাড়া বিগত সময়ে এসব ইটভাটায় জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসন একাধিক অভিযান চালিয়ে জরিমানাও করেছে। স্থানীয়দের অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’

জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসাব মতে, চট্টগ্রাম জেলায় মোট ইটভাটা ৪০৮টি। এর মধ্যে ফিক্সড চিমনি (৮০-১২০ ফুট) ২৮৪টি, জিকজ্যাক চিমনি ১২১টি এবং অন্যান্য ইটভাটা রয়েছে তিনটি। ২০১৮ সালে তৈরি করা পরিবেশ অধিদপ্তরের তালিকা অনুসারে এগুলোর মধ্যে ৩১০টির পরিবেশগত ছাড়পত্র মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে কিংবা কোনো অনুমোদনপত্রই নেই। এসব অবৈধ ইটভাটা থেকে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন তাদের রাজস্ব আদায় থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। প্রশাসনের কঠোরতার অভাবকে পুঁজি করে এসব অবৈধ ইটভাটাগুলো এখনও কীভাবে চলছে, তার অন্যতম উদাহরণ আনোয়ারা শাহ মোহছেন আউলিয়া ব্রিকস।

যদিও ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০১৩ (সংশোধিত-২০১৯)-এর ৪ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া কোনো ইটভাটা চালানো যাবে না। এর ব্যত্যয় হলে দুই বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়াও ইটভাটা নির্মাণের আগে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিএসটিআই, স্থানীয় ভূমি অফিসসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক। কাগজে-কলমে এমন নিয়ম থাকলেও তা মানতে নারাজ অসাধু ইটভাটা মালিকরা। এদের কারও নেই ছাড়পত্র; কেউ মানছেন না আইনও। সুস্থ পরিবেশের জন্য এসব ইটভাটা এখন ‘গলার কাঁটা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের আইনজীবী মনজিল মোরসেদের একটি রিট আবেদনের পর হাইকোর্ট চট্টগ্রাম অঞ্চলের সব অবৈধ ইটভাটা ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেন। এরপর বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় অভিযান শুরু হয়। তবে প্রথম দিকে কিছু ইটভাটা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলেও অনেকগুলোকে জরিমানা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করা হয়। পরে হাইকোর্ট আরেক আদেশে ইটভাটা উচ্ছেদ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য নির্দেশ দেন।

হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রামে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ কার্যক্রম চলছে। তবে তাতে অগ্রগতি কম। এর পেছনে ভাটার মালিক সমিতির প্রভাব অন্যতম। গত ফেব্রুয়ারিতে মালিক সমিতি সংবাদ সম্মেলন করে উচ্ছেদ বন্ধের দাবিতে কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। পরে তারা কর্মসূচি পালন থেকে সরে এলেও ভাটা উচ্ছেদের গতি বাড়েনি। উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও অর্থসংকটের কথা বলছে পরিবেশ অধিদপ্তর।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে তিনশর বেশি ইটভাটা অবৈধভাবে ব্যবসা করে আসছে। বাস্তবে অবৈধ ইটভাটার সংখ্যা আরও বেশি। অনেক প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্রের মেয়াদ শেষ হলেও করেনি নবায়ন। অনুমতিপত্র নিতে বললেও তাও মানছে না তারা। সবচেয়ে বেশি অবৈধ ইটভাটা রয়েছে রাঙ্গুনিয়ায় ৬৯টি। ফটিকছড়িতে ৪৬টি, হাটহাজারীতে ৪০টি, সাতকানিয়ায় ৩৮টি, রাউজানে ৩৬টি ও চন্দনাইশে ৩২টি।

সাতকানিয়ার কেরানিহাট এলাকায় একই সারিতে তিনটি ইটভাটা দেখা গেছে। ইছানগর, চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গাচর, কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন পাড়ে প্রধান সড়ক ও বসতির পাশেই অবৈধভাবে গড়ে ওঠা বেশ কয়েকটি ইটভাটা পরিবেশ দূষণ করছে। অথচ ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮ ধারায় কৃষিজমি, অভয়ারণ্য, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা, জনবসতি, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন সদরের এক কিলোমিটার এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার দুই কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।

এদিকে হালদার পাড়ে চট্টগ্রামের রাউজান অংশে এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে দুটি ইটভাটা। এ দুটি হচ্ছে উপজেলার উরকিরচর ইউনিয়নের সার্কদা এলাকায় ‘মেসার্স আজমীর অটো ব্রিকস’ ও পশ্চিম আবুরখীল এলাকায় ‘শান্তি ব্রিকস’। অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ অভিযানে গুঁড়িয়ে দেওয়া নোয়াপাাড় ইউনিয়নের মোকামী পাড়ায় ‘এ আলী’ ইটভাটাটিও ফের চালুর প্রক্রিয়া চলছে। নদীর তীরে গড়ে ওঠা তিনটি ইটভাটার কারণে হুমকির মুখে পড়েছে দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর মা-মাছ, ডলফিনসহ নদীর জীব-বৈচিত্র্য।

চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা গবেষক ড. মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, ‘ইটভাটার ধোঁয়াগুলো আশপাশের পরিবেশসহ নদীর পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়া নদীর পাড় কাটা, ইট পরিবহনের জন্য বড় বড় জাহাজের ব্যবহার নদীর জন্য ক্ষতিকর। ইটভাটার ধোঁয়া বাতাসের আর্দ্রতার সঙ্গে মিশে এসিড হয়। এটা যখন নিচে পড়ে সালফিউরিক এসিডে পরিণত হয়। এছাড়া কয়লাও ক্ষতিকর, কাঠ জ¦ালানো হলে কার্বন ডাই-অক্সাইড তৈরি হয়। এগুলো বাতাস আর আর্দ্রতার সঙ্গে মিশে নদীর পানিতে এসে নদীর প্রচণ্ড ক্ষতি করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নদীতে চলাচলরত ড্রেজারের আঘাতে ডলফিনের মৃত্যুও হচ্ছে।

অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদ করতে উচ্চ আদালতে রিটকারী আইনজীবী হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ বলেন, আদালত অবৈধভাবে পরিচালিত সব ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে প্রশাসন এখনও সফল হয়নি। প্রশাসন কঠোর অবস্থান না নেওয়ায় কয়েকশ ইটভাটা সম্পূর্ণ অবৈধভাবেই চলছে।

এদিকে অবৈধ ইটভাটা উচ্ছেদে গতি না আসার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের হাতে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ইটভাটাগুলোর নিয়ন্ত্রণ। জেলা-উপজেলার ইটভাটা মালিক সমিতির নেতৃত্বে রয়েছেন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, ইউপি সদস্যসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। এমনকি সাংসদ বা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদেরও নামে-বেনামে ইটভাটা রয়েছে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি পৌর মেয়র ইসমাইল হোসেন। তিনি আবার চট্টগ্রাম ইট প্রস্তুতকারী মালিক সমিতির আহ্বায়ক। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি তাঁরা সংবাদ সম্মেলন করে অভিযানের প্রতিবাদে ইট বিক্রি বন্ধসহ নানা কর্মসূচির ঘোষণা দেন।

ইসমাইল হোসেন সেদিন লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘ চট্টগ্রামে ৫০০ ইটভাটা রয়েছে। প্রতিটি ইটভাটায় দৈনিক ৭০০-৮০০ জন শ্রমিক কাজ করেন। বর্তমান সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অধিকাংশই চট্টগ্রাম অঞ্চলে। বিশেষত কর্ণফুলী টানেল নির্মাণকাজ, রামগড়-হেঁয়াকো হয়ে হাটহাজারী-ফটিকছড়ি সড়ক, হাটহাজারী-রাঙামাটি ফোর লেইন সড়ক, মহেশখালী-মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকাজ, মিরসরাই ইকোনমিক জোনসহ একাধিক মেগা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলা ও মহানগরে চলমান সরকারি উন্নয়নকাজে প্রায় ৫০ কোটির বেশি ১ নম্বর ইট এবং গড়ে প্রতি উপজেলায় ২ কোটির বেশি ইট প্রয়োজন হয়। ইটভাটা বন্ধ হয়ে গেলে সরকারের সব মেগা প্রকল্পের কাজে জটিলতা সৃষ্টি হবে।’

পরদিন মনজিল মোরসেদ এই কর্মসূচিকে আদালত অবমাননার শামিল উল্লেখ করে আইনি নোটিশ পাঠালে কর্মসূচি থেকে সরে আসে মালিক সমিতি। এদিকে রাউজান উপজেলায় সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে যুবলীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র জমির উদ্দিন পারভেজ এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলামের ভাটা ভেঙে দেওয়া হয়। জমির উদ্দিন উপজেলা ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি, তাঁর সঙ্গে সমিতির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন রাউজান সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন। অন্যদিকে রাঙ্গুনিয়ায় ভাটা মালিক সমিতির সভাপতি হলেন ইসলামপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আছেন আওয়ামী লীগ নেতা কামাল উদ্দিন চৌধুরী। এদিকে গত বছরের এদিকে ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিম সাতকানিয়া ইটভাটা মালিক সমিতি নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি করা হয় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান শাহ আলমকে। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর হাসান লিটন এবং সদস্য হিসেবে এওছিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের নাম রয়েছে। কমিটিতে স্থানীয় সাংসদ আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভীর অনুমোদন রয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলার উপপরিচালক জমির উদ্দিন বলেন, ‘অনেক জনপ্রতিনিধি ইটভাটা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কাঠ পোড়ানো, নিষিদ্ধ এলাকায় ভাটাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। যেগুলো অবৈধ সেগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। আদালতের নির্দেশে অভিযান চালাচ্ছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এখনো অনেক ইটভাটা উচ্ছেদ কার্যক্রম বাকি রয়েছে।’

এদিকে ইটভাটার কারণে বায়ু দূষণের পাশাপাশি মাটি ও পানির ক্ষতি হয় বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে। ‘চট্টগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত ইটের ভাটা থেকে নিঃসৃত গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ নির্ণয়: একটি ভূপরিবেশগত সমীক্ষা’ শিরোনামে একটি গবেষণা করা হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অলক পালের তত্ত্বাবধানে মোহাম্মদ আলীম উল্লাহ খান নামে একজন এই গবেষণা করেন। গবেষণায় বলা হয়, ৪০ লাখ ইট তৈরিতে একেকটি চুল্লি থেকে প্রায় ৩৯৪ টন কার্বন, ১ হাজার ৪৪৪ টন কার্বন ডাই–অক্সাইড, ৬ দশমিক ৩ টন মিথেন ও ১০২ টন নাইট্রিক অক্সাইড নিঃসৃত হয়। অধ্যাপক অলক পাল বলেন, শুধু বাতাস নয়, ইটভাটা মাটি ও পানিরও ক্ষতি করে থাকে। ইটভাটার আশপাশের এলাকার মানুষ চর্ম, ফুসফুস ও শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগে আক্রান্ত হন।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, ‘ইটভাটার ধোঁয়া শিশু ও বয়স্কদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। এ থেকে শ্বাসকষ্ট, ব্রঙ্কিউলাইটিস, চর্মরোগ ও ফুসফুসের সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কম দূরত্বের মধ্যে একাধিক ইটভাটা থাকলে তা জনস্বাস্থ্যের ওপর বেশি প্রভাব ফেলে।’

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মমিনুর রহমান বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশনা শতভাগ বাস্তবায়নে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করে অনেক অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছু ইটভাটা ফের চালু হওয়ার তথ্যও পেয়েছি। সেগুলোসহ সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নুরী বলেন, ‘পরিবেশ দূষণের জন্য অবৈধভাবে পরিচালিত ইটভাটাগুলো বেশিরভাগ দায়ী। ইটভাটার কালো ধোঁয়া পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সব অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’

পরিবেশ রক্ষায় অবৈধ ইটভাটা গুঁড়িয়ে দেয়ার কথা বললেও পরিবেশ অধিদপ্তরেরই তিন কর্মকর্তা আবার সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় অবৈধভাবে ৯টি ইটভাটার অনুমোদন দিয়েছেন। ইতোমধ্যে তাদেরকে শোকজ করা হয়েছে। শোকজের মুখোমুখি হওয়া তিন কর্মকর্তা হলেন- পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক জমির উদ্দিন, সহকারী পরিচালক নাজনীন সুলতানা নীপা ও আফজারুল ইসলাম। এ তিন কর্মকর্তার যোগসাজশে মিথ্যা তথ্যে ৯টি ইটভাটার অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তরেরই তদন্তে উঠে এসেছে।

জানা গেছে, সাতকানিয়া-চন্দনাইশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পাহাড়ের আশপাশে ৯টি ইটভাটা মিথ্যা তথ্যে অনুমোদন দেওয়া হয়। অথচ পরিবেশ আইনে এসব ইটভাটা অনুমোদন পাওয়ার সুযোগ নেই। এ ঘটনায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল ইসলামের নির্দেশে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তিন সদস্য পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সেলিনা আক্তার, পরিদর্শক জোবায়ের হোসেন এবং নূর হাসান সজীব সরেজমিন পরিদর্শন করে সম্প্রতি প্রতিবেদন দাখিল করেন। এতে মিথ্যা তথ্যে ৯টি ইটভাটা অনুমোদন দেওয়ার বিষয়টি উঠে আসে।

পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল ইসলাম একুশে পত্রিকাকে বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছ থেকে শোকজের সন্তোষজনক জবাব পাওয়া না গেলে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়ম না মেনে যে ৯টি ইটভাটার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আরেকবার যাচাই-বাছাই শেষে সেগুলোর অনুমোদন বাতিল করা হবে।’